কুয়েতে হার না মানা মমতাজ
জন্ম থেকেই তাঁর দুঃখ শুরু। বাল্যবিবাহের পর সইতে হয় স্বামীর নির্যাতন। এরপর দুই শিশুসন্তান নিয়ে শুরু হয় লড়াই। সোনার হরিণ দেখতে ছুটে আসেন কুয়েতে। ব্যর্থ হয়ে আবার ফিরে যান রূপসী বাংলায়।
শুরু হয় আবার সংগ্রাম। সেই লড়াইয়ে আসে প্রেম, শুরু হয় নতুন জীবন। এই জীবন-সংগ্রামের নাম মমতাজ বেগম (৪৭)।
কুয়েতপ্রবাসী এই মমতাজের আজকে হয়তো বেঁচে থাকার কথা ছিল না। শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন নিজেকে।
কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে মমতাজ বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘জীবনের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সন্তানদের কথা চিন্তা করে তা করতে পারিনি। সন্তানদের জন্য নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। অভাবের সাথে আমার যুদ্ধ শুরু হয়। দুমুঠো ভাত আর একটু আশ্রয়ের আশায় কী না করেছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝিয়ের কাজ করেছি। সন্তানদের তাদের বাবার মতো নয়, আমার মতো করে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। আল্লাহর রহমতে আমি এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে দুমুঠো খেয়ে বেঁচে আছি।’
মমতাজ বেগমের জীবন কাহিনী যে কোনো লেখকের উপন্যাসের চরিত্রকেও হার মানাতে পারে। উপন্যাসের চরিত্র নিছক লেখকের কল্পনা কিন্তু মমতাজ বেগম জীবন্ত ও সংগ্রামী একটি চরিত্র।
ঢাকার দোহারের শিলাকুঠা গ্রামের মরহুম মুকসেদ আলীর মেয়ে মমতাজ বেগম। জন্ম হয়েছিল দুর্ভাগ্য নিয়ে। মাত্র আট মাস বয়সে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। বেড়ে ওঠেন নানির কোলে। বিয়ে হয় অল্প বয়সে।
১৯৮৭ সাল, সংসার কী তা বুঝে ওঠার আগেই চাঁদপুরের মতলবের লিয়াকত মোল্লার সঙ্গে মমতাজের বিয়ে হয়। মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ভালো ছিল কিন্তু আমার স্বামী ভালো ছিল না। সে কাজ-কাম করত না শুধু মারধর করত।’
কুয়েতে স্বামী ওসমান, মেয়ে শাহিনা ও ছেলে সাইফুর রহমানের সঙ্গে মমতাজ। ছবি : এনটিভি
স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মমতাজ তাঁর তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন নানির কাছে। পেটে ছিল আরেক সন্তান। চারজনের খাবার জোগাড় করতে নামতে হয় জীবনযুদ্ধে। কথায় আছে, অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। দেশে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে গিয়ে কর্মক্ষেত্রেও অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করতে হয় মমতাজকে।
এরপর ১৯৯৪ সাল। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় জীবিকার তাগিদে কুয়েতে পাড়ি জমান মমতাজ বেগম। কিন্তু সুখের দেখা এখানেও মেলেনি। কুয়েতে একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। সেখানেও অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করতে হয় তাঁকে।
মমতাজ বেগম কান্নার সুরে বলেন, ‘আমি যে বাসায় কাজ নেই সেই বাসা ভালো ছিল না। আমার মামার সাথে দেখা করতে দিত না। দেড় মাস পরে আমাকে তারা কাপড় ইস্ত্রি করতে দেয়। আমি আগে কখনো ইস্ত্রি করিনি। আমি ওই কাপড়টা পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। পরে মালিক এসে ওই গরম ইস্ত্রি দিয়ে আমার হাত পুড়িয়ে দেয়। ওই বাসায় আমি ১০ মাস ছিলাম। পরে মামা আমাকে অন্য বাসায় কাজ দেন। কিন্তু আগের মালিক আমাকে ছাড়েনি। পরে আমি দেশে ফিরে যাই।’
দুই বছর পর দেশে আসেন মমতাজ। আবার শুরু হয় অভাব-অনটন। স্বামীর সংসার, দেশ ও বিদেশে কোথাও যখন তাঁর ঠাঁই হয়নি, তখন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুই সন্তানের কথা ভেবে আত্মহত্যা করা হয়নি।
বিদেশে যাওয়ার সময় ধার করা টাকা ফেরত দিতে এবং সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে আবার কুয়েত পাড়ি জমান মমতাজ। এবার জীবনযুদ্ধের শেষ দেখার প্রত্যয়ে মমতাজ বেগম ছিলেন বদ্ধপরিকর। আবারও বাসায় কাজ নেন। মমতাজ বলেন, ‘এবারকার বাসা একটু ভালো ছিল। আমি ওই বাসায় আট বছর কাজ করি। আট বছর পর আমি রিলিজ নিয়ে টেইলার্সের কাজ নেই।’
তেমন শিক্ষা না থাকলেও ম্যাগাজিন পড়তেন মমতাজ বেগম। খুব দ্রুত আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। সেই ভাষাকে কাজে লাগিয়ে এক বাংলাদেশির বোরখা ও কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ নেন। পরে বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে স্থান পরিবর্তন করে একজন দক্ষ বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কুয়েতে বোরকার দোকানে সহকর্মীর সঙ্গে মমতাজ বেগম (ডানে)। ছবি : এনটিভি
এদিকে আগের চেয়ে কিছুটা সুখে দিন পার করলেও অভাব ছাড়েনি মমতাজের পিছু। ২০০৪ সালে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বাসিন্দা কুয়েত প্রবাসী ওসমানকে বিয়ে করেন তিনি। এবার একটু মিষ্টি হেসে মমতাজ বলেন, ‘আমার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে চিঠির মাধ্যমে পরিচয় হয়। সে থাকত দুবাই। একবার সে মেয়েদের চরিত্র খারাপ বলে পত্রিকায় একটা অ্যাড দেয়। আমি একটু-আটটু ম্যাগাজিন পড়তাম। সেই হিসাবে আমি প্রতিবাদ করে আমার জীবনের কথা লিখে তাকে একটা পত্র দিই। এরপর সে আমার টেলিফোন নম্বর চায়। পরে আমার বাসার মালিকের নম্বর দেই। সেই থেকে মাঝেমধ্যে তার সাথে কথা হতো। পরে আমরা দেশে গিয়ে বিয়ে করি।’
মমতাজের স্বামী ওসমান বলেন, ‘আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছি। এবং সংসার করতেছি। যে দায়িত্ব পালনের দরকার ছিল তা পুরোপুরি পালনে আমার সাথে সাথে সে (মমতাজ) আমাকে সাহায্য করেছে। এবং আমি তাঁর কাছ থেকে প্রচুর সহযোগিতা পেয়েছি।’
ওসমান ও মমতাজের এই সংসারে আছে এক মেয়ে শাহিনা (১০) ও এক ছেলে সাইফুর রহমান (৮)। তারা এখন কুয়েতে অবস্থান করছেন।
এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে মমতাজ বলেন, ‘আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি কিন্তু ততটা না। এখানে বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ অনেক বেশি। আমরা অল্প বেতনে চাকরি করি। ওর বাবাও কোম্পানি থেকে বের হয়ে আসছে, নতুন আকামা লাগাইছে। মেয়েটারে ফাইভে ভর্তি করছি। ছেলেটা ফোরে উঠছে কিন্তু টাকার অভাবে ভর্তি করতে পারছি না।’
অন্যদিকে বাংলাদেশে রয়েছে আগের স্বামীর ঘরের ছেলে মামুন (২৮) ও মাসুদ রানা (২৫)। মামুন কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা করে এখন চাকরির সন্ধানে ঘুরছেন। আর মাসুদ রানা এখনো পড়াশোনা করছেন।
মমতাজের মতো আরো কত প্রবাসী আছেন, যাঁরা অভাব অনটনের মধ্যদিয়ে প্রবাসজীবন অতিবাহিত করছেন। চোখ-লজ্জায় হয়তো প্রকাশ করেন না। কিন্তু তাঁদের কথা শোনার কেউ নেই। তা ছাড়া প্রবাসে সবাই এমনই কর্মব্যস্ততার মধ্যে থাকে, যার কারণে একে অপরের সঙ্গে দেখা করার তেমন সুযোগ পান না। বছরে দু-একটি বড় ছুটি ব্যতীত দেখা হয় না বললেই চলে। মমতাজের মতো অনেক নারী জীবনযুদ্ধে নানা অন্যায়-অত্যাচার আর অভাবকে হার মানিয়ে এই ভুবনে বেঁচে থাকার একটি জীবন্ত প্রতীক হয়ে আছে।