লাগামহীন সেন্ট্রাল ফার্মার শেয়ার দর, কারসাজির অভিযোগ
লোকসানে পড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ‘বি’ ক্যাটাগরির কোম্পানি সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের (সেন্ট্রাল ফার্মা) শেয়ার দর লাগামহীনভাবে বাড়ছে। মাত্র ১৮ কর্মদিবসে ‘বি’ ক্যাটাগরি এই কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৭১ শতাংশ। শেয়ার কারসাজি করে এই দর বাড়ানো হয়েছে বলে ওঠেছে অভিযোগ। এ কারণে কোম্পানিটির শেয়ার ধারণ করা বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যা এই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সুখবর নয় বলে জানিয়েছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। যদিও এই কোম্পানির শেয়ার দর কেন বাড়ছে, তার প্রকৃত কারণ জানে না সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, গত ১৮ কর্মদিবসে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের মোট শেয়ারের মাধ্যমে বাজারমূল্যে বেড়েছে ১১০ কোটি ২১ লাখ টাকা। অপরদিকে, এই সময়ে ধারণ করা বিনিয়োগকারীদের (সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক) শেয়ারের মাধ্যমে বাজারমূল্যে বেড়েছে ৮১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ৭৪ দশমিক ১১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেছে।
শেয়ার দর বৃদ্ধির প্রসঙ্গে মুঠোফোনে জানতে চাইলে কোম্পানির সচিব তাজুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘শেয়ার দর বাড়ার কারণ আমাদের জানা নেই। দর বাড়ার মতো কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আমাদের কাছে নেই।’ বিক্রয় কমেছে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটি লোকসান গুনছে। এ ছাড়া লোকসান থাকায় গত কয়েক সমাপ্ত অর্থবছর ধরে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডররা লভ্যাংশ পাচ্ছে না।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৩ নভেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১২ টাকা ৯০ টাকা। গত বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) কোম্পানির শেয়ার দর দাঁড়ায় ২২ টাকা ১০ পয়সা। গত ১৮ কর্মদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৯ টাকা ২০ পয়সা বা ৭১ দশমিক ৩২ শতাংশ। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৪৪টি। গত ১৩ নভেম্বর মোট শেয়ারের বাজারমূল্যে ছিল ১৫৪ কোটি ৫৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৮৭ টাকা। গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজারমূল্যে হয়েছে ২৬৪ কোটি ৭৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫২ টাকা। এই সময়ের ব্যবধানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজারমূল্যে বেড়েছে ১১০ কোটি ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৬৪ টাকা।
সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের মোট শেয়ারের মধ্যে ৬২ দশমিক ২৮ শতাংশ ধারন করেছে সাধারন বিনিয়োগকারী। আর ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ ধারণ করেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। সেই হিসেবে তাদের (সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী) শেয়ারের বাজারমূল্যে বেড়েছে ৮১ কোটি ৬৮ লাখ ১৬ হাজার ৫২৯ টাকা। লাগামহীনভাবে কোম্পানিটির শেয়ার দর বাড়ার কারণ জানান জন্য রেগুলেটরদের (বিএসইসি) দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।
ইতোমধ্যে শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। তার বলছেন, অনেকদিন ধরে একটি চক্র কারসাজি করে কোম্পানির শেয়ার দর বাড়িয়েছে। গত ৮ নভেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১৩ টাকা ৫০ পয়সা। গত বুধবার এসে দাড়ায় ২২ টাকা ৩০ পয়সা। এক মাসের ব্যবধানে শেয়ারটির দর ৬৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। এদিকে, কোম্পানিটির শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে কোম্পানিটিকে গত বুধবার ডিএসই নোটিস পাঠিয়েছিল। এর জবাবে কোম্পানিটি জানায়, কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই শেয়ার দর বাড়ছে।
শেয়ার দর বাড়ার বিযয়টি খতিয়ে দেখছি জানিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ার দর বাড়ার পেছনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না তা দেখছে কমিশন ‘ তিনি আরও বলেন, ‘শেয়ারটির দর বাড়ানো ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া গেলে কোম্পানির বা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই বাছায়ে বেরিয়ে আসে, চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে পাঁচ পয়সা। আগের ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল আট পয়সা। চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হয়েছে শূন্য। আগের সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ার প্রতি নগদ প্রবাহ ছিল শূন্য। গত ৩০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৫৪ পয়সা।
গত ২০২২-২০২৩ সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটি লভ্যাংশ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আলোচিত সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৩৭ পয়সা। আগের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৫৭ পয়সা। সর্বশেষ সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ার প্রতি নগদ প্রবাহ হয়েছে শূন্য। আগের সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ার প্রতি নগদ প্রবাহ হয়েছে নেগেটিভ এক পয়সা। গত ৩০ জুন কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৫৯ পয়সা। আগের অর্থবছরে শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য ছিল পাঁচ টাকা ৯৬ পয়সা।
আলোচিত সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির ঘোষিত শূন্য লভ্যাংশ রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা ছিল গত ২৩ নভেম্বর। এ সংক্রান্ত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) হবে আগামী ২৮ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায়। কোম্পানিটি আগের ২০২১-২০২২ সমাপ্ত অর্থবছরে লোকসান কারনে লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এরও আগের দুই সমাপ্ত অর্থবছরে লোকসান গুনেছিল কোম্পানিটি। ফলে ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১ সমাপ্ত অর্থবছরেও লভ্যাংশ দিতে পারেনি কোম্পানিটি। তবে, আগের অর্থবছরগুলোতে কোম্পানিটির লভ্যাংশ পেয়েছিল শেয়ারহোল্ডররা।
২০১৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ১১৯ কোটি ৮০ লাখ ১০ হাজার টাকা। রিজার্ভে রয়েছে নেগেটিভ ৪৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক ২৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক পরিচালক ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৬২ দশমিক ২৮ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেছে।