ক্রিকেট
বিনোদনের বাহারি দোকানে বিশাল ছাড়
ক্রিকেটে টেস্ট হলো আভিজাত্যে মোড়ানো ধ্রুপদি বিনোদন, ওয়ানডে হলো আভিজাত্যের মোড়কে খোলা বিনোদন আর টি-টোয়েন্টি হলো আভিজাত্য বিসর্জন দেওয়া বিনোদন।
ক্রিকেট নামক বিনোদনের বাহারি দোকানে তিনটা ব্র্যান্ডই সহজলভ্য। আপনি আপনার সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে পারেন। এখন দোকানে যাওয়ার দরকার পড়ে না। হোম ডেলিভারি নামে একটা সিস্টেম তো আছেই। আপনার চাহিদামতো পছন্দের জিনিসটা ঘরেই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পেমেন্ট সেটাও অনলাইনে কিংবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করতে পারেন। ক্রিকেটীয় বিনোদনের বিপণনও তাই। বিনোদন ঘরে বসে পেতে পারেন। চলতে চলতে পেতে পারেন। মাঠের খবর আপনার হাতের মুঠোয়। সৌজন্যে মোবাইল ফোন।
এবং যে যে ধরনের বিনোদন চাইছেন, তিনি সেটাই পাচ্ছেন। একদিনে টেস্ট। ওয়ানডে। টি-টোয়েন্টি। সব ক্রিকেটই আপনি দেখতে পাচ্ছেন। শুধু কষ্ট করে নিজের পছন্দেরটা বেছে নিতে হচ্ছে। তার জন্য মাঠে যাওয়ার দরকার পড়ছে না। হয় টেলিভিশন, না হয় মোবাইলে আপনি দেখতে পাচ্ছেন। শুনতে পাচ্ছেন। এমনকি অনলাইনে বল বাই বল বর্ণনা পড়তে পারছেন। স্যাটেলাইটের সৌজন্যে আপনার জন্য আকাশ উন্মুক্ত। সাবমেরিন কেবলের কারণে সাগরের তলদেশে তথ্যের অবাধপ্রবাহ। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি গোটা পৃথিবীকে পুঁচকে বানিয়ে ফেলেছে। ক্রিকেট গ্রহটাকে আপনার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। হাতের রিমোটে কিংবা মোবাইলে ‘বৃদ্ধাঙ্গুল সংস্কৃতি’-তে আপনি খুঁজে নিতে পারছেন তরতাজা ক্রিকেটীয় উত্তেজনা, উন্মাদনা। অতিমানবীয় সব কাণ্ডে ঘটে যাওয়া রুদ্ধশ্বাস ঘটনার ভার্চুয়াল সাক্ষী বনে যাচ্ছেন!
তারপরও কিছু মানুষ আওয়াজ তুলছেন, ‘গেল! গেল!’ বলে। ক্রিকেটের পরিশুদ্ধ রূপ চলে গেল। টেস্ট ক্রিকেট মরে গেল। ওটাকে বাঁচাতে হবে। বাঁচানোর উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে। টেস্ট ক্রিকেটের শ্বেতশুভ্র পোশাকটা ঠিক রাখা হচ্ছে। লাল বলটা রং পাল্টে হতে যাচ্ছে গোলাপি। হতে যাচ্ছে বলছি কেন! খানিকটা হয়েই গেছে। রাতের আলোয় টেস্ট তো শুরু হয়ে গেছে।
তাহলে কি টি-টোয়েন্টির হাত ধরে টেস্ট ক্রিকেটের শ্মশানযাত্রা শুরু হওয়ার প্রস্তুতি চলছে! ডে-নাইট টেস্ট। আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে। অ্যাডিলেড থেকে আবুধাবি। গোটা তিনেক টেস্ট হয়েও গেছে। তিনটা টেস্টেরই রেজাল্ট হয়েছে। দর্শকও হয়েছে। তাহলে দিন-রাতের ম্যাচই কি টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ?
উত্তর তো সময় বলে দেবে। তবে একটা কথা আগাম বলা যায়। সময় পাল্টায়। পৃথিবী বদলায়। ক্রিকেট দুনিয়াও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পাল্টেছে। সেটা শুধু টেস্টের পর ওয়ানডে কিংবা ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টি দিয়ে নয়। টেস্ট ক্রিকেটই কতবার কত রকমভাবে পাল্টে গেছে। এবং বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে বেঁচে আছে। খুব খারাপভাবে বেঁচে আছে তাই বা বলছি কেন! এখনো বক্সিং ডে টেস্টে এমসিসির গ্যালারি ভরে যায়। ভালো একটা কাভার ড্রাইভ দেখলে লর্ডসে মৃদু হাততালি দেওয়ার জন্য প্রচুর লোক দেখা যায়। এখনো অ্যাশেজ সিরিজ নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হচ্ছে। রেডিও-টেলিভিশনে অ্যাশেজের উত্তেজনা দাউদাউ করে ছড়িয়ে পড়ে। তবু কেন বলছি টেস্ট ক্রিকেট মরে যাচ্ছে!
হ্যাঁ, টেস্ট থেকে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। টাইমলেস টেস্ট। আট বলে ওভার। এসব অনেক আগেই ক্রিকেটীয় জাদুঘরে জায়গা পেয়েছে। ওয়ানডে জমানা শুরুর দুই দশক পর ‘রেস্ট ডে’ শব্দটাও হারিয়ে গেছে টেস্ট ক্রিকেট থেকে। এখন মনে হয়, শুধু রেস্ট ডে নয়। আরো অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। এবং যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে টেস্টের সোনালি সকাল। মধ্য দুপুর। হারিয়ে যাচ্ছে লাঞ্চ ব্রেক! কিন্তু তাতে কী? যোগ হচ্ছে ডিনার ব্রেক। ডে-নাইট টেস্টে ডিনার ব্রেক চালু হয়েছে। কিন্তু তারপরও কি গেল গেল রবটা থামছে?
না। থামছে না। তার কারণ, মাঠে দর্শকখরা বাড়ছে। কেন দর্শক কমছে, তার কি একটাই উত্তর—টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট! পুরোপুরি একমত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ বহুবিধ। তার মধ্যেও বড় একটা কারণ, তারকাদের ব্যক্তি লড়াই। নস্টালজিয়া মনে হলেও বলতে হবে; ক্রিকেট গ্রহ থেকে নক্ষত্রেরও পতন ঘটেছে। তারকা খসে পড়েছে। তারকাদের সেই লড়াইটাও উধাও হয়ে গেছে। ব্র্যাডম্যান-লারউড যুগের কথা বাদ দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ক্রিকেট কত তারকা লড়াই দেখেছে! গত সহস্রাব্দের শেষ তিনটা দশকের দিকে চোখ রাখলেও দেখা যাবে প্রায় প্রতিটি টেস্টেই তারায় তারায় রুদ্ধশ্বাস কত লড়াই। যেটা দেখার জন্য গ্যালারি উপচে পড়ছে দর্শক। ব্যাটে-বলের লড়াইয়ের মধ্যে তারকাদের লড়াই। টেস্ট ক্রিকেটকে দিয়েছিল অন্য রকম এক মাত্রা। গাভাস্কার-ইমরান, ভিভ- থমসন, বয়কট-লিলি, বর্ডার-বোথাম, মিয়াঁদাদ-কপিল, চ্যাপেল-হ্যাডলি কিংবা তার পরবর্তী জমনায় লারা-ম্যাকগ্রা, শচীন-ওয়ার্ন, পন্টিং-আকরাম, স্টিভ-অ্যামব্রোস, তারকা যুদ্ধের কত অধ্যায়। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস বাড়ছে। কিন্তু সেই তারকা যুদ্ধের নতুন কোনো অধ্যায় কি লেখা হচ্ছে?
অ্যালিস্টার কুক-জো রুট-বিরাট কোহলি-স্টিভ স্মিথ-এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো তারকা ব্যাটসম্যান আছেন। ডেল স্টেইন-মিচেল স্টার্কের মতো ফাস্ট বোলার আছেন। কিন্তু নেই সেই ব্যক্তিগত লড়াইটা! না থাকার হয়তো বড় একটা কারণ, এখন হয়তো সবাই পেশাদারি শর্ত পূরণের দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন। খেলাটার মধ্যে থেকে মনের আনন্দ খুঁজে নেওয়া খানিকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। আর টি-টোয়েন্টি নামক খেলাটায় দর্শককে বেশি বিনোদন দিতে গিয়ে নিজের মনের ফুর্তিটা হারিয়ে ফেলছেন। টি-টোয়েন্টি নিজেই এখন বিনোদনের সুপারহিট বক্স-অফিস। তারপর আর দর্শক দ্বৈরথের বক্স-অফিস খুঁজতেই বা যাবে কেন! তা ছাড়া টি-টোয়েন্টি সে তো শুধু আর বিনোদন নেই। বিনোদন ছাপিয়ে বাণিজ্য। এবং সেটা সওদাগরদের হাতে চলে যাওয়া বাণিজ্য। যেখানে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা খুব একটা না ভাবলেও চলে। পারফরম্যান্সটা দর্শক আর সওদাগরদের জন্য বেশি করতে হয়। আর দর্শকও সেখানে এক টিকেটে দুই ম্যাচ দেখছেন। তাঁদেরও মনে হবে, ক্রিকেটের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে একটা বিশাল ছাড় চলছে। একটা কিনলে একটা ফ্রি!
কিন্তু টেস্ট? সেখানে ক্রিকেটের সম্ভ্রান্তমহলকে খুশি করতে হয় নিজের টেকনিক, টেম্পারমেন্ট, পারফরম্যান্স দিয়ে। সঙ্গে দর্শকের কথা ভাবতেই হচ্ছে। এই যুগ্ম প্রকল্প মাথায় নিয়ে ক্রিকেট খেলার ইচ্ছাই বা কজনের মনে থাকছে! দর্শককে বিনোদন দিয়ে নিজের ক্রিকেটীয় গরিমা, বীরত্বের কাহিনী সমৃদ্ধ করার একটা সহজ রাস্তা তো খোলা আছেই, যার নাম টি-টোয়েন্টি। সেখানে ক্রিকেটীয় আভিজাত্য বিসর্জন দিলেই বা কী! বক্স-অফিস হিট এন্টারটেইনার হিসেবে ক্রিকেটারদের নতুন পরিচিতি তো প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে! বিস্ফারিত চোখে না হয় সেটা শুধু দেখে যাবেন ক্রিকেটশাস্ত্রজ্ঞরা।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি