চিকিৎসাক্ষেত্রে নীরব বিপ্লবের পথে এআই!
সায়েন্স ফিকশনের গল্পে আগে কতো কিছু শোনা যেত। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে জীবন বাঁচিয়ে দিত প্রযুক্তি। নির্ণয় করত রোগ, তৈরি করত ওষুধ। চিকিৎসা পরিকল্পনায় এমন সব গল্পে মানুষ বিষ্মিত হত। এখন সেই বিষ্ময় যেন বাস্তবেও চলে এসেছে। ওষুধ আবিষ্কার থেকে শুরু করে রোগীদের দৈনন্দিন সেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ভূমিকা বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। এই বিস্তার চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চলেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
এআই নির্ভর রোগ বিশ্লেষণ
আপনাদের কি মনে আছে, অতীতে ডাক্তাররা কিছু সাধারণ উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করতেন। এরপর এলো বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ক যন্ত্র, যা রোগ সনাক্তকরণে ব্যবহৃত হলেও প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে অনেক সময় লেগে যেত। কিন্তু এখন, এআইভিত্তিক প্রযুক্তি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অগণিত ডেটা বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, রেডিওলজির ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি এমআরআই এবং এক্স-রে স্ক্যান থেকে এমন সূক্ষ্ম অসঙ্গতি খুঁজে বের করছে যা খালি চোখে দেখা অসম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, স্তন ক্যানসার শনাক্তকরণে এআইয়ের ব্যবহার রেডিওলজিস্টদের চেয়ে ৯৯ ভাগ বেশি নির্ভুল। এটি শুধু রোগ নির্ণয়ের সময় কমিয়ে দেয়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে রোগ শনাক্ত করার হারও বাড়িয়েছে।
চিকিৎসা পরিকল্পনায় এআই
একজন রোগীর জন্য সঠিক চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করা চিকিৎসকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। কারণ প্রতিটি রোগীর শারীরিক অবস্থা, জিনগত গঠন এবং জীবনযাপনের ধরন ভিন্ন। এআই ঠিক এই জায়গাতেই চমক দেখাচ্ছে।
এআই প্রযুক্তি রোগীর ইতিহাস এবং রিয়েল-টাইম ডেটা বিশ্লেষণ করে ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করতে সক্ষম। গুগল হেলথ এবং অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এমন প্রযুক্তি তৈরি করেছে যা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এমনকি ক্যানসারের চিকিৎসায় চিকিৎসকদের দারুণভাবে সহায়তা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এআই-চালিত অ্যাপ্লিকেশন তাদের ইনসুলিন ডোজ নির্ধারণ করে দিচ্ছে, যা চিকিৎসার কার্যকারিতা বাড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব অ্যাপ্লিকেশন রোগীদের খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়াম সম্পর্কেও পরামর্শ দেয়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে আরও সুস্থ করে তুলছে।
এআই চালিত গবেষণায় ওষুধ আবিষ্কারের গতি বেড়েছে
একটি কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার করতে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। তবে এআই এই প্রক্রিয়াকে নাটকীয়ভাবে ত্বরান্বিত করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন অ্যালগরিদম তৈরি করেছে, যা হাজার হাজার রাসায়নিক যৌগ বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য ওষুধের প্রোটোটাইপ (এটি একটি শিল্পকর্ম যা একটি ডিজাইন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে এবং উত্তর দিতে ব্যবহৃত হয়) তৈরি করতে সক্ষম।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, একদল গবেষক এআই ব্যবহার করে একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছেন, যা বহু শক্তিশালী জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এর আগে গবেষণা পদ্ধতিতে এমন সাফল্য অর্জন করতে কয়েক দশক লেগে যেত।
রোগীর যত্নে এআই
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) স্বাস্থ্যসেবায় রোগীদের পরিচর্যায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। হাসপাতালগুলোতে রোবোটিক সহকারীরা রোগীদের খাবার পরিবেশন, ওষুধ বিতরণ এবং জরুরি পরিস্থিতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করছে। এ ছাড়া, এআই-চালিত চ্যাটবট ও ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট রোগীদের প্রাথমিক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চিকিৎসকদের ওপর চাপ কমাচ্ছে।
যেমন: জাপানের কিছু হাসপাতালে রোবোটিক নার্স রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাদের খাবার পরিবেশন করে এবং প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে। এ ছাড়া ‘বাবিলন হেলথ’ এর মতো এআই-চালিত চ্যাটবট রোগীদের লক্ষণ বিশ্লেষণ করে প্রাথমিক চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান করে, যা চিকিৎসকদের ওপর অনেক চাপ কমায়। করোনা মহামারির সময়, ‘কোভিড-১৯ চ্যাটবট’ গুলো লাখ লাখ মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাদের উদ্বেগ কমিয়েছে এবং সঠিক চিকিৎসার পথে পরিচালিত করেছে।
স্বাস্থ্যসেবায় এআইয়ের সম্ভাবনা ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ
এআইয়ের বিস্ময়কর সম্ভাবনার মাঝেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছে। রোগীর তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা, এআই-ভিত্তিক সিস্টেমগুলোর নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ভুল সিদ্ধান্ত রোধে সঠিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। ব্রিটেনের গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআই পরিচালনায় মানুষের অংশগ্রহণ এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হলে এটি স্বাস্থ্যসেবায় আরও বিস্তৃত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
সবশেষে যদি বলি, এআই শুধু একটি প্রযুক্তি নয়, এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নীরব বিপ্লব। এটি কেবল আমাদের জীবনের মানোন্নয়ন করছে না, বরং চিকিৎসকদের নতুন দিগন্তে নিয়ে যাচ্ছে। তবুও, এআইয়ের ক্ষমতাকে মানুষের মঙ্গলার্থে সঠিকভাবে ব্যবহার করার দায়িত্ব আমাদেরই। যে যুগে এআয়ের সাহায্যে চিকিৎসা আরও সহজ, দ্রুত এবং সাশ্রয়ী হয়েছে, সে যুগে আমরা হয়তো দেখতে পাব এমন এক দিন, যখন রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা হবে পুরোপুরি এআই প্রযুক্তি-চালিত।