মিয়ানমার ভূখণ্ডে হামলা করে বার্তা দিল ভারত
ভারতের শান্তি নিশ্চিত করতে, দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার প্রতি যেকোনো হুমকি কঠোর জবাবে মোকাবিলা করবে দেশটির সেনাবাহিনী। এ জন্য কোনো মানচিত্রের সীমরেখাকেও বাধা হিসেবে নেবে না ভারত। ভারতের গণমাধ্যমগুলো বলছে, গতকাল মঙ্গলবার মিয়ানমারের সীমান্তে ঢুকে ভারতীয় ‘বিদ্রোহীদের আস্তানায়’ হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে এমন বার্তাই দিয়েছে দেশটি।
পাঁচ দিন আগে মনিপুর রাজ্যে বিদ্রোহীদের হামলায় ভারতের ১৮ সেনা সদস্য নিহত হন। এনডিটিভি জানিয়েছে, এরই প্রতিক্রিয়ায় গতকাল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মনিপুর রাজ্যের সীমান্তবর্তী মিয়ানমার ভূখণ্ডে অভিযান চালায় ভারতের সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল। এতে অন্তত ৫০ বিদ্রোহী নিহত হয়। তবে যে দুটি আস্তানায় হামলা চালানো হয়েছে সেখানে অন্তত ১৫০ জন বিদ্রোহী ছিল। সে হিসেবে নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আর এ কারণেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় তার সঙ্গে আসেননি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। নরেন্দ্র মোদি সেনা সদস্যদের ওপর হওয়া ওই হামলার ‘দ্রুত প্রতিক্রিয়া’ দেখানোর স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এমনকি সফর চলাকালেও এ বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর করেছিলেন মোদি। এ বিষয়কে ভারতের নিরাপত্তা নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বলে মনে করা হচ্ছে।
এনডিটিভি বলছে, এই হামলা শুধু ভারতের রাজ্যগুলোর শক্তিকে জাহির করা নয়। বরং এই হামলার মধ্য দিয়ে চীনকেও একটা শক্ত বার্তা দেওয়া হলো। কারণ ভারতের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, দেশটির উত্তর-পূর্ব দিকের বেশকিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মদদ দিচ্ছে চীন। কিছুদিন আগেই তারা জানতে পেরেছে যে, উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া চীনের ইউনান প্রদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চেয়েছিলেন।
মিয়ারমারে চালানো আন্তসীমান্ত অভিযানটি অন্যান্য সীমান্তের ক্ষেত্রেও মানদণ্ড হয়ে যাবে কি না, সে সম্পর্কে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ভিপি মালিক এনডিটিভিকে বলেন, ‘আমি মনে করি না, এই উদ্দেশ্যের জন্য আমরা আমাদের সন্ত্রাসবাদবিরোধী ব্যবস্থাগুলো বদলাতে যাচ্ছি। সন্ত্রাসবাদবিরোধী বিষয়টা অনেক বিস্তৃত এবং এ ধরনের পদক্ষেপের প্রতি সায় তাতে আছে। শুধু একটি বিষয়ই আপনাকে করতে হবে, তা হলো যখন আপনি সীমান্ত পার করবেন, তখন আপনাকে পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানাতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। তাই আমি মনে করি না, ভারতের সেনাবাহিনীর কৌশলগত অবস্থান পাল্টানোর প্রয়োজন আছে।’ ভিপি মালিক আরো বলেন, ‘আমার মনে হয় না, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবে। তবে হ্যাঁ, এটা প্রমাণ করে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী এখন যখন যেমন প্রয়োজন তেমন দ্রুত ও শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে।’
‘এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে যে, আমরা কী ধরনের পদক্ষেপ নেব। এখানে পরিস্থিতি আমাদের উপযুক্ত ছিল, তাই ভারতীয় সেনাবাহিনী এই পদক্ষেপ নিয়েছে,’ যোগ করেন ভিপি মালিক।
মিয়ানমারে অভিযানের ব্যাপারে একটি বিবৃতিও দিয়েছে ভারতের সেনাবাহিনী। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান মুখপাত্র সিতাংশু কর তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এই বার্তা প্রচার করেন। বিবৃতিতে ভারতের সেনাবাহিনী বলছে, ‘আপনারা সবাই জানেন গত ৪ জুন মনিপুরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমরা এখন উচ্চমাত্রার সতর্কাবস্থায় আছি। গত কিছুদিনে পাওয়া বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, শিগগিরই ভারতের সীমার ভেতরে আবারও হামলার পরিকল্পনা করছে তারা। কিছুদিন আগে যারা আমাদের নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর হামলা করেছিল, তারাই এসব হামলার পরিকল্পনা করছে বলে আমরা জানতে পারি।’
‘আশু এই হুমকির মুখে একটি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল। গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিই। আজ (মঙ্গলবার) সকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুটি আলাদা দল ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাগাল্যান্ড ও মনিপুর সীমান্তের দুটি আলাদা স্থানে অভিযান চালায়। এতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। এর ফলে আমাদের সাধারণ জনগণ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর থাকা হুমকিকে প্রতিহত করা গেল।’
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ‘এই বিষয়ে আমরা মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। এটা দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে নিবিড় যোগাযোগের ইতিহাস। এ রকম সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানে ভবিষ্যতেও এই দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে।’
সেই সঙ্গে ভারতের জন্য সব ধরনের হুমকিদাতাদের সতর্ক করে দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সীমান্ত ও সীমান্ত রাজ্যগুলোতে শান্তি ও স্থিতাবস্থা নিশ্চিত করতে; আমাদের নিরাপত্তা ও জাতীয় অখণ্ডতার স্বার্থের প্রতি যেকোনো হুমকি কঠোর জবাবই পাবে।’
অত্যন্ত গোপন এই অভিযানে ভারতের সেনাসদস্যরা আকাশপথে যায় এবং বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালায়। মিয়ানমারের ভেতরে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে এ অভিযান চলে। যদিও ভারতের সেনাবাহিনী প্রথমে এই হামলার কথা স্বীকার করেনি।
মনিপুরে সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমারে চলে যাওয়া বিদ্রোহীদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দি ইকোনোমিক টাইমস জানিয়েছে, অভিযান শেষ হওয়ার পর মিয়ানমারকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়েছিল।
মিয়ানমারের সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করে এই হামলার ঘটনা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য একট বার্তা কি না তা জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলাওয়ার হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না, এর সঙ্গে বাংলাদেশকে রিলেট করা ঠিক হবে। কারণ কোনো একটা ঘটনা দিয়ে একটি দেশের আচরণকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা আসলে মিয়ানমারের বিষয়। এখানে নিশ্চয়ই ইন্টিলিজেন্স রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই যা করার করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
ভারতীয় সেনাবাহিনীর বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, তাদের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর ওপর কোনো হামলা হলে তা ভারতের অখণ্ডতার ওপর হুমকি মনে হলে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে ভারত। উলফাসহ বেশকিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সদস্য বাংলাদেশের ভেতরে লুকিয়ে অবস্থান করে বলে ভারত অভিযোগ করেছিল। সে হিসেবে কোনোভাবে বাংলাদেশও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে কি না তা জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বর্ডার ক্রস করার যে ব্যাপারগুলো সেগুলোতে আমি আশা করি যে, যেকোনো ঘটনাই ঘটুক না কেন তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো যেন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়।আলোচনার খাতিরে ধরেই নিচ্ছি যে, মিয়ানমারে থাকা বিদ্রোহীরাই হামলা চালিয়েছে। কিন্তু তারপরও, বর্ডার ক্রস করে হামলা করাকে আই ডু নট সাপোর্ট।’
ভারতের গণমাধ্যমগুলো বলছে, এই ঘটনা প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য এক ধরনের বার্তা। এ প্রসঙ্গে শান্তনু মজুমদার বলেন, “বাংলাদেশের ব্যাপারে আমি ‘হুমকি’ শব্দটি বলতে চাই না। তবে প্রত্যেক প্রতিবেশীরই বিষয়টা মাথায় নেওয়ার ব্যাপার আছে। এটা খুবই ট্রিকি (কৌশলী) ব্যাপার। সার্বভৌম ক্ষমতাকে ব্যাখা করার যে কনসেপ্ট সেটা সবখানে কাজ করে বলে মনে হয় না।”
‘আবারও বলি, প্রতিবেশীদের মধ্যে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই ঘটুক না কেন, তার পাল্টা জবাব দেওয়ার আগে পারস্পরিক আলোচনা করে নেওয়া দরকার। সেটা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত হোক, পাকিস্তানের সঙ্গে হোক, আর ভুটান বা নেপালের সঙ্গে হোক,’ যোগ করেন শান্তনু মজুমদার।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান ড. আশেকা ইরশাদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কোনো সমস্যা থাকলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা হয়। কোনো রকম পূর্বানুমতি ছাড়া তো সীমান্ত অতিক্রম করা যায় না। এ রকম যদি ঘটে থাকে তাহলে ভারতের ব্যাপারে সবারই সজাগ থাকা দরকার।’