এক ঘণ্টা অচেনা মানুষের রক্তে শুয়েছিলাম
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বাতাক্লাঁ কনসার্ট হলে সন্ত্রাসী হামলার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন ২২ বছর বয়সী এক তরুণী। মৃতদেহগুলোর নিচে তিনি এক ঘণ্টা লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন। তাঁর এ বেঁচে যাওয়ার গল্প তিনি বলেছেন ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। রোববার পর্যন্ত এটি ছয় লাখ বার শেয়ার হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। পোস্টটির সঙ্গে রক্তের দাগমাখা একটি টি-শার্টের ছবিও পোস্ট করেন, যেটি তিনি নিজেই পরেছিলেন হামলার সময়।
দক্ষিণ আফ্রিকার ওই তরুণীর নাম ইসোবেল বাউডেরি। ফেসবুকে তিনি বলেন, 'এটা কেবল সন্ত্রাসী হামলা নয়, এটা ছিল হত্যাযজ্ঞ।' সম্প্রতি কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করা তরুণীর ভাষায়, ‘আমার সামনে বহু মানুষকে গুলি করা হলো। মেঝেতে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। নারী বন্ধুদের মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে থাকা পূর্ণ বয়স্ক পুরুষদের কান্না ছোট মিউজিক ভেন্যুটাকে বিদ্ধ করল। মুহূর্তেই ভবিষ্যৎ গুঁড়িয়ে গেছে, সব পরিবারের হৃদয় ভেঙে গেছে। কঠিন অভিঘাত পেয়ে একা আমি এক ঘণ্টা ধরে নিজে মৃত হওয়ার ভান করেছি।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বহু বছর ধরে এডিথ পিয়াফ, নিক কেভ ও লু রিডের মতো তারকাদের আমন্ত্রণ জানানো বাতাক্লাঁ ১৫ মিনিটের মধ্যেই কসাইখানা হয়ে যায়।
বাউডেরি বলছেন, গুলির শব্দ না শোনা পর্যন্ত বোঝাই যায়নি, কী ঘটতে যাচ্ছে। আমেরিকার রক ব্যান্ড ‘ঈগলস অব ডেথ’ মঞ্চে এক ঘণ্টা ছিল। হঠাৎ দর্শকের পেছন থেকে গোলাগুলি শুরু হয়। সংগীতের উচ্চ স্বর ও দর্শকের উত্তেজনায় গুলির শব্দ প্রথমে খেয়াল করেনি কেউ অথবা ভুল ভেবেছিল সবাই।
বাউডেরি তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে রাখার চেষ্টার কথা বলেছেন। নিশ্চল থাকা ও কান্না না করার চেষ্টা করেছেন, যাতে হামলাকারীরা টের না পায়। তিনি বলেন, ‘বন্দুকধারীরা মানুষের আশপাশে ঘুরছিল শকুনের মতো, এই দৃশ্য তাঁকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’
দক্ষিণ আফ্রিকার ওই তরুণী বলেন, ‘অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তারা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি করছিল। আমি জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে এর মধ্যেই ছিলাম। এটা বাস্তব মনে হচ্ছিল না। আমি ভাবছিলাম, কেউ হয়তো বলবে এটা দুঃস্বপ্ন।’
তরুণী বলেন, ‘যে লোকটা আমাকে অভয় দিয়েছেন এবং চেষ্টা করেছেন নিজের জীবন বাঁচাতে। একই সময় তিনি আমার মস্তিষ্ককে ঢেকে রেখেছিলেন তাঁর প্রতি; ভালোবাসার শেষ কথা বলা ওই দম্পতির প্রতি, যাঁদের কারণে পৃথিবীর মঙ্গলে আমার বিশ্বাস জন্মে; যে পুলিশ সদস্যরা শত শত মানুষকে উদ্ধার করেছে তাদের প্রতি; সম্পূর্ণ অচেনা যে লোকটা আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ৪৫ মিনিট ধরে বোঝাল, যে ছেলেটাকে আমি ভালোবাসতাম সে এখন মৃত সেই লোকের প্রতি; যে আহত লোকটাকে আমি ভুল করে ওকে ভেবেছিলাম এবং তারপর বুঝলাম সে আমুরি নয়, সে ভীষণ একা ও ভয় পাওয়ার পরও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল যে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে; যে নারী বেঁচে যাওয়া মানুষের জন্য দরজা খুলে দিল তাঁর প্রতি, যে বন্ধু আমাকে আশ্রয় দিল এবং আমার জন্য নতুন পোশাক কিনতে গেল, যাতে আমাকে রক্তমাখা শার্ট পরতে না হয় তার প্রতি; আপনাদের সবার প্রতি, যাঁরা সমর্থন জুগিয়েছেন, যাঁদের কারণে পৃথিবীটা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে, তাঁদের প্রতি বলছি—এটা যেন আবারো না ঘটে।’
বহু প্রাণহানিতে আর্তনাদ করে বাউডেরি বলছেন, নিহতদের শেষ নিশ্বাসের কথা বলতে পারার কারণ হচ্ছে তিনি বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন (বেঁচে থেকে)।
ওই তরুণী আরো বলেন, ‘অচেনা মানুষের রক্তের মধ্যে আমি শুয়েছিলাম এবং অপেক্ষা করছিলাম একটি বুলেট এসে আমার ২২ বছর বয়সী জীবনটাকে শেষ করে দেবে। ঠিক সে মুহূর্তে আমি যাঁদের ভালোবাসি, তাঁদের প্রতিটা মুখ কল্পনা করছিলাম আর বলছিলাম, আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। ফিসফিস করছিলাম, আমি ভালোবাসি, বারবার বারবার।’
পোস্টের নিচে শত শত মানুষ মন্তব্য করেছেন। সবাইকে আন্দোলিত করেছে বাউডেরির লেখা। মালিন্দি প্রাইস নামের একজন লিখেছেন, ‘খুব সুন্দর কথা ও চিন্তা। তোমার ব্যথা আমার এবং আমাদের সবার।’