বাংলাপ্রেমী এক পোলিশ তরুণীর কথা
সান্দ্রা মালগ্রাব। বয়স ২২ বছর। জন্ম, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া সবই হয়েছে ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে। বাংলাদেশ বা বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁর বা তাঁর পরিবারের ছিল না কোনো ধরনের সম্পর্ক। সেই সান্দ্রা এখন বাংলায় কথা বলেন। এমনকি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিতেও বাংলায় লেখা তাঁর নাম। এমনই বাংলার প্রতি ভালোবাসা সান্দ্রার।urgentPhoto
প্রায় কিশোরবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি সান্দ্রা জড়িয়ে পড়েন মডেলিংয়ে। নাম লেখান পেশাদার মডেল হিসেবে। বিভিন্ন নামকরা ফ্যাশন হাউসের সঙ্গে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি হেঁটেছেন র্যাম্পে। সেই তরুণী এখন ওয়ারশ ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর স্নাতক ডিগ্রির জন্য পড়ছেন।
সান্দ্রার মা অধ্যাপক সাবিনা মালগ্রাব, বাবা প্রকৌশলী মারেক মালগ্রাব। সান্দ্রা জানান, চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। নিজের ব্যাপারে সান্দ্রা সব সময়ই ছিলেন স্বাধীন। লেখাপড়া নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তকেই সব সময় শ্রদ্ধা করে এসেছেন তাঁর বাবা-মা।
মডেলিংয়ের সঙ্গে জড়িত পোলিশ এই তরুণীর বরাবরই আগ্রহ ছিল প্রাচ্যকে জানার। পোল্যান্ডের ফ্যাশন ডিজাইনারদের অনেকেই তখন বাংলাদেশের কাপড় নিয়ে কাজ করতেন। তাঁদেরই কয়েকজন সান্দ্রাকে বলেন, চাইলে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে লেখাপড়া করতে পারেন। সান্দ্রার মাথায় গেঁথে যায় কথাটা।
খোঁজ নিয়ে জানলেন, পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশর ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সি, তিব্বতি, হিন্দি ও বাংলা ভাষাতেও পড়ার সুযোগ রয়েছে। নিজের ইচ্ছা পূরণে সান্দ্রা ভর্তি হন বাংলা ও হিন্দি বিভাগে। তবে বিভাগ বাছাইয়ের সময় অধ্যাপক সান্দ্রাকে দিয়ে দেন ‘বাংলা’।
এই বিষয়টিকে সান্দ্রা প্রকাশ করে রবিঠাকুরের ভাষায়, ‘আই ক্যান নট চুজ দ্য বেস্ট, দ্য বেস্ট চুজেস মি।’ ব্যস, এর পর থেকে সান্দ্রার ধ্যান-জ্ঞানজুড়ে রবীন্দ্রনাথ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, গান... কত অসংখ্য বাংলা গান আর কবিতা যে সান্দ্রার মুখস্থ, তা দেখলে অবাক হতে হয়।
বাংলা শেখার পথে বাধা ছিল অনেক। এমনকি তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শিক্ষার্থী শুরুতে বাংলা শেখা শুরু করলেও এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে। কিন্তু অধ্যাপক এলজবিয়েটা ওয়ালটার, আনা ট্রাইকভসকা, ভ্যারোনিকা রচিকার সহায়তায় নিজের বাংলা শেখা চালিয়ে যাচ্ছে সান্দ্রা। ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে তিন বছরের স্নাতক ডিগ্রি ও দুই বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
তবে বাংলাকে আরো ভালোভাবে জানতে-বুঝতে-শিখতে সান্দ্রার প্রয়োজন এমন কোনো ব্যক্তিকে, যিনি ওর সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারবেন। আর এটাই হবে সান্দ্রার জন্য সবচেয়ে বড় সাহায্য।
এই প্রয়োজনে সান্দ্রার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুল ওমর ফারুক। যতটুকু সম্ভব, ততটুকু দিয়ে তিনি সহযোগিতা করে যাচ্ছেন সান্দ্রাকে। পয়লা বৈশাখ বা ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ওমর ফারুক আয়োজন করেন বিশেষ অনুষ্ঠানের। সেখানেও যুক্ত হন সান্দ্রা। বাংলায় গান গান, কবিতা আবৃত্তি করেন। এ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রায় স্পষ্ট উচ্চারণে সান্দ্রা আবৃত্তি করেন কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি। এ ছাড়া কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কণ্ঠ মেলান ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানের সঙ্গে।
শুধু এসবই নয়, অনারারি কনস্যুল ওমর ফারুকের সহায়তায় সান্দ্রা এখন সসনোভিয়েতসে বাংলাদেশের কনস্যুল অফিসে বিনামূল্যে বাংলা শেখান। ছোট-বড় মিলে প্রায় ২০ জন সান্দ্রার কাছে বাংলা শিখতে আসেন। এই বাংলা ভাষা শিখতে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলেও জানান সান্দ্রা।
ভাষার ক্ষেত্রে কোনা সীমারেখায় বিশ্বাস করেন না সান্দ্রা। নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে সান্দ্রা বলেন, তাঁর স্বপ্ন বাংলাদেশে যাওয়া। বাংলার গ্রামে যাওয়া, সবার সঙ্গে কথা বলা, বাংলাদেশের রীতি-নীতি, আচার-সংস্কৃতির সঙ্গে সত্যিকার অর্থে পরিচিত হওয়াই সান্দ্রার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। এমনকি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বাংলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার স্বপ্নও দেখছেন সান্দ্রা।
লেখক : সংবাদ উপস্থাপক ও বার্তাকক্ষ সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর