আনন্দ ভাগাভাগির ঈদ
মানি বা না মানি, ইন্টারনেটের ব্যাপকতা, সেলুলার ফোনের দাপট এবং আকাশ-সংস্কৃতির আগ্রাসনের আগের ও পরের ঈদের ভেতর এক বিপুল ব্যবধান রচিত হয়ে গেছে। সশরীরে নিকটাত্মীয়ের বাড়ি উপস্থিতির বদল ভার্চুয়াল দেখা-সাক্ষাৎ কি ‘কোলাকুলি’ সেরে নেওয়ার সুবিধা জনপ্রিয় হচ্ছে। মেসেঞ্জারের ঝলসে ওঠা ইমেজ কিংবা ফোনের গ্রুপ টেক্সট হটিয়ে দিয়েছে রঙিন ঈদকার্ড পাওয়ার সূক্ষ্ম সুখ। চ্যানেলগুলো সাত দিন-দশ দিনের আনন্দ-পসরা সাজিয়ে বসছে। ঈদের অবকাশযাপন অলিখিতভাবে দীর্ঘই ছিল, চলতি বছর থেকে তা সরকারি অনুমোদন পাচ্ছে। এ থেকে বিনোদন উৎপাদকরা আরো উৎসাহিত হবে ধারণা করি। নিজেকে গৃহবন্দি করে, অর্থাৎ কিছুটা সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থানে রেখে, উপভোগ-সর্বস্বতায় মজে ঈদ নামের আশ্চর্য সামাজিক, সাম্যবাদী ও ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল পরম সুযোগটি দিন দিন মানবিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এই হারানোর ক্ষতি নিয়ে মোটেই ভাবিত নয় অধিকাংশ নাগরিক শিক্ষিত মন। এক আত্মঘাতী আত্মপরতা ও উদাসীনতার জালে জড়িয়ে ভোজনসুখ, পোশাকের ঝলক আর বিনোদনের গ্রাহক হিসেবে মানবসত্তার সকরুণ পরিবর্তনে নিশ্চয়ই তবু কোথাও বিবেকবোধ জেগে উঠছে।
শিশু-কিশোর বয়সে ঈদের যে আনন্দ, তার সঙ্গে আর কিসেরই বা তুলনা হতে পারে? ব্যক্তির যত বয়স বাড়ে, সেই আনন্দের তাগিদ ও উপভোগ ফিকে হতে থাকে। তখন আবার শিশু-কিশোরদের আনন্দ দেখেই ভিন্নতর এক খুশি ছলকে ওঠে হৃদয়ে। ছেলেবেলায় নতুন জামা-জুতো পরে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঘুরে বেড়ানো আর নানা পদের লোভনীয় সব খাবার খাওয়ার মধ্যে যে মজা থাকে, তা চিরকালীন স্মৃতির সঞ্চয়। বাবা-মা রোজা রাখতে দিতে চান না, তবু কান্নাকাটি করে একটা-দুটো রোজা রাখা, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদের দিন বাবা কিংবা বাড়ির মুরব্বিদের সঙ্গে ঈদগাহে যাওয়া বালক কিংবা কিশোরের মনে এক অনির্বচনীয় আনন্দ এনে দেয়। বলা বাহুল্য, বালিকা-কিশোরীদের মনেও সেই আনন্দের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। একটু যারা বেশি সংবেদনশীল, তারা অনুভব করে এ মহা উৎসবে কোনো কোনো বন্ধু কিংবা সহপাঠীর অনুপস্থিতি। আবার পূজার উৎসবে বা বড়দিনের ব্যতিক্রমী আনন্দ আয়োজনে যোগ দেওয়ার সুযোগ মিললে ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে সমাজের বিচিত্র উৎসব ও বিবিধ সংস্কৃতির অন্তর্গত সারসত্যটুকু জেনে ওঠা যায়।
শিশু-কিশোররাই কি কেবল ঈদের আনন্দে মশগুল হয়? ঠিক তা নয়, ঈদে সব বয়সীরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দ আহরণ। গিন্নিরা ফিরনি-পায়েস আর পোলাও-কোর্মা ইত্যাদি উপাদেয় খাবার রান্না করে সুখ পান। এখনো এই কাজ তাঁদের একচ্ছত্র অধিকার বলে গণ্য করেন। বাড়ির আর দশটা নেমন্তন্নের সঙ্গে ঈদের রাধাবাড়া আর খাওয়ানোর তৃপ্তিকর আনন্দ সমতুল্য হতে পারে না। সময় বদলালেও এখনো অনেক মা, এমনকি বড় বোনেরাও পরিবারের সদস্যদের জন্য নিজ হাতে পোশাক তৈরি করেন। প্রতিটি সেলাইয়ের ফোঁড়ে যেমন থাকে মমতা আর ভালোবাসা, তেমনি প্রতিটি বুননে প্রাপ্তি ঘটে চলে অসাধারণ এক সুখ। ঈদের বহু আগে থেকেই এ সুখের সূচনা; এও ঈদেরই আনন্দ।
এতক্ষণ যা বললাম, তাকে সাবেক আমলের ঈদের বৈশিষ্ট্য বলে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইবেন আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণ কিংবা তরুণী। কারণ তারা অভাগা; বৃহৎ পরিবারের বহুধা বিভক্ত এক ক্ষুদ্রাংশের বাসিন্দা, স্কয়ার ফিট মাপের ফ্ল্যাটের বিচ্ছিন্ন কক্ষে যার পৃথিবী পুরে রাখা। তার কাছে ঈদ কিছুটা বোরিং, কিছুটা ফাঁকা ঢাকায় হৈ-হল্লার সুবর্ণ সুযোগ। ঈদের পোশাক হিসেবে পাঞ্জাবি তার তেমন পছন্দের নয়, তবু দু-চারটে গড়াগড়ি খায় ওয়ার্ডরোবে। নিতান্ত অনিচ্ছায় তার একটি বেছে নেওয়া। যদিও তারও আছে কিছুটা নিকট অতীতের ঈদ-স্মৃতি। ঢাকার বাইরে ‘গরিব-গুর্বো’ শিকড়ে ফেরার অনিবার্যতা এবং সেইসঙ্গে এই হৃদয়হীন শহরে অভিভাবকের কোনো স্বজন বা বন্ধুর বাসায় স্বতঃস্ফূর্ত কিছুটা আরোপিত আনন্দ সন্ধানের অভিজ্ঞতা। এই বাস্তবতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, তবে এটি আমাদের সমর্থনও পায় না।
তারপরও বলব, প্রায় প্রতিটি মুসলিম পরিবারেই এমন একজন অন্তত ব্যক্তি থাকেন, যিনি রমজান মাসের প্রতিটি রোজা পালন করেন, তারাবি পড়েন। এই যে এক মাসের নামাজ-রোজা পালন শেষে ঈদের দিনটি আসে, সে দিনটি ওই ব্যক্তির জন্য এক অসামান্য ভালোলাগা বয়ে আনে। তাঁর আনন্দের প্রকৃতি ও ধরন নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। ঈদের দিন সকালে ঈদগাহে নামাজ পড়ে আসার পর সারাটা দিন হয়তো তিনি গৃহেই থাকেন, কোনো আনন্দস্থলে যোগ দিতে যান না কিংবা আনন্দের সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন না। তবু ঈদের দিন তাঁর হৃদয় গভীরে যে আনন্দের সুর অনুরণিত হয়, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমার আব্বার কথাই বলি, আমাদের বহুজনের আব্বাও এমনই, নব্বই ছুঁইছুঁই বয়সে একটি রোজাও কামাই করেন না তাঁরা। আব্বা শেষ ১০ রোজায় মসজিদে অবস্থান করে মৌনব্রত পালনও (ইতেকাফ) করতেন একসময়। দশ গ্রামের এক সম্মানিত ধর্মভীরু ও ধর্ম-অভিভাবকের সন্তান হিসেবে আব্বা যতটা পেরেছেন ধর্মকর্মে নিয়োজিত থেকেছেন। তাঁর ঈদের দিনের খুশির সঙ্গে আমাদের ভাইবোনের ঈদ-আনন্দের কি তুলনা দেওয়া সাজে?
মানি বা না মানি, ইন্টারনেটের ব্যাপকতা, সেলুলার ফোনের দাপট এবং আকাশ-সংস্কৃতির আগ্রাসনের আগের ও পরের ঈদের ভেতর এক বিপুল ব্যবধান রচিত হয়ে গেছে। সশরীরে নিকটাত্মীয়ের বাড়ি উপস্থিতির বদল ভার্চুয়াল দেখা-সাক্ষাৎ কি ‘কোলাকুলি’ সেরে নেওয়ার সুবিধা জনপ্রিয় হচ্ছে। মেসেঞ্জারের ঝলসে ওঠা ইমেজ কিংবা ফোনের গ্রুপ টেক্সট হটিয়ে দিয়েছে রঙিন ঈদকার্ড পাওয়ার সূক্ষ্ম সুখ। চ্যানেলগুলো সাত দিন-দশ দিনের আনন্দ-পসরা সাজিয়ে বসছে। ঈদের অবকাশযাপন অলিখিতভাবে দীর্ঘই ছিল, চলতি বছর থেকে তা সরকারি অনুমোদন পাচ্ছে। এ থেকে বিনোদন উৎপাদকরা আরো উৎসাহিত হবে ধারণা করা যায় করি।
নিজেকে গৃহবন্দি করে, অর্থাৎ কিছুটা সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থানে রেখে, উপভোগ-সর্বস্বতায় মজে ঈদ নামের আশ্চর্য সামাজিক, সাম্যবাদী ও ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল পরম সুযোগটি দিন দিন মানবিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এই হারানোর ক্ষতি নিয়ে মোটেই ভাবিত নয় অধিকাংশ নাগরিক শিক্ষিত মন। এক আত্মঘাতী আত্মপরতা ও উদাসীনতার জালে জড়িয়ে ভোজনসুখ, পোশাকের ঝলক আর বিনোদনের গ্রাহক হিসেবে মানবসত্তার সকরুণ পরিবর্তনে নিশ্চয়ই তবু কোথাও বিবেকবোধ জেগে উঠছে। ঈদে শত বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি সহ্য করে রাজধানী থেকে কোটি মানুষ তার শিকড়ের কাছে ফেরেন। দেশের বাড়িতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার মধ্যে যে স্বস্তি ও শান্তি, তার ছিঁটেফোঁটাও কি থাকে মহানগরীর ফ্ল্যাটে বন্দি বিচ্ছিন্ন ঈদ উদযাপনে?
আপনি নিকটজনের সান্নিধ্যে মহানন্দে ঈদ করছেন। অথচ অনেকেরই ঢাকা ছেড়ে যাওয়া হয়নি নানা কারণে। তার ঈদ নিরানন্দে-মেশা; এমন বন্ধু কিংবা পরিচিতজনের কাছে আপনার একটি টেলিফোনই হয়ে উঠতে পারে মহা খুশির ব্যাপার। আমার পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক হয়েছে। খুব কাছেরই কোনো বস্তিতে ঈদ এসেছে বছরের বাকি ৩৬৪ দিনের মতোই। হঠাৎ আপনি সেখানে গেলেন কয়েকটা নতুন পোশাক নিয়ে। অচেনা বালক কিংবা মধ্যবয়সী কোনো নারীর হাতে তুলে দিলেন তার কাছাকাছি মাপের কোনো পোশাক। কেমন হবে? দেখুন ট্রাই করে তাদের আনন্দ আর হাসি দেখে আপনার নিশ্চয়ই মনে হবে, অপরকে সুখ দিতে পারলে এক ধরনের তৃপ্তি আর সুখ নিজের মনে এসেও ধরা দেয়।
হাসপাতালে দুস্থদের ওয়ার্ডে যান দোকান থেকে দু-তিন পদের কেনা খাবার নিয়ে। কুড়িজনের জন্যই নিন খাবারটা। ঈদের দিন অনেক রোগীরই কাটে স্বজনদের মুখ দেখার আশায়। অথচ তার সেই আশা পূরণ হয় না। না, আমি কোনো মানবিক গল্প ফাঁদার চেষ্টা করছি না। বিশ্বাস না হয়, একবার গিয়েই দেখুন হাসপাতালে। দুহাতে কয়েকটা খাবারের প্যাকেট নিয়ে। ঈদের দিন আপনার এই ‘বেড়ানোটি’ কিছুটা অস্বস্তিকর ও বেহুদা মনে হলেও আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে যদি কাজটি আপনি করেন, তাহলে আপনার অন্য ধরনের একটি অভিজ্ঞতা হবে—সেটা জোর দিয়েই বলতে পারি। মানুষ মানুষের জন্য। ঈদের আনন্দ যদি কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া যায় অন্যকে আনন্দ দিয়ে, তাহলে সেটা তো আপনি করতেই পারেন।
ঈদুল ফিতরে আমাদের ‘জাতীয় সংগীত’ হয়ে উঠেছে জাতীয় কবির গান—ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। অধিকাংশ গানের মতোই এটি আমরা গাই, খুশির ঈদ এসেছে এই ভেবে আপ্লুত থাকি। কিন্তু লক্ষ করে দেখি না এই গানের ভেতরেই ঈদের মর্মবাণী কী তাৎপর্যপূর্ণভবেই না আমাদের জন্য কবি লিখে গেছেন। খুব ছোট্ট দুটি অংশ উদ্ধৃত করছি :
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে,
শোন আসমানী তাগিদ।...
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন,
হাত মেলাও হাতে...
শত্রুমিত্র ভেদাভেদ ভুলে সবার সঙ্গে মিলে মহান হয়ে ওঠার, বলা ভালো মানুষ হয়ে ওঠার বড় সুযোগ সামনে এনে দেয় ঈদ। অথচ আমরা এদিকটিতে কী সহজে উপেক্ষা করে যাই। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার গভীর আনন্দ-আহ্বান এড়িয়ে যাই। যদি তা না যেতাম, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই ঈদের দিনটিকে পরমানন্দের দিবস করে তুলতে পারতাম। এবারের ঈদে কি আমরা এদিকটি বিবেচনা করে দেখব?
ঈদ মোবারক।
ঈদের ছুটিতে নিরাপদে থাকুন।