রায়হান হত্যা : হাইকোর্টে মায়ের আবেদন
সিলেটে পুলিশ হেফাজতে রায়হান উদ্দিন আহমদ হত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের দারস্থ হয়েছেন তাঁর মা সালমা বেগম। আজ শনিবার এক আবেদনে তিনি জানিয়েছেন, রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে যে রিটটি করা হয়েছে তাতে পরিবারও পক্ষভুক্ত হতে চায়।
বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আবেদন করেন সালমা বেগম। আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার ফয়েজ উদ্দিন আহমদ। রায়হান হত্যার পর তিনিই গত ১৩ অক্টোবর বিচারবিভাগীয় তদন্ত চেয়ে রিটটি করেছিলেন।
আজ আইনজীবী ফয়েজ উদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ রায়হানের মা সালমা বেগম আমাদের রিটে পক্ষভুক্তি চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। আগামীকাল এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে।’
সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারীপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান উদ্দিন আহমদকে (৩৩) গত ১০ অক্টোবর রাতে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে। পরের দিন ১১ অক্টোবর সকালে তাঁর লাশ পায় পরিবার। পরে ওই দিন রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই। স্বজনদের অভিযোগ, ১০ হাজার টাকা না পেয়ে রায়হানকে পুলিশ হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এ ঘটনার পর ১২ অক্টোবর ওই ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া, এসআই টিটু চন্দ্র দাস, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও তৌহিদ মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যাহার করা হয় সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে। এসআই আকবর এখন পলাতক। পরে ২১ অক্টোবর মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগে এসআই হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে করা রিটে স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, সিলেটের পুলিশ কমিশনার, সিলেটের ডিসি-এসপিসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
রিট আবেদনে বিভিন্ন পত্রিকায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, সিলেটে পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যুর প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। নগরীর বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ইনচার্জ আকবর হোসেনের নেতৃত্বে রায়হানের ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
জানা যায়, দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বন্দর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ সাত পুলিশ সদস্যকে। ইনচার্জ আকবর প্রথমে রায়হানকে ফাঁড়িতে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত কমিটি। সেই ফুটেজ দেখানোর পর সবাই মুখ খুলতে শুরু করেন।
ফুটেজে দেখা যায়, ১০ অক্টোবর রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে বন্দর বাজার ফাঁড়ির সামনে থামে। সামনের অটোরিকশা থেকে তিন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে রায়হানকে দেখা যায়। তিনি হেঁটে হেঁটেই পুলিশের সঙ্গে ফাঁড়িতে প্রবেশ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা পর সকাল ৬টা ২২ মিনিটে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আসে ওই ফাঁড়ির সামনে। এর দুই মিনিট পর ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে দুই পুলিশের কাঁধে ভর করে রায়হানকে সেই অটোরিকশায় তুলতে দেখা যায়।
ইনচার্জ আকবরসহ অন্যরা তদন্ত কমিটিকে জানান, শনিবার রাত আড়াইটার দিকে দুজন লোক সোবহানী ঘাট থেকে কাস্ট ঘর রোড দিয়ে যাচ্ছিল। পথে সুইপার কলোনির গেটের পাশে তাদের আটক করে ছিনতাইকারীরা। চাকু দিয়ে টাউজারের পকেট কেটে তাদের টাকা-পয়সা নিয়ে সুইপার সুলাই লালের ঘরে ডুকে যায় তিন ছিনতাইকারী। এরপর ছিনতাইয়ের শিকার লোকজন মহাজনপট্টি দিয়ে বের হয়ে নগরীর বন্দর বাজারের মশরাফিয়া রেস্টুরেন্টে দুই পুলিশকে (কোতোয়ালি থানার মুন্সি ও এক অপারেটর) নাশতা করতে দেখে। তারা পুলিশকে ছিনতাইয়ের বিষয়টি জানায়। পুলিশ ইকো-১-কে মোবাইলে কল দিয়ে এ খবর জানায়। এরপর ইকো-১ এর ওয়্যারলেস অপারেটর কনস্টেবল আবু তাহের এএসআই আশিক এলাহীর টিমকে খবর পাঠায়। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন— কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও হারুনুর রশিদ। তারা গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে ভিকটিমের উপস্থিতিতে রায়হানকে আটক করে। তার সঙ্গে থাকা দুজন দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়। এএসআই আশিক এলাহী ছিনতাইয়ের শিকার লোকের নাম-পরিচয় জানেননি বলে তদন্ত কমিটিকে জানান।
রায়হানকে আটককারী পুলিশ সদস্যরা তদন্ত কমিটিকে জানান, ফাঁড়িতে নিয়ে আসার পর এসআই আকবরের নেতৃত্বে রায়হানকে নির্যাতন করা হয়। তার নির্দেশেই তৌহিদের ফোনে রায়হান তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলেন।
রায়হানের পরিবারের সদস্যরা ১১ অক্টোবর সকালে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে থানায় গিয়ে জানতে পারেন, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা সেখানে গিয়ে জানতে পারেন রায়হান মারা গেছেন।