যেমন আছে এসি রবিউলের পরিবার
মোহাম্মদ রবিউল করিম কামরুল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে ৩০তম বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে।
২০১৬ সালে রবিউল করিম ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনারের (এসি) দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দায়িত্ব পালনরত অবস্থাতেই ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় চালানো সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন তিনি।
দেখতে দেখতে সেই হামলার এক বছর পেরিয়ে গেল। এক বছর পর কেমন আছে এসি রবিউলের পরিবার?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে এনটিভি হাজির হয় রবিউলের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কাটিগ্রামে।
সেখানে এই প্রতিবেদকের কথা হয় নিহত রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমা, আট বছরের ছেলে সাজিদুল করিম সামি, মেয়ে কামরুন্নাহার রায়না, ছোট ভাই সামসুজ্জামান সামস ও বৃদ্ধ মা করিমুন নেছার সঙ্গে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে ৪৫ বছর বয়সে মারা যান রবিউলের বাবা আবদুল মালেক। একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন তিনি। তাঁর অকালমৃত্যুতে বিপাকে পড়ে গোটা পরিবার। এরপর রবিউল পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরই খানিকটা ঘুরে দাঁড়ায় পরিবারটি।
কিন্তু গত বছর রবিউলের অকালমৃত্যুতে পরিবারটি আবারও সংকটে পড়েছে। কেননা রবিউলই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
রবিউলের মা করিমুন নেছা জানান, রবিউলের মৃত্যুর পর সরকারিভাবে পাওয়া আর্থিক সহায়তা ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে। সেখান থেকে পাওয়া লাভ থেকে কোনোমতে চলছে তাঁদের সংসার। এখন অপেক্ষা করছেন ছোট ছেলে শামসুজ্জামান শামস ও রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমার একটি চাকরির। এই দুজনের চাকরি হলে তাঁদের আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছেন তিনি।
করিমুন নেছা জানান, তাঁর ছোট ছেলে ও রবিউলের স্ত্রী দুজনেই উচ্চশিক্ষিত। এঁদের মধ্যে ছেলে শামসুজ্জামান শামস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন শেষ করেছেন। অন্যদিকে, রবিউলের স্ত্রী সাভার কলেজ থেকে ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
বড় সন্তান রবিউল দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাই এই বৃদ্ধ মা মনে করেন, সরকারের উচিত রবিউলের স্ত্রী ও ছোট ভাইকে তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিয়ে পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো।
এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমাকে সেখানে প্রথম শ্রেণির একটি পদে চাকরির আশ্বাস দিয়েছিল বলে জানান করিমুন নেছা। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য বলেছিলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের মধ্যেই চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও চাকরির দেখা পাননি উম্মে সালমা।
আট বছর বয়সী ছেলে সামি ও ১১ মাস বয়সী মেয়ে রায়নাকে তাদের বাবার আদর্শে গড়ে তুলতে চান উম্মে সালমা। সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁর সন্তানরা ভালো মানুষ হোক-এটাই প্রত্যাশা। একই প্রত্যাশা ছিল প্রয়াত রবিউলেরও।
ছেলে সম্পর্কে উম্মে সালমা বলেন, ‘স্কুলে যাওয়ার পরে আবার আমাকে প্রশ্ন করবে, আব্বু যদি এখন থাকত আব্বু আসত। আমি জানি ওর ভেতরে খুব কষ্ট হবে, কিন্তু আমার কষ্টটা আমি কখনোই কারো সঙ্গে শেয়ার করি না। যখন কিনা ওই অ্যাকসিডেন্টটা হলো, তার পর থেকে ওর ভেতরে এমন একটা কাজ করত মানে কারো আদর ও সহ্য করতে পারত না। কেউ কোনো গিফট দিলে সেটাও নিতে চাইত না। বলত, সবাই আমাকে শুধু কষ্ট দেয়।’
এসি রবিউলের ভাই শামসুজ্জামান শামস বলেন, ‘ভাই মারা যাওয়ার পর তাঁর ভাবী সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আছেন। ভাবী যদি কোনো কাজ শুরু করতেন, তাহলে হয়তো সেই সব স্মৃতি ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজ হতো তাঁর জন্য।’ আবদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য ভাবীর একটি চাকরি বিশেষ প্রয়োজন বলেও মনে করেন শামস।
এদিকে, রবিউলের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি- ব্লুমসের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা স্কুলের ভবিষ্যতের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে ওই বিদ্যালয়ের পরিচালক (প্রশাসন) জাহাঙ্গীর আলম জানান, স্কুলটি ছিল রবিউলের স্বপ্ন। তাঁর পরিবার, অন্যান্য সদস্যসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিদ্যালয়টিকে রবিউলের পরিকল্পনা অনুসারে চালাতে ও সহায়তা দিতে অঙ্গীকার করেছেন।
২০১১ সালে রবিউল প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন এর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪১ জন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে রবিউল স্কুল ইউনিফর্ম, টিফিন, বই, স্টেশনারি, সরঞ্জাম এবং স্কুল-ভ্যানসহ স্কুলের শিক্ষার্থীদের সব খরচ বহন করতেন। তিনি শিক্ষার্থী এবং দরিদ্রদের জন্য ক্যাম্পাসে একটি আবাসিক ভবন এবং হাসপাতাল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, অসচ্ছল বৃদ্ধদের জন্য বৃদ্ধনিবাস গড়তে চেয়েছিলেন বলে জানান তাঁর ভাই শামস।
এই প্রতিষ্ঠানের তহবিল গঠনের জন্য রবিউল একটি কৃষি প্রকল্প করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানান শামস। সে লক্ষ্যে তিনি নিজের চাচার মালিকানাধীন ১৩৭ শতাংশ জমির ওপর একটি কলাবাগান এবং পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন।
এ ছাড়া ২০০৭ সালে বাবার স্বপ্নপূরণের জন্য নিজেদের গ্রামে নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন রবিউল করিম। রবিউলের স্মৃতি ধরে রাখতে এসব প্রতিষ্ঠান যেন চলমান থাকে তা লক্ষ রাখতে সরকার এবং সুশীলসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান শামসুজ্জামান শামস।