বাসেত মজুমদারের স্মরণীয় চার ঘটনা
অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার। সম্প্রতি বিচার অঙ্গনে তাঁর ৫০ বছরপূর্তি পালন করেন। বিচার অঙ্গনে মেধা ও মনোমুগ্ধকর যুক্তিতর্ক দিয়ে মামলা জয়ের জন্য তিনি সুনাম ধরে রেখেছেন। আদালতপাড়ায় গরিবের আইনজীবী হিসেবে তিনি খ্যাত। অনেক ত্যাগ, ধৈর্য, কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে তিনি আজ এ পর্যায়ে আসীন হয়েছেন।
এখনো স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন আশি ছুঁই ছুঁই এই স্বপ্নবাজ। আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের সংগঠন সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সভাপতি তিনি। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস-চেয়ারম্যানও। আদালতে মামলার শুনানিকালে তিনি চারটি মজার ঘটনা বর্ণণা করেছেন এনটিভি অনলাইনের কাছে।
আবদুল বাসেত মজুমদারের নিজের মুখেই শোনা যাক :
ঘটনা ১
কুমিল্লার একটি মামলার কথা বলি; একটি ছেলে তার মামার বাড়িতে বেড়াতে গেল। রাতের বেলায় পুলিশ এসে ওই ছেলে এবং তার মামাতো ভাইকে ধরে নিয়ে গেল। পরে অস্ত্র আইনে ছেলেকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু থানায় একদিন আটক রাখার পর মামাতো ভাইকে ছেড়ে দেয়।
পরে ওই ছেলের পক্ষে আমি মামলার শুনানিতে অংশ গ্রহণ করি। আমি শুনানিতে আদালতকে বললাম;মাই লর্ড মা-ছেলেকে নানার বাড়িতে পাঠিয়ে বললো;আমরা তো দুঃখে কষ্টে আছি। তোর মামাকে বলিস আমাদের অংশীদার থেকে কিছু টাকা দিতে। কিন্তু মামা টাকা দিতে অস্বীকার করায় ছেলে মায়ের উত্তরাধিকার দাবি করল। ছেলের সঙ্গে মামার বাগবিতণ্ডা হয়। এ অবস্থায় মামা পুলিশকে টাকা দিয়ে মামলার নাটক সাজিয়ে অস্ত্র আইনে ভাগিনাকে চালান করে দেয়। আর মামা নিজের ছেলেকেও পুলিশের হাতে দিয়ে দেয়। কেননা এতে ছেলের মা কিছুতেই মামাকে দোষারোপ করবে না।
দীর্ঘদিন ধরে ছেলে কারাগারে থাকার পর যখন কেউ খোঁজ খবর নেয় না। তখন ছেলের মা কান্না করতে করতে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়ে ছেলের মামাকে বলল;ভাই আমাদের সম্পত্তি ফেরৎ দেওয়ার দরকার নেই। তুমি আমাদের অংশটাও খাও। তবু আমার ছেলেকে কারাগার থেকে বের করে আনো। পরে ছেলের মায়ের কাছ থেকে অংশীদারি থাকবে না মর্মে লিখিত নিয়ে নেয় ছেলের মামা। ছেলে কারাগারেও গেল, সম্পত্তিও গেল। গরিবের কষ্ট আরো বাড়ল। এভাবে বিষয়টি আদালতে উপস্থাপনের পর আদালত ছেলেকে খালাস দিলেন।
আদাশের আগে আদালত আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন; এসব ঘটনা আদালতের কাছে উপস্থাপিত আপনার লিখিত আবেদনে আছে কি? আমি বললাম লেখা নেই। যখন আপনার সামনে কোর্টে দাঁড়ালাম তখন মাথায় চলে আসে। মেহেরবাণী করে ছেলেকে খালাস দেন। এটিই আসল ঘটনা। পরে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে ওই ছেলেকে খালাস দিলেন। আমি আসলে আশ্চর্যজনকভাবে এ ঘটনা আদালতের সামনে উপস্থাপন করি। আমি নিজেও জানি না আদালতে যখন কথা বলতে যাই তখন মাথায় কীভাবে চলে আসে।
ঘটনা ২
১৯৯০ কিংবা ১৯৯১ সালের দিকের ঘটনা। এক পুলিশ কর্মকর্তাকে অসৎ উপায়ে চাকরি গ্রহণের অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন।
মামলাটি আমার কাছে আসার পরে আমি তার পক্ষে আদালতে শুনানি করি। শুনানিতে আদালতকে বললাম মাই লর্ড, লোকটি পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পায় না। অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছে। এক আত্মীয়র মাধ্যমে সচিবালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই কর্মকর্তার কাছে চাকরির জন্য তার অফিসে গেলে বলল, তোমার সার্টিফিকেট নিয়ে আস। পরে ওই লোকটি বললো আমার তো খুব বেশি সার্টিফিকেট নেই। ওই লোক বলল চাকরি দেওয়া যাবে, তবে আরো কিছু সার্টিফিকেট লাগবে। পরে লোকটি বলল- এখন কী করব?
পরে সচিবালয়ের ওই কর্মকতা লোকটি বলল, কিছু টাকা পয়সা খরচ করতে হবে। লোকটি বললো কত টাকা? কর্মকর্তা লোকটি বলল, ৫০ হাজার টাকা। পরে অনেক কষ্ট করে ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। পরে নতুন কিছু সার্টিফিকেটসহ লোকটিকে পুলিশে চাকরি দেওয়া হয়।
লোকটি কিছুদিন চাকরি করার পর পুলিশ প্রশাসন জানতে পারে তাঁর সার্টিফিকেটটা ভুয়া। পরে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি নেওয়ার অভিযোগে ফৌজদারি আইনে মামলা করে লোকটিকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু লোকটাতো জানে না কীভাবে সার্টিফিকেট নেওয়া হয়েছে? কীভাবে চাকরি হলো সে বিষয়ে ও তার জ্ঞান নেই। এ ঘটনার জন্য তো এ ছেলে দায়ী না। সে চকরি পায় না বিধায় টাকা দিয়েছে শুধু।
আদালতকে বললাম, লোকটা কত কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে চাকরি নিল। সার্টিফিকেট সর্ম্পকে সে কিছুই জানে না। তাঁর চাকরিটাও গেল। টাকাও গেল। মাই লর্ড, আমাদের দেশে একটি প্রবাদ আছে, আমও গেলো ছালাও গেলো। গেল গেল সবই গেল। এ নিরীহ লোকটাকে জেলে রেখে আদালতের কী লাভ হবে? পরে দেখি আদালত তাকে খালাসই করে দিলো। আসলে সত্য কথা হলো এ ধরনের কথা মিরাক্যালি চলে আসে। কোর্ট জানে আমি কোর্টের সময় নষ্ট করি না। মিথ্যা কথা বলি না। আমি মক্কেলের পক্ষে প্রথমে কথা বলি। এভাবে হাজার হাজার মামলা জয়লাভ করি। আমি কখনো কোনো মক্কেল কত টাকা দিলো তার হিসাব করিনি।
ঘটনা ৩
রাজধানীর এক ডাক্তার চট্টগ্রাম থেকে তাঁর প্রাইভেটকারে করে ঢাকায় ফিরছিলো। নারায়ণগঞ্জ এলাকায় আসার পর পুলিশ গাড়ি তল্লাশি করে। এ সময় তাঁর গাড়িতে ফেনসিডিলের বহু বোতল পাওয়া যায়। পরে পুলিশ তাকে আটক করে মাদক মামলায় কারাগারে পাঠায়। আসামিকে জামিন করার জন্য মামলাটি আমার কাছে আসে।
আমি মামলার নথি পড়ে দেখি, আসামিকে কত বোতল ফেনসিডিলসহ ধরেছে পুলিশ মামলার এজাহারে উল্লেখ করেনি। পরে আদালতে আমি জামিনের শুনানিতে অংশ নিলাম। আদালতকে বললাম,বিজ্ঞ আদালত ডা. সাহেব নিজেই একজন সচেতন মানুষ। তিনি ফেনসিডিল ব্যবসা করতে যাবেন কেন? উনার কাশির সমস্যা তাই উনি এক বোতল ফেনসিডিল কিনেছেন! এ বোতলটি দেখে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আসামির জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, আসামি একজন মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ী। গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই ডাক্তার একজন মাদকাসক্ত। এখনো কারাগারে তাকে ফেনসিডিল সরবরাহ করা হয়। তাঁর কারণে কারাগারের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এ সময় আমি আসামির পক্ষে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বললাম, মাই লর্ড, জামিন দেওয়া হলে ডাক্তার সাহেব মাদক বন্ধে চিকিৎসা নেবেন। এই জন্য তাকে জামিন দেওয়া উচিৎ। অন্যথায় তার কারণে কারাগারের পরিবেশ নষ্ট হবে। অন্য আসামিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদালত আমার যুক্তিটি আমলে নিয়ে তাকে জামিন প্রদান করে।
ঘটনা ৪
চট্টগ্রামে এক পৌরসভার মেয়রের বিরুদ্ধে একই পৌরসভার নারী কাউন্সিলর ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করে। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে ওই আসামি হাইকোর্টে আগাম জামিনের জন্য আসে। আমি আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলাম। মামলার নথি পড়ার পর আমি দেখলাম, আসামির বয়স ৮২ বছর। আর অভিযোগকারী নারী বয়স ৫২ বছর। পরে আদালতকে বললাম, মাই লর্ড, আমার মক্কেল একজন জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি। তার সম্মান নষ্ট করার জন্যই মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। মেয়রের বিরোধীপক্ষ শত্রুতাবশত এ মিথ্যা মামলা সাজিয়েছে। কারণ তিনি অনেক জনপ্রিয় মেয়র। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ওই এলাকার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। আর কয়েক মাস পর পুনরায় নতুন নির্বাচন হবে। তাঁর বিরোধীপক্ষ মিথ্যা অজুহাতে তাকে ঘায়েল করার জন্য মিথ্যা মামলা করেছে।
আমার শুনানির পর আদালত বলল, অভিযোগকারী ওই নারীর মেডিক্যাল পরীক্ষা এবং পুলিশ রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত এ মামলায় তাকে জামিন দেওয়া যাবে না। আমি আবারও বললাম, মাই লর্ড, আসামিকে সামনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণে বাধা দেওয়ার জন্য এ মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আদালত কিছুতেই জামিন দিতে রাজি হলো না।
সর্বশেষ আদালতকে বললাম, মাই লর্ড, নারীদের সাধারণত ৪০ বছর পার হলেই তাদের ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলে। এই বৃদ্ধ বয়সে তার প্রতি আকৃষ্ট হবে কীভাবে? তা ছাড়া আসামির বয়স ৮২ বছর। তার কিছু আছে বলেত আমার মনে হয় না! তখন দেখি আদালত হাসতে হাসতে বলল, আমাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ৮৬ বছরেও অনেক কিছু করছেন!
জবাবে আমি যুক্তি দিয়ে বললাম, মাইলর্ড জামিন আপনাকে দিতেই হবে। কারণ চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে একটা প্রবাদ রয়েছে, তারা নারীর চেয়ে তরুণদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট। এ ধর্ষণের ঘটনা যদি সত্যিও হয় তাহলে তো বলা যায় অন্তত তারা সঠিক পথে ফিরে আসছে। এ কথা শুনে আদালতে উপস্থিত সবাই হেসে উঠলেন। পরে অবশ্য আদালত আসামিকে জামিন দিয়ে দিলেন।