শেষ পর্ব
বাবা আছে, বাবা নেই
আমার একটি মেয়ে হয়েছে।
নিশা। কাকা পছন্দ করেই আমার মেয়ের নাম রেখেছে। খালাম্মা, কাকা, টিনা সবাই নিশাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কাকা যেন অবসর সময়টা কাটানোর একটা খেলনা পেল। এ যেন তাঁর বড় চাকরি।
সময় বয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে দুই বছর পেরিয়ে গেল। কাকার হাত ধরে নিশা বেড়াতে যায়। নানান বায়না ধরে। কাকাও নিজের নাতনির মতো সব বায়না মেটাতে উঠেপড়ে লাগে।
এই দুই বছরে আমাদের বাড়ির কারো সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। তারাও আমার খোঁজ পায়নি। বেশ কবার ইচ্ছে করছিল মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। করি করি করে তাও করা হয়ে ওঠেনি। আমি নিরুদ্দেশ হওয়ায় যেন মৌলানা শরাফত খান বেঁচে গেলেন। তিনি জানতেন, রাজাকার বলেই তাকে আমি ঘৃণা করি। আর বাকিউলও নিশ্চয় আমার হারিয়ে যাওয়ায় তেমন বেশি অসন্তুষ্ট হয়নি। যারপরনাই খুশিই হয়েছে বলতে হয়। এত দিন নিশ্চয় সে আরো দু-একটি মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। শেষ পর্যন্ত তার কপালে বউ টিকে আছে কি না, তা সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
খবরটি খবরের কাগজেই বেরোয়। তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে তার নামও আছে। এই সময়ে একরাতে আমি প্রচণ্ড সুখকর স্বপ্ন দেখি। দেশের যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে মৌলানা শরাফত খানকে ফাঁসির কাষ্টে ঝোলানো হয়েছে। তাদের চেহারাগুলো বিদঘুটে। ভৌতিক। জেলারের নির্দেশে জল্লাদ মুখ ডাকা টুপি পরিয়ে দিয়েছে। ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন। সাধারণত জেলার একটি রুমাল ছুড়ে ফেললেই জল্লাদ ফাঁসির দড়ি টান দেয়। জেলারকে দেখলাম পকেটে কিছু একটা খুঁজছেন। তিনি কি রুমাল খুঁজছেন? হয়তো তাই। একটি রুমালের জন্য কি দেশের এই ঘৃণ্য অপরাধীদের বিচার থেমে যাবে?
খুব অসহ্য লাগছে। ইচ্ছে করছে আমিই জেলারের হাতে রুমাল দিয়ে আসি।
বিছানায় বালিশের নিচে রুমাল হাতড়াতে থাকি। হাতের গুঁতো খেয়ে নিশা জেগে ওঠে। হাউমাউ করে কান্না করে। ঘুম ভাঙে আমার। নিশাকে বুকে টেনে নিই। বুক চোষে। মাকে, শিমুকে খুব মনে পড়ছে। এত দিন শিমুর কি বিয়ে হয়ে গেছে? শিমুরও কি আমার পরিণতি ঘটেছে? শিমু তো অনেক জেদি। মৌলানা শরাফত খান নিশ্চয় শিমুকে জোর করে বিয়ে দিতে পারেননি।
দুই চোখের ঘুম উঠে গেছে। নিশা দুধ চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
মায়ের জন্য মনটাকে আর মানাতে পারছি না। একবার মায়ের কাছে ছুটে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। মায়ের নিষ্পাপ সুন্দর মুখটি দেখার জন্য বুকের ভেতর আকুলি-বিকুলি করছে।
যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। পাছে মৌলানা শরাফত খানের মুখোমুখি হতে হয়। এখন আর সে ভয় নেই। মৌলানা শরাফত খান বাড়ি নেই। দিব্যি মায়ের সঙ্গে দুদিন থেকে আসা যাবে। মাকে আমার বিয়ে, নিরুদ্দেশের কাহিনী, নিশার পৃথিবীতে আসা সব এক এক করে বলা যাবে।
রাত পেরিয়ে সকাল হলো। ভোরে নাশতার টেবিলে কাকাকে আমার যাওয়ার কথাটা পেড়ে বসলাম। কাকিমা আর টিনা বেশ অবাক হলো। বললাম শুধু দুটো দিন। যাব আর আসব। টিনা বায়না ধরল, সেও যাবে।
কাকাও টিনার কথায় সায় দিলেন।
বলল যাক না। মাত্র দুটো দিনই তো। রাবেয়ার একা যাওয়াটা ঠিক হবে না। অনেক দিন পর বাড়ি যাচ্ছে। তা ছাড়া নিশাকে দেখার জন্যও একজন সঙ্গে থাকা উচিত।
না। বলল কাকিমা।
কেন? বলল কাকা।
রাবেয়া নিজেই যাচ্ছে লুকিয়ে। টিনাকে নিয়ে ঝামেলা বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। তা ছাড়া একটা রাজাকারের বাড়ি। কখন কী হয় না হয়।
কাকিমার কথায় কাকা চুপ করে গেলেন। টিনা আগ বাড়িয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থামল। মাঝখানে সুযোগটা পেয়ে গেলাম আমি।
বললাম, আগে আমি গিয়ে পরিস্থিতি-পরিবেশ দেখে আসি। তারপর না হয় সবাইকে নেওয়া যাবে।
তাই করো মা। বলল কাকিমা।
কাকিমার কথায় কাকাও সায় দিল।
দুপুরে খেয়েদেয়ে তৈরি হলাম। কালো বোরকা আর মুখে নেকাব। শুধু চোখ দুটো ঢাকা বাকি। বোরকা আর নেকাব পরা অবস্থায় নিশা আমাকে কখনো দেখেনি। মনে হয়, এই প্রথম দেখল, তাই ও বেশ ঘাবড়ে গেছে ভয়ে। খুললাম, অমনি হাউমাউ করে কান্না করে আমার কোলে এসে পড়ল।
বেরোনোর আগে কাকা, কাকিমা আর টিনা নিশাকে বেশ আদর করল। আমাদের এগিয়ে দিতে কাকা অনেকটা পথ এলো। নিশাকে চকলেট আর চিপস কিনে দিল। আর আমার হাতে গুঁজে দিল হাজারখানেক টাকা।
কাকা আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিল। গাড়ি ছাড়া পর্যন্ত দাঁড়িয়েই ছিল। বাসের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিশার সঙ্গে খেলল।
যখন বাস ছাড়ল, তখন দেখি কাকার চোখে জল। হাত নাড়ছে। আমারও চোখে জল এলো। মনে হলো তিনি আমার কাকা নন। পিতা। মৌলানা শরাফত খানকে কোনো দিন দেখিনি আমার জন্য এভাবে কাঁদতে। নিশা অবাক হয়ে কাকার দিকে তাকিয়ে রইল। দুই বছরের ছোট্ট নিশাও হয়তো বুঝতে পেরেছে, বিদায় কতোটা কষ্টের।
বাস এগুলো সামনে। আর কাকা হারিয়ে গেল পেছনে।
হাজারো উৎকণ্ঠা নিয়ে মায়ের কাছে যাচ্ছি। মা আমাকে ঠিকই চিনে নেবে। শিমু চিনতে পারবে তো? আচ্ছা নিশাকে দেখে ওরা কী ভাববে? আর মৌলানা শরাফত খানের ভাইয়েরা কি আমাকে সহজে মেনে নেবে? তারাও তো জানত, আমি শরাফত খানকে ঘৃণা করতাম। নয়ছয় ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। ভাবনার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। নিশা ঘুমিয়ে পড়েছে, আমার কোলে মাথা রেখে। পা দুটো বাকা করে।
বাস যখন আমাদের গঞ্জের স্টেশনে থামল, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। স্টেশনটা আমি ঠিক চিনতে পারলাম। তেমন একটা পাল্টায়নি। দু-একটা উঁচু দালান হয়েছে। এই যা। মুখে নেকাব লাগিয়ে বাস থেকে নামলাম। নিশা এখনো ঘুমিয়ে। ওকে কাঁধে নিলাম। আমাদের নামিয়ে বাসটি স্টেশন ছেড়ে গেল।
গঞ্জের দোকান ডিঙিয়ে মেঠোপথ ধরলাম। পথঘাট ঠিকঠাক আগের মতোই আছে। বিজয় ডাক্তারের দোকানও পাল্টায়নি। পরিবর্তনের মধ্যে মুন্সি মিয়ার চা-দোকানের ছাউনিটা চোখে পড়ছে। ছনের ছাউনি পাল্টে টিন লাগিয়েছে। ভেতরটা আগের মতোই আছে।
মনে পড়ল আমি রমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বাকিউল এই চা-দোকানেই বসা ছিল। তারপর আমার পিছু নিল। বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। চা-দোকানে বসা কয়েকজন লোক আমাকে ঠাউরে দেখছে। মুখে নেকাব থাকায় ঠিক আঁচ করতে পারছে না।
চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। মূল রাস্তার সঙ্গে ছোট্ট একটি কাদামাখা মেঠোপথ ঢুকেছে বাড়ি পর্যন্ত। এ রাস্তাটাও পাল্টায়নি। দুপাশে ঘাষ আর মাঝখানে পিচ্ছিল মেঠোপথ। নিশাকে কাঁধে নিয়ে এগোচ্ছি।
আশপাশের বাড়িগুলো থেকে চেরাগ ও হারিকেনের আলো বাইরে ঠিকরে পড়ছে। এ গাঁয়ে এখনো শহুরে বিদ্যুৎ আর বিজলি বাতির ছোঁয়া মেলেনি। তবে খুব শিগগির হয়তো বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগবে।
বাড়ির উঠনে এসে পৌঁছলাম। পেঁপেগাছটা ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এবার দেখছি বেশ পেঁপে ধরেছে। উঠোনের দক্ষিণ কোনায় আমার লাগানো হাসনাহেনা গাছটি ডালপালা মেলে বসে আছে। সামনের ঘর থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে হারিকেনের আলো আসছে। দরজার ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। পাথরে পা দিয়ে মাটির ডায়ালে উঠলাম। বাঁশের তৈরি ঘরটি যে মাঠির ঢিবির ওপর দাঁড়ানো, তার বাইরের হাঁটাপথকে আমাদের গায়ে ডায়ালই বলে।
নিশা কাঁধে নড়াচড়া করছে।
দরজায় টোকা দিলাম। একবার। দুবার। তিনবার। ভেতর থেকে শব্দ এলো, কে। মায়ের কণ্ঠ। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম।
ভেতর থেকে মা আর শিমু সামনের ঘরে এগিয়ে এলো। হারিকেনের আলোটা বেড়েছে। নিশ্চয় মা বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার টোকা দিলাম।
কে? মা বলল।
জানালার কপাটের ফাঁক দিয়ে দেখল শিমু। মাকে বলল, মা বোরকা পরা একজন মহিলা। কে আপনি? পুনরায় বলল, মা।
নেকাব খুললাম। ডাকলাম, মা।
এক ঝটকায় দরজা খুলে গেল। মা আমার কণ্ঠ বুঝতে পেরেছে।
শিমু হারিকেন এনে আমার মুখে ধরল।
রাবু তুই!
আপু!
মা আর শিমু দুজনেই হতবাক। হকচকিত নিশা। কোথায় এসেছে? এরা কারা? কিছুই ঠিক বুঝতে পারছে না। মা আমাকে জড়িয়ে ধরল আর কান্নায় ভেঙে পড়ল।
নিশা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে জোরে কান্না করে উঠল। মা নিশার কান্না থামাতে বলে আমাকে ভেতর ঘরে নিয়ে গেল।
নিশাকে মাও কোলে নিতে চাইল। কিন্তু গেল না।
মা আমার বোরকা খুলে নিল। শিমু দুই চোখ ভরে আমাকে দেখছে।
এ কী দশা হয়েছে তোর? মা বলল।
আপু তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না।
শিমু চুপ কর। ওকে আগে একটু দম নিতে দে। কতদূর থেকে এসেছে আল্লাহ মালুম। বলল মা।
আপু বাবুর নাম কী?
নিশা।
আলহামদুলিল্লাহ। বলেই মা নিশাকে নিতে চাইল। কিন্তু নিশা গেল না। তোর চাচারা পাশের বাড়িতে আছে। জানতে পারলে পুরো গ্রামে ঢোল পিটিয়ে দেবে।
নিশাকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়ালাম। আমরাও খেলাম। অনেক দিন পর তৃপ্তি ভরে মায়ের হাতের রান্না খেলাম। মনে হলো পৃথিবীতে বসে স্বর্গীয় অমৃত খেলাম; শিমু উন্মুখ হয়ে বসে আছে। আমার মুখে গল্প শুনছে।
মাও।
মাঝখানের ঘরে তিনজনে পাটি বিছিয়ে বসলাম। মা পানের বাটা হাতে নিল। পানের বাটা থেকে এক টুকরা সুপারি মুখে পুরলাম।
বল না আপু! শিমুর তর সইছে না।
দাঁতে সুপারি চিবুতে চিবুতে বলা শুরু করলাম। শহরে রিমাদের বাসা। মৌলানা শরাফত খানের ডাক্তার দেখানোর নামে প্রতারণা। বাকিউলের সঙ্গে বিয়ে। থানা-পুলিশ। তেলাপোকায় ভরপুর বাকিউলের বাসা। হাসপাতাল। পলায়ন। টিনা। কাকিমা। কাকা। অতঃপর নিশা। খবরের কাগজ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। মৌলানা শরাফত খানের পলায়ন। এবং এটা জেনে আমার মায়ের কাছে ফেরা।
মা বলল, মৌলানা শরাফত খানের মাদ্রাসায়ও নাকি টাকা-পয়সা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছে। দুপক্ষ মারমুখি হয়ে আছে। সে জন্যে এবং যুদ্ধপরাধী বলে গ্রেপ্তারের ভয়ে মৌলানা শরাফত খান পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
মাঝেমধ্যে হঠাৎ হঠাৎ গভীর রাতে বাড়িতে আসে। আবার রাতেই ফিরে যায়।
আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ছন্দপতনের গল্প বলতে বলতে রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শিমু কবেই বিছানায় ঢলে পড়েছে।
নিশাকে পাশে রেখে আমি মায়ের কাছে শুলাম। মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মায়ের গায়ের সুমিষ্টি গন্ধ এখনো অটুট আছে। দুই চোখে ঘুম নামছে।
হঠাৎ বাইরে দাপাদাপির শব্দে উঠে বসলাম। মাও উঠল।
কী হলো মা? বললাম আমি।
নিশ্চয়ই শিয়াল-কুকুরের কাজ। ঘুমিয়ে পড়। মাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। প্রায় প্রতিরাতে বাড়ির চারপাশে শেয়াল আসে। আড়াল থেকে মোরগ নিতে চায়। অনেক সময় সুযোগ বুঝে মোরগের ঘাড় মটকে নিয়েও যায়।
মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছে না। এপাশ-ওপাশ করছি। উঠোন থেকে গোঙানির শব্দ কানে আসছে। মনের ভেতরটা ভয় ভয় করছে। মাকে ডাকব কি না ভাবছি। না ঘুমাক। নিশা নড়েচড়ে উঠল। ওকে গায়ে হাতের আলতো পরশ দিয়ে ঘুম পাড়ালাম।
উঠোনে বেশ কয়েকটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে। যেন কুকুরগুলো এক হয়ে শোরগোল করছে। মসজিদ থেকে আস-সালা-তু খাইরুম মিনা নাউম-ভেসে আসছে।
কুকুরের চেঁচামেচি থামছে না। মা জেগে উঠল।
মা।
হুঁ।
বাইরে কুকুর এত চেঁচামেচি করছে কেন?
কী জানি? কোনো শিয়াল-টিয়াল মেরেছে কি না? তুই তো ঘুমাতে পারিসনি। ঘুমা। আমি ফজরের নামাজটা পড়েনি।
না মা। তুমি একা বের হয়ো না।
দূর, কিছু হবে না। এ আর নতুন কী। কুকুর-শিয়ালের চিৎকার তো এখানে নিত্যদিনের। তুই বুঝি জানিস না?
জানি মা।
তাহলে?
মা আমার কেমন যেন ভয় করছে। চলো আমিসহ তোমার সঙ্গে বেরোই।
তুই নিশার পাশে ঘুমা।
না মা। চল।
চল।
মায়ের সঙ্গে সামনের ঘরের দিকে গেলাম। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। মা ছিটকিনি খুলল। আমি মায়ের হাত ধরে আছি।
বেরিয়ে ডায়াল ধরে সামনের দিকে যেতেই থমকে দাঁড়ালাম।
ওমা, ওটা কী দেখ! অনেকটা চিৎকার দিয়ে আঙুলে দেখিয়ে বললাম।
মা দাঁড়াল।
সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা একজন মানুষ উঠোনে হাত-পা মেলা। শোয়া। পাঞ্জাবির পেটের দিকটা রক্তে লাল।
ওমা রে...। ডাক দিয়ে মা মানুষটির কাছে গেল।
আমিও মায়ের পিছু নিলাম।
মানুষটি আর কেউ নন। মৌলানা শরাফত খান। পাশে একটা রক্তাক্ত ছোরা। মা লাশটির পাশে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি উন্মাদের মতো ছোরাটা হাতে তুলে নিলাম। ইচ্ছে করল শরাফত খানকে আরো কয়েকটা খোঁচা দি।
অ্যাই...। চিৎকার দিয়ে পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে এলো মৌলানা শরাফত খানের ছোট ভাই আলতাফ খান।
কী করেছিস? কী করেছিস? বলে আমার দিকে দৌড়ে আসতেই মা পথ আগলে দাঁড়াল।
ও খুন করেনি। মা জোর গলায় বলল।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি বলে আলতাফ খান আমাকে ধরতে এলো।
মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল।
আলতাফ খান উঠোনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল।
শেষ করে ফেললরে, শেষ করে ফেলল। আমার ভাইরে শেষ করে ফেলল।
আলতাফ খানের চিৎকারে বেশ লোক জমা হয়ে গেল।
সে সমানে আমার নামই মৌলানা শরাফাত খানের খুনি বলে চাউর করতে লাগল।
ছোরা উঠোনে ছুড়ে ফেলে এসেছিলাম।
মা হাঁক ছেড়ে বলে যাচ্ছে, আমি খুনি নই। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
অবশেষে থানায় খবর গেল। পুলিশ এলো। আমাকে ঘর থেকে বেরোতে বলল।
মা নিশাকে কোলে নিয়েছে। শিমু মায়ের আঁচল ধরে আছে। প্রতিবেশী মানুষেরা আমাকে অবাক হয়ে দেখছে।
পুলিশ জানতে চাইল, আমি খুন করেছি কি না?
বললাম, হ্যাঁ। আমিই খুন করেছি। ওই নরপিশাচকে আমি খুন করেছি। মা আর শিমু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
মা পুলিশকে বলল, ও খুন করেনি। খুন আমি করেছি।
পুলিশ মায়ের কথা শুনল না। আলতাফ খানের কথাই বিশ্বাস করল। আমাকে হাতকড়া পড়াল। নিশা কান্না করছে। মা নিশাকে বুকে চেপে রাখল। হাতকড়া ধরে আমাকে টান দিল পুলিশ।
(শেষ)