নূর সিদ্দিকীর গল্পগ্রন্থ ‘মেয়েটির পায়ে নূপুর ছিল’
নূর সিদ্দিকী মানুষের গল্প করতে ভালোবাসেন। সমাজ-সংসারের রোজকার খুঁটিনাটি তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। সমাজবীক্ষণের এই সুবিধাটি তিনি আরো বেশি করে পান এজন্য যে, পেশাগত কারণেই তিনি নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলেন দৈনন্দিন। টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে নগর থেকে গ্রামে আর্য-অনার্য বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় তাঁকে। হাজার মানুষের বহুবর্ণিল জীবনচরিত কখনো মুগ্ধ করে আবার কখনোবা ব্যথিত করে লেখককে। লেখক নিজেকে আবিষ্কার করেন সেসব মানুষের আত্মার আত্মীয়রূপে। সব মানুষের জীবনবোধেই তাড়িত হন তিনি। নিজে সেসব চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে তুলে আনেন আবহমান বাংলার চলমান গল্পরাশি।
আর লিখে ফেলেন ‘মেয়েটির পায়ে নূপুর ছিল’ নামে গল্পগ্রন্থ। বিভিন্ন পত্রিকায় গল্প প্রকাশের সুবাদে নূর সিদ্দিকীর লেখার সঙ্গে তাঁর পাঠকরা পূর্ব থেকেই সম্পৃক্ত।
সহজবোধ্য ভাষায় ঝরঝরে গদ্য লিখেন তিনি। বইমেলার প্রথম দিন থেকেই চৈতন্য প্রকাশনীর স্টল এবং লিটলম্যাগ চত্বরেএই গল্পের বইটি পাওয়া যাবে। বইটিতে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পসম্ভার ছাড়াও বেশ কয়েকটি নতুন গল্প রয়েছে। ‘বাবার হাত’, ‘তোরাব আলীর পয়সাভাগ্য’, ‘ক্ষমা অথবা অক্ষমতার গল্প’, ‘সাখাওয়াত টিপুর মৃত্যু ও মার্কেজের চিঠি’, ‘আমি ও আমার পূর্ব পুরুষেরা’, ‘মেয়েটির পায়ে নূপুর ছিল’, ‘করম আলীর বেঁচে থাকা’, ‘রেদু খা অথবা খয়রুদ্দির বাপের গল্প’, ‘ছাতুখোর’, ‘ডালিম শেখের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না’, শিরোনামে ১০টি গল্প স্থান পেয়েছে এই সংকলনে।
এই গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘বাবার হাত’ শিরোনামের গল্পটিতে একজন যৌনকর্মী চামেলীর জীবনকথা বিবৃত করেছেন লেখক। পুরুষতন্ত্র ন্যায্যতার ধার না ধেরেই চামেলীর মতো মানুষদের শরীরে সুখ খোঁজে ফেরে। আবার সেই চামেলীদের কাছেই জানতে চায় তার পিতৃপরিচয়। এক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের অবতারণা করেন লেখক। চামেলীর কাছে সুখভোগী সবাকেই মনে হয় তার বাবা।
সাভারের রানা প্লাজা ধসে নির্মমভাবে প্রাণ হারান রেনুকা নামের এক পোশাককর্মী। উদ্ধারকারীদের খোঁড়াখুঁড়িতে বেরিয়ে আসে রেনুকার একটি পা; যাতে নূপুর পরানো।
কিন্তু সেখানে নেই রেনুকার জীবৎকালের চিরচেনা সেই নিক্কন। নিঃশব্দ নূপুরটাই করুণ বিয়োগব্যথা হয়ে বাজে রেনুকার প্রিয়পুরুষ স্বামীর মনে।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিতের দাবিতে গড়ে উঠা ২০১৩ সালের শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের উপলব্ধি থেকে গল্পকার ‘ক্ষমা অথবা অক্ষমতার গল্পে’র প্লট গড়েছেন। আর ১৯৯০ সালের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার পর জমি হারানো নীল কমল সাধু ভাত খাওয়া ছেড়ে দিলেন কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই ‘ছাতুখোর’ গল্পের মূল উপজীব্য রচিত হয়েছে।
লেখক নূর সিদ্দিকী তাঁর এই গল্পসংকলনে কবি ও সাংবাদিক সাখাওয়াত টিপুকে নিয়ে ‘সাখাওয়াত টিপু’র মৃত্যু ও মার্কেজের চিঠি’ শীর্ষক গল্প লিখেছেন। বাস্তবের জীবিত সাখাওয়াত টিপু গল্পে প্রাণ হারিয়েছেন। বিশ্বসাহিত্যের দিকপাল কলম্বিয়ান গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জাদু বাস্তবতাকে মাথায় রেখে গল্পের নিপুণ গাঁথুনিতে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন লেখক। এভাবেই মানুষের জীবনালেখ্যের নিখাদ খড়কুটো জড়ো করে নিরন্তর বাবুই পাখির মতো গল্পের বাসা বুনে চলেছেন নূর সিদ্দিকী।
পাশ্চাত্য সাহিত্যবিশারদরা কল্পিত গদ্যকাহিনীগুলো দুই শ্রেণিতে ভাগ করেন- এক উপন্যাস, দুই ছোটগল্প। এই গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পই ছোটগল্পের আদল থেকে আয়তনে খানিকটা বড়। এগুলোকে স্বল্পগল্পও বলা যায়। ছোটগল্প প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপ্তবাক্য ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে না হইল শেষ’- অর্থাৎ লেখক থেমে গেলেন কিন্তু পাঠকের কৌতূহল যেন তারপর তারপর করতে থাকে; সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই গ্রন্থের ‘বাবার হাত’ বা ‘আমি ও আমার পূর্ব পুরুষেরা’সহ কয়েকটি গল্পের ক্ষেত্রে পাঠক কৌতূহলের নিষ্পত্তি ঘটেছে বলে বোধ করি।
তবে নিশ্চিতার্থেই ‘মেয়েটির পায়ে নূপুর ছিল’ গল্পগ্রন্থের কাহিনী ঘিরে অখণ্ড ইমোশন বা ভাবরস জমাট বেঁধে উঠে পাঠকের চিত্তকে অভিষিক্ত করে তুলবে। এখানে স্মিত ও করুণ এই দুই রসের মধ্য দিয়ে লেখকের হিউমারও বেশ জমে উঠেছে। তাই গল্পগুলোর রেশ পাঠকের চিত্তে লেগে থাকলেই তা হবে লেখকের সার্থকতা। আমরা এই গল্পগ্রন্থটির অশেষ ও অফুরান সাফল্য কামনা করি।
‘মেয়েটির পায়ে নূপুর ছিল’
প্রকাশক : চৈতন্য।
প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭।
৮৮ পৃষ্ঠা বইয়ের দাম ১৮০ টাকা।