বইয়ের আলাপ
গল্পকথার ডানায় সময় শূন্যতার বায়োস্কোপ
নাহ্ এ যেন শুধু গল্প নয়, কাব্য কিংবা গদ্য কোনোটাই নয়, এ যেন মায়াবাক্যের এ স্ফটিকস্তম্ভ। যার চারপাশে নানাবিধ অনুভূতির অলংকার সৃষ্টি করেছে এক জাদুর। গ্রন্থটির সূচিপত্র শুরু হওয়ার আগেই অনেকটা ভূমিকা বা মুখবন্দির ছাঁচে লেখা কিন্তু দুটোর কোনোটাই নয়।
২৩টি অণুগল্প, পাঁচটি গল্প ও নয়টি মুক্তগদ্য নিয়ে প্রামানিক ঘাট রোড, কলকাতা থেকে ঐহিক প্রকাশনীর প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘সময় শূন্যতার বায়োস্কোপ’ বইটির রচয়িতা এই সময়ের কবি মেঘ অদিতি। তিনি অনেকদিন ধরেই লিখছেন সুবিন্যস্ত লিরিক্যাল মায়া ভরা গদ্য। তিনি এমন ভাবে বাক্যের বৃক্ষে শব্দের ফুল গুজে দেন, যা পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।
গল্প বর্ণনায় সনাতন ধারা থেকে বেড়িয়ে এসে কাব্যের ঢঙে উপস্থাপন করেন বিষয়গুলো। আবার কোনো কোনো লেখার দৃশ্যপট কল্পনার বর্ণনাশৈলী সংক্ষিপ্ত শব্দসীমা ছাপিয়ে দীর্ঘতার দাবি রাখে। এই গ্রন্থ থেকে সেরকম কয়েকটি লেখা নিয়েই বলব কথালোচনা।
পাঠসূত্রের শুরুতেই রয়েছে ২৩টি অণুগল্প। যে গল্পগুলোর বেশির ভাগই ঝুরোগল্প নামে পরিচিত। এক বিরোধ সন্ধ্যার টেবিল দৃশ্য নিয়ে লেখা ‘একা রাই আর তার সন্ধ্যা’। এ গল্পে রাই নিজেকে উপস্থাপন করতে আয়নার চেয়ে বেশি সাজে সজ্জিত হয়ে দেখা করতে যায় সৌম্যের সঙ্গে। মাত্র ৪০ মিনিটের দৃশ্যে দেখা যায় দুজন মানুষ কাছে এসে হঠাৎ তিনজন হয়ে যাওয়ার দৃশ্য এবং গল্পের শেষ অধ্যায় এসে ঝলমল পুরোনো প্রেম সৌম্যকে রাইয়ের কাছ থেকে আলাদা করে দেয়।
পাঠকের মুখে তুলে দেওয়া আরো একটি ঝুরো গল্প ‘ভেঙে যায় মুখচ্ছবি, বারবার’। উত্তম পুরুষে বর্ণিত নারীকথার মায়াজালের গল্প এটি। পুরোনো স্মৃতির পাখায় ভর করে ভবিষ্যতের দরজা থেকে ঘুরে আসার কথামালা। কল্পরঙা কথাবুননে বিস্ময়ে উঠে এসেছে ম্যাপল রঙা বিষাদ। এই রকম স্মৃতিবাস আরেকটি গল্প ‘যদিও সন্ধ্যা’। উত্তম বয়ানে স্মৃতি থেকে ঘুরে বেড়াবার সম্পর্ক-সম্পর্ক গল্প।
মাতাল করা একটা নেই শব্দের দৃশ্যপট নিয়ে লেখা হয়েছে ‘দূরের শহরে’ গল্পটি। শব্দ-বাক্য-বুননের যে আশ্চর্য মুন্সিয়ানা আছে তাতে অবাক হতেই হয়। যার শুরুটা এরকম-
‘শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে হাইওয়ের পাশে সরু রাস্তাটা যেখানে হঠাৎ থেমে গেছে সেখানে বিকেল থেকে একটা মেটালিক ব্লু স্কাইরুফ হোন্ডা এয়ারওয়েভ দাঁড়িয়ে। দূরে ধানক্ষেত গড়িয়ে নেমে আসছে সন্ধ্যা। গাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে যে, তাকে দেখাচ্ছে পাথরে খোদাই করা এক মূর্তির মতো। তার দাঁড়াবার ভঙ্গিটি বহুসময় ধরে একই আছে। জায়গাটা পুরো অন্ধকার হয়নি তখনো।
সে ভাবছে তার নিজের শহরটার বয়স ঠিক কত হতে পারে। শহর বলতে এখন অব্দি সে তার নিজের শহরটাকে জানে। আর জানে মাথা উঁচু করা বিশাল কংক্রিটের ইমারতগুলো তার শহরকে মেরে ফেলতে চলেছে দ্রুত। অক্সিজেন কমে আসছে তার চাইতেও দ্রুত ভঙ্গিতে! হঠাৎ হাসি পেল তার। তারপর বুক থেকে ছিটকে এল এক ঝলক তপ্ত লাভা। সে তার শহরের বয়স নিয়ে ভাবছে কেন!’
পরবর্তী অধ্যায় আছে এক অভিমানী ভালোবাসার গল্প। এক অপূর্ণ সম্পর্কের গল্প। অতিপরিচিত যে গল্পগুলোর সমাপ্তি হয় চোখের জলের মতো করে, এ গল্পটি তেমনই। এই গল্পকথার সমাপ্তিটা শুকিয়ে গিয়েও তার জলের দাগ রেখে গেছে। এ রকম রেশ থেকে যাওয়া আরো এক গল্প ‘ভুলভুলাইয়া’। যেখানে চিহ্নিত হয়েছে ‘কাজের ঝি’ জফুরার কথা। নিজের পেটের জন্য এবং অন্যের পেটের জন্য রোজকার কাজ নিয়ে কেটে যায় তার দিন। মেশিনের মতো সারাদিন কাজ করেও সে স্বপ্ন দেখে, অচেনা কেউ তার যত্নের হাত বাড়িয়ে নিচ্ছে, কিন্তু স্বপ্ন সত্যি হয় না অথচ গল্পটি শেষ হয়ে যায়।
সরল আঙ্গিকের সম্পর্ক গল্পগুলোর মাঝে ‘এক অন্ধকারে’ গল্পটিতে দেখতে পাই একটি মেয়ে জীবনের বিভিন্ন সময়ের পুরুষ উপস্থিতির দৃশ্য। সম্পর্কগুলো শেষপরিণয়ে গিয়েও একসময় ভেঙে যায়। সরল বর্ণনার রেশ অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্তি টেনেছেন রচয়িতা।
‘ভগ্নাংশ’ গল্পটি পড়তে গিয়ে মনে আসে, ‘কারো পৌষমাস কারো সর্বনাশ’ প্রবাদ বাক্যটি। এই গল্পের দৃশ্যকল্পে তেমনটি উঠে এসছে। বিধবা সেতারা অল্প বয়সেই স্বামী হারিয়ে ছিল। উৎসবের দিনেও যার কাজ থাকত, তেমনি ঈদের দিনে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে দেখে তার ছেলে নিখোঁজ। এই গল্পের মাঝেও খুঁজে পাওয়া যায় একটি করুণ দিনের দৃশ্য। স্বামীর মৃত্যুতে বিহ্বল যখন সেতারা তখন কানের পাশে বাজতে থাকে পছন্দের মানুষের বিয়ের গান।
একটি দীর্ঘ গল্পের পটভূমিকে খুব সুক্ষ্মভাবে কেটে-ছেটে বেশ জমিয়ে ছোটগল্পে রুপান্তরিত করা গল্পটি ‘দূরগামী দূরবীন’ থেকে অনায়েসে এখানে জায়গা করে নিয়েছে। যে গল্পে একান্নবর্তী এক পরিবারের কাহিনীতে দেখতে পাই সন্দেহের তলোয়ার তাড়া করে নারী জীবনকে।
গ্রন্থে লিপিবদ্ধ এমন কিছু ঝুরো গল্প আছে যেগুলো পড়তে শুরু করলে মনে হয়- এ হয়তো গল্পের প্রারম্ভিকা। উপমা-বিচ্ছেদের পরই বুঝি গল্পের ডালপালা মেলবে কিন্তু ভাবনার সবটুকু জলশুষে নিয়ে গল্পটি উপমা পর্বের পরই শেষ হয়ে যায়। তেমন কিছু গল্পের শিরোনাম হলো- সিড়ি ভাঙার খেলা, বৃত্ত পেড়িয়ে, শূন্য, শূন্য, পনের ও দুঃস্বপ্ন।
অণুগল্পগুলোর পর লিপিবদ্ধ হয়েছে পাঁচটি গল্প। গল্পগুলো যথাক্রমে-খাণ্ডবদাহন, উড়ে যায় ছবিদের দুপুর, কালোপ্রজাপ্রতি অথবা ধ্বংসস্তূপ, ওহ দেবদূত ও ভ্রমণ অলীক নয়।
খাণ্ডবদাহন গল্পটি লেখা হয়েছে একটি মেয়ের শৈশব থেকে সাংসারিক জীবন পর্যন্ত চলে আসা সময়কে কেন্দ্র করে। সরল আত্মবয়ানের এই গল্পের বর্ণনা সুবিন্যস্ত বলেই এর দৃশ্যকল্প লেগে থাকে চোখে। নিচে তার কিছু অংশ তুলে দিলাম-
‘সোমা শান্তি পেতে চাইত একটা দীঘির কাছে। একরাশ ফুলের গন্ধের মাঝে। সে আরো চাইত জীবনে তার প্রার্থিত পুরুষটির আগমন ঘটুক খুব তাড়াতাড়ি। যাকে নিয়ে নিভৃত এক বাগান সাজাবে। সেই পুরুষ অথবা এক দীঘি টলটল জল, ভাবলেই সে গোপনে এক অহংকারী আয়না হয়ে উঠত। অথচ যখন সে এল, সোমার কেবলই মনে হতে থাকল যেন বা এক গনগনে চুল্লির ভেতরে নিজেকে সেঁদিয়ে দিয়েছে।’
এরপর আছে সায়না নামের মেয়েটির অপহৃত হওয়ার পূর্ব ও পরবর্তী অবস্থা নিয়ে গল্পকথন। যদিও গল্পের শিরোনাম এর মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনো ধারণা দেয় না। অপহরণ থেকে উদ্ধার পর্ব দিয়ে গল্পটি শেষ হয়। গল্পের নাম-উড়ে যাওয়া ছবিদের দুপুর।
সম্পর্ক আর পরকীয়া নিয়ে লেখা গল্পটার মূল চরিত্রে রয়েছে স্বামী ও স্ত্রী। অদ্ভুত সরলতায় দুজনার সয়ে যাওয়া তৃতীয় পক্ষের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া গল্পটির শিরোনাম ‘কালো প্রজাপ্রতি ও ধ্বংসস্তূপ’। রবীন্দ্রনাথের ‘ইচ্ছে পূরণ’ গল্পের মতো খানিকটা থিম নিয়ে আধুনিক ইচ্ছে পূরণের গল্পটির নাম ‘ওহ দেবদূত’। স্বপ্নে নির্দেশিত জায়গায় এসে রিনির দেখা হয়ে যায় দেবদূতের সঙ্গে। একটি মাত্র ইচ্ছে পূরণের সুযোগে, স্বামীর জীবনকার্যের রূপটি বেছে নেওয়ার পর থেকেই ঘটতে থাকে অসাধারণ সব ঘটনা। গল্পটা টানটান উত্তেজনার মুহূর্তে এনে সমাপ্তি ঘটিয়েছেন রচয়িতা। যদিও এর দৃশ্যকল্পের ধারা অর্ধেকটা পুরোনো তবে এতে যে নতুনত্ব দৃশ্যকল্প যোগ হয়েছে তাতে গল্পটি যেন তার পরিপূর্ণতা নিয়েই উপস্থিত হয়েছে।
ছোটগল্পের সমাহার শেষ হওয়ার পর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে নয়টি মুক্তগদ্য। প্রতিটি মুক্তগদ্যের শিরোনাম এক-একটি কাব্যগল্পের জন্ম দেয়। কখনো কথার পিঠে কথা, কখনো ভাষাগত আলোর খেলা আবার কখনো শব্দের জলতরঙ্গ বুনন। মুক্তগদ্যের শিরোনামগুলো হলো- ভ্রমণে সৃজন বোধে আলৌকিক, উড়ন্ত ডানার লিরিক, সময় শূন্যতার বায়োস্কোপ, এইখানে রাখ হাত, যখন অফবিটে পেরোচ্ছি বাঁক, কখনো আকাশ, মদিলিয়ানি ও বিভ্রম আকাশ, জার্নি জিরো টু ইনফিনিটি, জল থেকে সমুদ্র, পাহাড় বা বনতল চেয়ে আছে কে?
মুক্তগদ্যগুলো কথা বলে জীবনের গভীর সমুদ্রবার্তার, কখনো বা সাংসারিক দহনে ফুলে-ফেঁপে উঠে। আবার কখনো শব্দের ডানায় ভর করে অনন্ত দিগন্ত। যেমন ‘সময় শূন্যতার বায়োস্কোপ’ শিরোনামের লেখাটিতে খুঁজে পাই, পাতাঝরা দিনের কথা, স্মৃতির নদীর কথা, শহুরে জীবনের একঘেয়ে ব্যস্ততার মাঝে একটু শান্তির পরশ, একটু ভিন্নতা। এ ছাড়া বাকি সব রচিত গদ্যর নির্মাণকৌশল বেশ সুশৃঙ্খল যে কারণে এর পাঠে ক্লান্তির কোনো ছাপ পড়ে না।