বই আলোচনা
মুনির হাসানের ‘পড়ো পড়ো পড়ো’
মানুষের গল্প থাকে। কিংবা বলা যায়, এ জগতে প্রতিটি মানুষ বেড়ে ওঠে এক একটি গল্পের ভেতর দিয়েই। মানবজীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, প্রতিটি মানুষের জীবনই একটি ইতিহাস, কিন্তু সবার ইতিহাস রচিত হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনে আছে উত্থান-পতন, আছে সংগ্রাম, আছে দুঃখ-বেদনা, আছে ক্রমাগত স্বপ্নকে হাতে ধরার আক্ষেপ। মুনির হাসান তাঁর ‘পড়ো পড়ো পড়ো’ গ্রন্থে আলাপ করেছেন নিজের উত্থান-পতন, লড়াই নিয়েই। মুনির হাসানের এই বইটিকে আত্মজীবনী গ্রন্থ বলা যায়, তবে অন্যভাবে বলতে গেলে এটিকে ‘আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসই’ বলতে হয়। কারণ তাঁর ঝরঝরে গদ্য গল্পের মতো করে এগিয়েছে, যেখানে নায়ক স্বয়ং মুনির হাসান।
মুনির হাসান গল্পটা শুরু করেছেন ১৯৮৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। যখন তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বুয়েটে। তিনি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি হতেই এসেছেন। সেই গল্প বলতে গিয়ে বারবার গেছেন পেছনে। তাঁর মাথায় ঢুকে যাওয়া এক বড় ভাইয়ের আদেশ- ‘ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ’। কেন যেন মনে হবে বইয়ের শিরোনাম ‘পড়ো পড়ো পড়ো’ আর মুনির হাসানের মাথায় ‘ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ’- তিনটা বিষয় বলেই কি মুনির হাসান পড়ার কথা তিনবার বলেছেন? হবে হয়তো! লেখকের মর্জি। কিন্তু বিখ্যাত ব্যক্তিরা সবাইকে বলে থাকেন, ‘পড়ার কোনো বিকল্প নেই, তাই পড়ো পড়ো পড়ো’। হয়তো এই বিদ্যাও মুনির হাসান সবাইকে দিতে চেয়েছেন। দেখা যাক গ্রন্থে এর কোনো উত্তর পাওয়া যায় কি না!
যাইহোক, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মুনির হাসান একদিন গড়ে ওঠা মানুষ ছিলেন না। তিনি তিলে তিলে নিজেকে গড়েছেন ভেঙেছেন। তাঁর গড়ার মধ্যে, নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলে কিংবা নতুন করে আবিষ্কারের মধ্যে পাঠক এক ভিন্ন জগতের সন্ধান পাবেন। যে জগতে পাঠক জানতে পারবেন, বুয়েটে পড়া একজন সাধারণ ছেলের জীবন কেমন হয়। কীভাবে পড়ার চাপের ভেতরও সিলেবাসের বাইরে ছুটে গিয়ে অন্য জগতের সন্ধান করতে হয়।
যেমন, মুনির হাসান বুয়েটে এসে এক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। এই যুক্ত হওয়া কোনো ভিন্ন ধান্দা তাঁর মধ্যে কাজ করেনি। তিনি কিছু করার তাগিদে যুক্ত হয়েছেন। আর পেছনের ব্যাখ্যাও আছে। মুনির হাসান কলেজ জীবন থেকেই আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে সামনে রেখেছেন। ন্যায় পাওয়ার জন্য কলেজ থেকেই যে মুনির হাসান সোচ্চার ছিল, সে তো বুয়েটেও সেই স্লোগান দেবে। এ তো স্বাভাবিক। যেমন, কলেজে একবার হুট করেই প্রি-টেস্ট চালু করার সিদ্ধান্ত নিল। তখন অন্য সব বন্ধুকে নিয়ে মিছিল করে প্রিন্সিপালের রুমে হাজির হলেন তাঁরা। সেখানে তর্কাতর্কির মধ্যে মুনির হাসান নিজেকে আবিষ্কার করেন অন্যভাবে। তাঁর ভাষাতেই, ‘...দুই স্যারের সঙ্গে তর্কাতর্কি হলো এবং এক সময় আমি আবিষ্কার করলাম, কথাগুলো কেবল আমিই বলছি। অন্যরা চুপ।...’
এই প্রি-টেস্ট সমস্যা সমাধানে অভিভাবকদের ফাঁকি দিয়ে কীভাবে দাবি আদায় করে নিয়েছিলেন সে বর্ণনাও আছে গ্রন্থে। আছে কী করে নতুন ভবনের দাবিও তিনি সবাইকে নিয়ে আদায় করে নিয়েছেন সে গল্প। শুধু এমন আন্দোলন নয়, আলবদর রাজাকারদের নিয়ে যখন দেশে কথা বলা যেত না, তখন তিনি বন্ধুদের নিয়ে স্কুলের দেয়ালে চিকা মেরে দিলেন- ‘শিবির খেদাও’। শিবির তো রাজাকারদের দলেরই অংশ। এগুলো সাহসের গল্প। মুনির হাসান হয়তো নিজের সাহসের গল্প দিয়ে অন্য হাজার তরুণের সাহস জোগাতে চেয়েছেন। কারণ তাঁর সময়টা দেশের ক্রান্তিকাল। এক স্বৈর শাসকের হাত থেকে আরেক স্বৈর শাসক এরশাদের কবলে দেশ। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করার ওপরও ছিল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। ছিল রাজাকারদের ‘রাজাকার’ বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা। ছিল- দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব। সে ক্রান্তিকালে মুনির হাসান যদি সাহস দেখাতে পারেন, তবে বর্তমানে কেন তা সম্ভব না?
এমন সাহসী মুনির হাসানের শুরুতে জীবন নিয়ে তেমন লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু ক্লাস সিক্সের এক শিক্ষক ওয়াজিউল্লা স্যার গল্প হাজির করেন তিনি। যেই শিক্ষক তাঁকে প্রথম ভাবতে বাধ্য করেছিলেন জীবনের লক্ষ্য নিয়ে। তিনিই ভিন্নভাবে বাড়ির কাজ দেন ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখে নিয়ে আসতে। তাঁর স্যারের কথা বলতে গিয়ে মুনির হাসান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
“...কাজটা হলো ‘জীবনের লক্ষ্য’ এই শিরোনামে একটা রচনা লিখতে হবে, তবে সেটা বাজারের কোনো বইয়ের সঙ্গে মিলতে পারবে না। তখন স্যার বললেন নিজের চারপাশে তাকাতে এবং ‘কেন আমি কী হতে চাই’ সেটা ভেবে তাঁরপর নিজের মতো করে লিখতে। তিনি আমাদের এক মাস সময় দিলেন।...’
নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে মুনির হাসান ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামের মেঠো পথ। তিনি আসলে কী হতে চান? এমন প্রশ্নের উত্তরে কীভাবে নিজেকে আবিষ্কার করে নিতে হয় তেমন কিছু পথ পাঠক খুঁজে পাবেন। তবে বই আলোচনার পাঠকদের জানিয়ে রাখা ভালো, মুনির হাসান কখনো হতে চেয়েছিলেন কৃষক, কখনো ক্যানভাসার। তবে সবারই জানা মুনির হাসান পড়েছেন বুয়েটে। হয়েছেন প্রকৌশলী, করছেন বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার সংগঠকের কাজ? এমন প্রশ্ন পাঠকহৃদয়ে আসতেই পারে- যার উত্তরও মুনির হাসান দিয়েছেন গ্রন্থে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ... যে পেশাই বেছে নিই না কেন, আমার জীবনের লক্ষ্য হবে মানুষের সেবা করা, মানুষের জন্য কাজ করা।...
এভাবে পাঠককে নিজের স্কুল-কলেজ থেকে লেখক নিয়ে যাবেন নিজের বুয়েটের গল্পে। যেখানে নির্দিষ্ট করে বলবেন হলরুমগুলোর নম্বর। কত নম্বর রুমে কার সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর স্পষ্ট করে বলেছেন লেখক। বলতে হয়, আত্মজীবনী উপন্যাসে স্মৃতিশক্তি প্রখরতার ছাপ রেখেছেন লেখক। তাঁর সঙ্গে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাতের গল্পও আছে। যেমন বর্তমান সময়ের সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু এবং কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় পর্বগুলোর কথাও গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
আলোচনার এক অংশে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, মানুষের জীবনে উত্থান-পতন ঘটে। মুনির হাসানের জীবনেও পতনের সমূহ সম্ভবনা দেখা দিয়েছিল। পড়ার চাপে তিনি রওনা দিয়েছিলেন বুয়েট ছেড়ে চট্টগ্রামে। ভাবছিলেন আর ফিরবেন না। কিন্তু যাত্রাপথে আবারও নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করলেন লেখক। তিনি যে সাহসী, তিনি যে যোদ্ধা সে হিসেব নিজেই কষেছেন। শেষমেশ ফিরে নতুন করে লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। এ সময় বুয়েটে ফিরে এসে দেখা হয় বুয়েটের এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে, তিনি রুমি ভাই। যিনি তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, ... নিজের কাজটা করে যাওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ইবাদত, সর্বোত্তম প্রত্যয়। ফলাফল নিয়ে ভাবার কিছু নাই। প্রাণপণ এবং সর্বোচ্চ চেষ্টায় যা হবে সেটাই নিয়তি।...
এর পরই অবশ্য বইয়ের শিরোনাম সম্পর্কে ধারণা করা যায়। সেই রুমি ভাই মুনির হাসানকে বলে গিয়েছিলেন- পড়ো পড়ো পড়ো। যা মুনির হাসানের মাথায় আটকে যায়। হয়ে যায় একটি আত্মজীবনী গ্রন্থের শিরোনাম!
ক্রমাগত মুনির হাসান দেশের উত্তাল সময়ে সন্ধান করেছেন জ্ঞানের। নতুন জ্ঞান কোথায় পাওয়া যায় সেখানে হাজির হয়েছেন। নিজেকে তৈরি করেছেন। হয়তো তিনি জানতেন দেশের এই ক্রান্তিকাল দীর্ঘস্থায়ী নয়। একদিন না একদিন এই অন্ধকার কেটে যাবেই, তখন দেশকে তিনি কতটা দিতে পারবেন। এই ভাবনা হয়তো ছিল মুনির হাসানের। আর তাই কখনো তিনি হাজির হয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের লাইব্রেরিতে, দেখেছেন চলচ্চিত্র, কখনো কোনো বিজ্ঞান আড্ডায়, কখনো পত্রিকার অফিসে। ঘুরে ফিরেছেন প্রান্তর, পড়ার চেষ্টা করেছেন মানুষের মন, বের করতে চেয়েছেন রাষ্ট্রের অবস্থান। যে অবস্থান থেকে তিনি নতুন করে শুরু করবেন সব কিছু। মুনির হাসানের বুয়েটের শেষ সময়ে এরশাদের পতন হয়। সেই পতন মুনির হাসানকে যে নতুন জগৎ সৃষ্টির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সেটা অনুমেয়। তাঁর এই গ্রন্থে আছে অনেক গ্রন্থের নাম, আছে চলচ্চিত্রের নাম, বক্তৃতার নাম- যা তরুণদের নতুন জগৎ সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
বই আলোচনায় আরো বক্তব্যও নাকি রাখতে হয়। অর্থাৎ লেখকের লেখায় কী কী ঘাটতি ছিল। প্রথমত বলতে হয়, লেখকের এই গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বও দাবি করে। মানুষের জীবন তো ছোট নয়, উপর থেকে দেখলে অনেক বড়। আরো গল্প তো আছে, যা পাঠক জানতে চাবেই। দ্বিতীয়ত, মুনির হাসান তাঁর রাজনৈতিক দাবি কিংবা স্কুল-কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবিগুলো আদায়ে নিজের সোচ্চার হওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা যেভাবে দিয়েছেন ঠিক সেভাবে বিস্তারিত বর্ণনা নেই বুয়েটের পড়াশোনা প্রসঙ্গে। ক্লাসের অভিজ্ঞতা, শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক, কী পেরেছেন, কী কঠিন, কীভাবে সমাধান করেছেন সেসব খুব দ্রুত বলার চেষ্টা ছিল লেখায়। কিন্তু প্রত্যেকের ক্লাসের মজার মজার ঘটনা ঘটে, অনেক বন্ধুর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা ঘটে যা হৃদয়ে দাগ ফেলে এমন কিছু পাঠক হিসেবে মনে হচ্ছিল দেখতে পাব কিন্তু মুনির হাসান নিজেকে ব্যাখ্যাতেই যেন মনোনিবেশ করেছেন বেশি।
বইয়ের প্রডাকশন ভালো। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। বইটি প্রকাশ করেছে আদর্শ, প্রকাশনা বছর ২০১৬। বইটির মূল্য ২৫০ টাকা।