ক্রুশবিদ্ধ কলম
বইটি চলমান ইতিহাসের অন্তর্গত
Fact যেখানে fictionকে ক্রমাগত অতিক্রম করে যেতে থাকে সেখানে লোকে কি আর fiction পড়তে আগ্রহবোধ করে ? বাংলাদেশে তো ১৯৭২ সাল থেকেই এই অবস্থা দেখে আসছি।
এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তিতে সাধিত হয়েছে বিপ্লব। উৎপাদন ও সম্পদ বেড়ে চলেছে, অন্যায় অবিচার জুলুম-জবরদস্তি ও অসাম্য বাড়ছে। ইন্টারনেট ও অন-লাইন অ্যাকটিভিটিজ অলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের কল্পকাহিনীকে ম্লান করে দিয়েছে। মানুষ যন্ত্রের গতিতে চলছে, বিচার-বিবেচনা নেই, বিচার-বিবেচনার সুযোগও নেই। এরই মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ঘটেছে, পৃথিবী হয়ে পড়েছে এক-কেন্দ্রিক-ওয়াশিংটন- কেন্দ্রিক। মানবীয় সম্পর্ক, যে রূপ নিয়েছে তাতে একদিকে প্রবল, অপরদিকে দুর্বল, অন্যকথায় একদিকে জালেম অন্যদিকে মজলুম।
এই বাস্তবতায় মানুষের পরস্পরিক সম্পর্ক একেবারেই শিথিল। কখনো কখনো মনে হয় বালুর কণার মতো, ধূলার কণার মতো- মানুষ একত্রই আছে কিন্তু পরস্পরবিচ্ছিন্ন। মানুষ মানুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না, পরস্পরকে জানতে চায় না। জীবনানন্দের ভাষায় ‘প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই।’
এই বাস্তবতায় সাহিত্যই-বা কী হতে পারে। নতুন কালের নতুন মধুসূদন, নতুন বঙ্কিমচন্দ্র, নতুন রবীন্দ্রনাথ, নতুন শরৎচন্দ্র, নতুন বেগম রোকেয়া, নতুন নজরুল ইসলাম, নতুন জীবনানন্দ কি আত্মপ্রকাশ করবেন। বলা হয় সাহিত্যে বিষয়বস্তু গৌণ, রচনারীতি মুখ্য। এই ধারণা নিয়ে কি কেউ লোকোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ কিছু সৃষ্টি করতে পারবেন। বলা হয় master discourse এবং grand narratives-এর দিন শেষ। দিন আছে কীসের?
শামস সাইদের ‘ক্রুশবিদ্ধ কলম’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে লিখতে গিয়ে এসব কথা মনে জাগছে। কথাগুলো ব্যক্ত করলাম, কেউ কেউ পড়বেন এবং চলমান বাস্তবতাকে পেছনে ফেলে শুদ্ধতর নতুন বাস্তবতা সৃষ্টিতে আগ্রহী হবেন এই আশায়। Litereture is the criticism of life এই কথাটি উপন্যাস প্রসঙ্গেই সবচেয়ে বেশি স্মরণযোগ্য।
শামস সাইদের এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু চলমান ইতিহাসের অন্তর্গত। অভিজিৎ রায়, ফয়সাল আরেফিন দীপন প্রমুখের হত্যাকাণ্ড এবং তাঁদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের দুঃখ বেদনা ও ক্ষয়ক্ষতি যেভাবে অনুভব করেছেন শামস সাইদ তারই এক মর্মান্তিক বিবরণ তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনাও যুক্ত হয়েছে এবং তা দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্যের বাস্তবতা। পড়তে গিয়ে বারবার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে। হয়তো অভিজিৎ আমার পরিচিত বলে এবং দীপন আমার ছেলে বলে! প্রতিদিন দু-চারবার দীপন স্মৃতিতে আসে, চোখ থেকে পানি পড়ে। দীপন নেই, আমি বেঁচে আছি, এই বেঁচে থাকাটাকেই অপরাধ বলে মনে হয়।
শামস সাইদের লেখায় সামর্থ্যরে পরিচয় আছে, তাঁর আগ্রহ আছে, জীবন নিয়ে অনুসন্ধিৎসা আছে, জ্ঞানুসন্ধিৎসা আছে, বিষয়বস্তু ও রচনারীতি দুটার প্রতিই তাঁর মনোযোগ আছে, আমার মনে হয়েছে এ বই পড়ে পাঠক জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে আগ্রহী হবেন- মানুষ সম্পর্কে আগ্রহী হবেন। স্নেহ, প্রেম, শ্রদ্ধা, সম্প্রীতি ইত্যাদি বিষয়কে নতুন করে আবিষ্কার করার এবং জীবন উপলব্ধি করার আগ্রহ জাগলে যেকোনো উপন্যাস পড়া সার্থক হয়। আমার ধারণায় আজকাল যে ধরনের উপন্যাস লেখা হয় সেগুলোর তুলনায় শামস সাইদের এ উপন্যাস সামনের দিকে স্থান পাওয়ার মতো।
অভিজিৎ, রাজীব, অনন্ত, দীপন- এঁরা প্রত্যেকেই মানুষ ছিলেন অসাধারণ ভালো। এই ভালো মানুষগুলো প্রাণ হারালেন। এর পেছনে যে রাজনীতি ক্রিয়াশীল তার স্বরূপ উন্মোচন দরকার। আসল অপরাধী এই রাজনীতিই এবং তা কোনো একপাক্ষিক ব্যাপার নয়। একহাতে তালি বাজে না। মৌলবাদ fundamentalism এসব কথা কারা উদ্ভাবন করেছেন? কেন উদ্ভাবন করেছেন? ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশ কি মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য তৈরি ছিল? সময়ের চাহিদা কী ছিল? আন্দোলনের ফলাফল কী হয়েছে? গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজতে ইসলামের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কীভাবে দেখা দিল এবং এসবের ফলাফল কী হয়েছে? জঙ্গিবাদ বা armed Islamic fundamentalism তালেবান, আলকায়েদা, আইএস, জেএমবি ইত্যাদির উত্থান কেন কীভাবে ঘটল? মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে জনগণ কেমন আছে এবং তারা কী চায়? এসব নিয়ে একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস বাংলায় রচিত হতে পারে। বাংলা ভাষার দেশে কেউ কেউ যদি এ রকম উপন্যাস লেখার চেষ্টা করতেন এবং তাতে অভিজিৎ, রাজিব, দীপন, অনন্ত, ওয়াশিকুর নীলাদ্রি, নাজিম উদ্দিন সামাদ প্রমুখের নামও স্থান পেত তাহলে তা এক অমর উপন্যাস হতো। এর জন্য লেখককে অবশ্যই সত্যশুদ্ধ হতে হবে, উপন্যাস রচনার অন্যসব গুণের অধিকারী হতে হবে।
শামস সাইদের ‘ক্রশবিদ্ধ কলম’ উপন্যাসটি ব্যাপকভাবে পঠিত হলে এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে কৌতূহল দেখা দিলে, নতুন চিন্তা-ভাবনা দেখা দিলে তা বাংলাদেশে সবার জন্য কল্যাণকর হবে।
বইটি প্রকাশ করেছে ‘বেহুলাবাংলা’। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।
বইটির মূল্য ৪০০ টাকা।