বই আলোচনা
লেখালেখির জন্য ছয়টি বই
সৃষ্টিশীল কাজের সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে কাজটি করার জন্য এক জায়গায় স্থির হয়ে বসা। সৃজনশীলতা বের করে আনার অনেক উপায় রয়েছে। অনেক লেখক বলবেন, অনুপ্রেরণা না পেলে তাঁরা লেখালেখি শুরু করতে পারেন না। আবার অনেক লেখক প্রতিদিন লিখে যাচ্ছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, একদিন না একদিন তাঁদের লেখা প্রকাশ পাবে। লেখকরা তো শিল্পী, তো অনেক শিল্পী জোর দেন মৌলিকতার ওপর, অনেকে বিশ্বাস করেন যে সেরা লেখকরা হাত পাতেন, ধার করেন বা অন্য শিল্পীর কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তা নিজের মতো করে তৈরি করেন। বহু সৃজনশীল ব্যক্তি যেমন কাজের সময় ক্যাফেতে বসে উচ্চ শব্দে গান শুনতে পছন্দ করেন, আবার কেউ বা খোঁজেন নীরবতা।
কোন পরিবেশে, কীভাবে, কিসের প্রভাবে সৃষ্টি হবে, সেটি বের করার সঠিক কোনো পথ নেই। কিন্তু কোনো বিষয় যদি আমাদের আলোড়িত করে, সেটিই কিন্তু নিজস্ব শৈল্পিক রেখাচিত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখে। আমরা জানি, বই আমাদের মনোজগতে আলোড়ন তোলে খুব সহজে। বই আমাদের অনুপ্রাণিত করে। মিডিয়া ডটকমের সৌজন্যে এখানে ছয়টি বইয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা দেওয়া হলো। বলা হয়, এই ছয় বই সব সৃষ্টিশীল মানুষেরই পড়া উচিত।
১. দ্য ওয়ার অব আর্ট
যেকোনো সৃজনশীল কাজে বাধা আসবেই। যদি আপনি এই বাধার বিরুদ্ধে কোনো লড়াই করে থাকেন, তাহলে ‘দ্য ওয়ার অব আর্ট’ বইটি আপনার জন্যই। সাফল্যের জন্য আপনার সৃজনশীল চেষ্টাগুলোকে ত্বরান্বিত করতে, এটি পথপ্রদর্শকের কাজ করবে। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক স্টিভেন প্রেসফিল্ড বইটিতে সে শত্রুর কথাই আলোচনা করেছেন, যার মুখোমুখি প্রত্যেক শিল্পীকেই সব সময় হতে হয়, যে বাধা আপনার কাজকে বারবার থামিয়ে দেয়। যাঁরা বারবার সৃষ্টিশীলতার পথে ও জীবনের লক্ষ্যে ধাক্কা খেয়েছেন, তাঁদের ভয়কে উড়িয়ে দিতে এই বইয়ের বিকল্প নেই। আপনি লেখক, চিত্রশিল্পী বা কারিগরি উদ্যোক্তা যা-ই হোন না কেন, বইটি আপনার জন্য অনুপ্রেরণামূলক হবে।
২. অন রাইটিং
স্টিফেন কিংয়ের স্মৃতিকথার অংশবিশেষ পড়ার সৌভাগ্য, সঙ্গে লেখালেখি নিয়ে নির্দেশিকা—এ দুইয়ের সংমিশ্রণে ‘অন রাইটিং’ বইটি পড়ে ফেলা, যেকোনো লেখকের জন্যই বাধ্যতামূলক। ৫০টির অধিক বইয়ের জনক স্টিফেন কিং। তাই শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান অনুমান করা যায়। তিনি সরাসরি তাঁর কলেজের দিনগুলোর পাশাপাশি একজন কৌশলী লেখকের লেখা ও লেখার সরঞ্জাম নিয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তাঁর প্রিয় কিছু পরামর্শ হচ্ছে, প্রচুর ভালো বই পড়তে হবে। প্রতিদিন লিখতে হবে। এগুলোর পাশাপাশি এমনভাবে আপনার গল্প বলবেন, যাতে পাঠক তাঁদের কল্পনার জগতে আপনার লেখার চরিত্রগুলো দেখতে পায় এবং সব সময় নিজের ওপর ভরসা রাখতে হবে। যে বইয়ে এ রকম উপদেশ আছে, সে বইটি যে একটি খাঁটি রত্ন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
৩. স্টিল লাইক অ্যান আর্টিস্ট
‘স্টিল লাইক অ্যান আর্টিস্ট’ ১৬০ পৃষ্ঠার চমৎকার একটি বই। এমনকি বইটির সাদাকালো ছবিগুলো কেটে আপনার পড়ার টেবিলের সামনে লাগাতে ইচ্ছে করবে। যখন অস্টিন ক্লেয়নের লেখা বইটি আপনি পড়বেন তখন মনে হবে, আপনি যেন আপনার খুব ভালো একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন। বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর প্রতিজ্ঞা, একজন শিল্পী হওয়া মানে নিজের মধ্যে বিদ্যমান থাকা। সৃজনশীলতার গোপন সত্যও তিনি আমাদের জানিয়েছেন, কোনো আসল লেখাই সত্যিকারের আসল লেখা নয় আর সেটাই ভালোর থেকে বেশি ভালো।
লেখা-সংক্রান্ত তাঁর অন্যান্য পরামর্শ হচ্ছে, সে বইটি লিখুন যা আপনি পড়তে চাইছেন। আপনি শুরু করার কে, তা ভাবার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই এবং সুন্দর করে লিখুন। এটি এমন একটি বই, যা আপনি আপনার কফি টেবিলের ওপর রাখতে চাইবেন এবং তখনই এর পাতা উল্টাবেন, যখন আপনার একটু প্রেরণা দরকার।
৪. বিগ ম্যাজিক
সর্বাধিক বিক্রীত ‘ইট প্রে লাভ’-এর মতো উপন্যাসের বিখ্যাত লেখিকা এলিজাবেথ গিলবার্টের লেখালেখি-সংক্রান্ত আরেকটি বই ‘বিগ ম্যাজিক : ক্রিয়েটিভ লিভিং বিয়ন্ড ফিয়ার’। যাঁরা অন্যের লেখা অনুসরণ করে লিখতে ভালোবাসেন, বইটিতে লেখিকা তাঁদের সুরেই কথা বলেছেন। গিলবার্ট তাঁদের হয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন যে আমরা সবাই নির্বিশেষে আমাদের পেশা ও শখের ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল কাজ করছি।
বিগ ম্যাজিক বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায়টি হলো, যেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন সৃষ্টিশীলতার ধারণা ও লেখকের মধ্যে সেটার অস্তিত্ব। তিনি সেই ধারণার কথা বলেছেন, যা একজন থেকে অপরজনে ভেসে যেতে থাকবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত কেউ তৈরি হয় জীবনের প্রকৃত ধারণাকে উপলব্ধি করতে। যদি কখনো কোনো বই পড়ে বা কোনো চিন্তা বা ধারণার শুরু থেকে মনে হয়, আরে এমন তো আমি অনেক আগেই ভেবেছিলাম, তাহলে এই অধ্যায় একাই আপনার সেসব ভাবনার পক্ষে দাঁড়াবে এবং প্রায়ই আপনার আরো ভাবনাগুলোর বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখাবে। সৃষ্টিশীলতা কী, জানতে হলে আপনি এই বই থেকে দূরে সরে থাকতে পারবেন না।
৫. বার্ড বাই বার্ড
আপনি লেখার কৌশল নিয়ে অনেক বই খুঁজে পাবেন। কিন্তু এত সব বইয়ের মধ্যে যদি সেরা একটি বই পড়তে চান, তাহলে আপনার ‘বার্ড বাই বার্ড’ বইটি পড়ে দেখা উচিত। লেখিকা অ্যানি ল্যামট যে লেখা-সমুদ্রের গুপ্তধন, তা আপনি দেখতে পাবেন যখন আপনি সেই লেখায় ডুব দেবেন। তাঁর লেখার ধরনের সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে ফ্লিটউড ম্যাকের ‘গো ইউর অউন ওয়ে’ গানটি মনে পড়ে যায় এবং তাঁর লেখা যে আপন পথেই গিয়েছে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
স্টিফেন কিংয়ের ‘অন রাইটিং’-এর মতো ল্যামটের ‘বার্ড বাই বার্ড’ বইটি লেখালেখি ও জীবন-সংক্রান্ত পরামর্শের সংকলন। তাঁর গল্পগুলো আপনাকে শেষ পর্যন্ত আটকে রাখবে মুগ্ধতায় এবং এটি আপনাকে হাসাবে ও কাঁদাবে। তাঁর প্রধান পরামর্শ হচ্ছে লেখার প্রথম খসড়া লিখতে কখনো ভয় পাওয়া উচিত নয়, তা যত জঘন্যই হোক। এই প্রথম খসড়া কাউকে দেখানো উচিত নয় এবং প্রতিদিন অন্তত ৩০০ শব্দ লেখা উচিত। এই বইটি অবশ্যই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও মৌসুমি লেখকদের জন্য উষ্ণ আলিঙ্গনের অনুভূতি দেবে।
৬. দি আর্টিস্ট’স ওয়ে
“দি আর্টিস্ট’স ওয়ে” ক্রমবিন্যাস পদ্ধতিতে লেখা হয়েছে। বইটি আপনাকে ১২ সপ্তাহের বিভিন্ন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত করবে, যা ভেতরের সৃষ্টিশীলতাকে উন্মুক্ত করবে। যদি আপনি ব্লগ লিখতে মুশকিলে পড়েন, তাহলে বইটি পড়ে আপনি যথেষ্ট লাভবান হবেন। তবে বইটির শর্তসমূহের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। যদি আপনি শর্তমাফিক অনুশীলন না করেন, তাহলে আপনি যতই বইটির কাছে যাবেন, ততই এর থেকে দূরে সরতে থাকবেন। তবে যদি আপনি আপনার সৃষ্টিশীলতা উদ্ধারে অঙ্গীকারবদ্ধ হন এবং ধাপে ধাপে এর প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করেন, তাহলে এ বইটি আপনার জন্য অবিশ্বাস্যভাবে উপকারী হতে পারে। বইটির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুশীলন হচ্ছে মর্নিং পেজেস (সকালের পৃষ্ঠা), যখন আপনি লেখালেখি করাকে আপনার জন্য নির্দিষ্ট করে ফেলবেন, তখন কোনো বিরতি না দিয়ে গোটা তিন পৃষ্ঠা লিখে ফেলুন। এ ছাড়া আরো অনেক জনপ্রিয় অনুশীলন সম্পর্কে আপনি এই বই থেকে জানতে পারবেন।
আশা করি, এ তালিকা থেকে আপনার জন্য উপযোগী বই খুঁজে পেয়েছেন, যা আপনার সৃজনশীল প্রতিভাকে উন্মুক্ত করবে। যদি আপনি আপনার সৃষ্টিশীল যাত্রা শুরু করতে চান এবং যাত্রার সরঞ্জাম ও পুঁজি খুঁজতে সহয়তা চান, তাহলে আপনার বইগুলো অবশ্যই পড়া উচিত।