নারীর দাস জীবন নিয়ে সাদিয়া নাসরিনের বাহাস
বাংলাদেশের নারী আন্দোলন নতুন কোনো বাস্তবতা নয়। দীর্ঘ সময় ধরে নারীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সোচ্চার। কেউ কর্মক্ষেত্রে নিজের অধিকার আদায়ের কথা বলেন, কেউ রাজনীতির মাধ্যমে। তবে লেখালেখির মাধ্যমে নারীদের উদ্বুদ্ধের কাজটিও সমগতিতে চলছে দীর্ঘ সময় ধরেই। একসময় তসলিমা নাসরিন সোচ্চার ছিলেন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায়। অবশ্য ছিল বললে ভুল হবে; নারী অধিকারের কথা বলতে গিয়ে সেকেলে পুরুষতন্ত্রকে আঘাত করে তসলিমা নাসরিন হয়েছেন নির্বাসিত। বলতে হয়, তসলিমা নাসরিন নির্বাসিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর চিন্তা-চেতনা ঠিকই প্রবাহিত হয়েছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। তসলিমা নাসরিন এখনো দেশের বাইরে থেকেও নারী অধিকার বিষয়ে জোরালোভাবেই লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর যুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের বহু নারী চালিয়ে যাচ্ছেন কলমযুদ্ধ। তাঁদের একজন সাদিয়া নাসরিন।
সাদিয়া নাসরিন লেখেন অন্তর্জালে। কখনো ফেসবুকের স্ট্যাটাসে কিংবা কখনো অনলাইন পোর্টালগুলোতে লেখার মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধ। সে ধারাবাহিকতারই নতুন সংযোজন হলো এ বছরের একুশে বইমেলায় তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই ‘দাস জীবনের মালিক নারী?’
বইয়ের লেখাগুলোতে সাদিয়া নারীদের ভেঙে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। বলতে চেয়েছেন পুরুষ নিজের স্বার্থেই আইন করে, নিয়ম করে, শৃঙ্খল তৈরি করে। তবুও নারীকে তার দরকার। তাই নারীকে সে ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে রাখে। সাদিয়া একই ধারে কথা বলেছেন পুরুষের কৌশল নিয়ে, অন্যদিকে বলেছেন নারীকে জাগ্রত হতে হবে।
একই সঙ্গে সমাজের দিকেও আঙুল তুলে সাদিয়া বলেছেন, যে নারী রোজগার করে সমাজ তাকে ‘বেচারা’ বলে। অথচ সমাজ তার রোজগারকে মূল্যের চোখে দেখে না। সাদিয়া তাঁর প্রথম কলামেই বলেছেন, ‘নারী ডিগ্রি অর্জন করেছে, কিন্তু শিক্ষিত হয়নি; উপার্জন করেছে, কিন্তু স্বামীর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারেনি। কখনো ধর্ম, কখনো ভালোবাসা, কখনো আবেগ দিয়ে পুরুষ এই নারীদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে যুগ যুগ ধরে।’
নারীর সব আছে, তবুও সে মুক্ত হতে পারে না, কোথাও না কোথাও নিজেকে আটকে রাখে। সে সংসারের ভেতরই সুখ খুঁজে নেয়। অথচ বাইরে বের হওয়ার সুখ অন্তরে রেখেও সে বের হয় না। নারী কথা বলতে চায় না, সে পুরুষের বুলিই মুখ দিয়ে আওড়ায় মুখোশ পরে। নারী শিক্ষিত হয়ে নিজের পদবি তৈরিতে ব্যস্ত হয় না। সে তার স্বামীর পদবিতেই সন্তুষ্ট হয়। আর নারীর এহেন স্বভাবকেই সাদিয়া নাসরিন ইঙ্গিত দিয়ে তুলনা করেছেন দাস জীবনের সঙ্গে।
সাদিয়া নাসরিন ব্যবচ্ছেদ করেছেন নারীর। তিনি ভালো মেয়ে-খারাপ মেয়ে তুলনা দাঁড় করিয়েছেন। যে তুলনা সমাজ করে। সেই তুলনায় লেখক বোঝাতে চেয়েছেন পুরুষের তৈরি করা এই ব্যবচ্ছেদে নারীর স্বাধীনতার সব কাজকেই খারাপ হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে। লেখকের গ্রন্থের ‘ভালো খারাপের দোলাচলে আমার জীবন কই?’ কলামে পাওয়া যায় সেই ভালো মেয়ে-খারাপ মেয়ের ইঙ্গিত। সেই কলামের কয়েকটি লাইন তুলে ধরা যাক :
‘...ভালো মেয়ে পা গুটিয়ে বসতে জানে, কাপড় ঠিক রেখেই শুতে জানে। ভালো মেয়ে আদব লেহাজ মেনে কথা বলে। ভালো মেয়ে ভালো রাখে, ভালো মেয়ে আপস করে। ভালো মেয়ে কথায় কথায় ফোস করে না। ভালো মেয়ে দেনা পাওনার হিসাব করে না। ভালো মেয়ে আকাশ দেখে না, জীবন খুঁজে মরে না। ভালো মেয়ে নিজের জন্য বাঁচতে শিখে না। ভালো মেয়ে পুরুষের জন্য নিজেকে সাজায়, পুরুষ যেভাবে যখন যতটুকু চায়।...’
শুধু তাই নয়, এ সমাজের পুরুষরা নিজের মতো করেই তৈরি করছে ভাষা। সেই ভাষাতেই তৈরি করছে প্রবাদ। লেখকের ‘নারীর প্রতিবাদের ভাষা’ অধ্যায়টি তাই শুরু করেছেন ‘জেন্টললেডিস অ্যান্ড ম্যান দিয়ে’। সাদিয়া নাসরিন বোঝাতে চেয়েছে পুরুষতন্ত্র কতটা সূক্ষ্মভাবে ‘ম্যান’কে জেন্টল করে দিয়েছেন আর ‘লেডিস’কে শুধু লেডিসই করে রেখেছে।
এত কিছুর মধ্যেও সাদিয়া নাসরিন প্রশ্ন ছুড়েছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীবাদকে বোঝা কি সহজ?
এই প্রশ্নের উত্তরে যে অধ্যায় লেখক সাজিয়েছেন তাকে স্পষ্ট তুলে ধরেছেন নারীবাদ সম্পর্কে পুরুষের মনোভাব। এ দেশের অধিকাংশ পুরুষই যে নারীবাদকে পুরুষবিদ্বেষী হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন, তা অকপটেই লেখক বলেছেন বইয়ে। লেখক বলতে চেয়েছেন পুরুষ সব বোঝে, সে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজতন্ত্র সব বোঝে; কিন্তু কেন যেন নারীবাদ বুঝতে চায় না। নারীবাদের কথা আসলেই শুরু করে বিতর্ক। আর এই বিতর্ককে লেখক বলতে চেয়েছেন ‘অহেতুক বিতর্ক’।
পুরুষতন্ত্রের দেয়ালে আঘাত করতে গিয়ে বাদ যায়নি জঙ্গিবাদের ইস্যুটিও। যখন শহর কিংবা শহরের আশপাশে জঙ্গি অভিযানে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তখন ‘নারীজঙ্গি’ শব্দ ব্যবহারে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন সাদিয়া নাসরিন। ‘জঙ্গি’ তো জঙ্গি, ‘পুরুষ জঙ্গি’ শব্দ যেহেতু আমরা ব্যবহার করি না, সে ক্ষেত্রে কেন ব্যবহার করছি ‘নারী জঙ্গি’ শব্দ? এমন বিষয়টিও এড়িয়ে যাননি লেখক।
বইটির ভেতর সময়কে ধারণ হয়েছে কয়েকটি অধ্যায়। ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া নারীদের ওপর নিপীড়ন-অত্যাচার- নৃশংসতা নিয়ে কলামগুলো ঠাঁই পেয়েছে এ বইয়ে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো ‘তোমাকে অভিনন্দন সালমা’, ‘খাদিজার জয় হোক, বদরুলের ফাঁসি হোক’ ইত্যাদি।
পুরুষতন্ত্রে জর্জরিত এই সমাজে অবস্থানরত নারীদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড় করানোর অনুপ্রেরণা জোগাবে সাদিয়া নাসরিন রচিত ‘দাস জীবনের মালিক নারী’ বইটির মোট ৩৮টি কলাম। তবুও সাদিয়া নাসরিন অনেক প্রশ্নের উত্তর দেননি, তিনি পুরুষতন্ত্র সমাজকে দোষ দিয়েছেন, দুর্বল নারীকে খোঁচা মেরেছেন, বলতে চেয়েছেন নারীবাদ বোঝে না সমাজ কিংবা নারীবাদ বোঝে না পুরুষকুল, কিংবা নারীবাদ নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় পুরুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব কারণ অনুসন্ধান করেননি সাদিয়া নাসরিন। পুরুষ কেন বুঝতে চায় না। এর উত্তর কিঞ্চিৎ স্পর্শ করেছেন লেখক। কিন্তু এসব পুরোনো বিষয়ই তুলে ধরেছে। বহুকাল ধরেই নারীবাদরা বলতে চাইছেন, সমাজে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে রাখতেই পুরুষরা নারীবাদকে কটু দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু বর্তমান আধুনিক বাস্তবতায় বিচার করেছে কি কেউ? আসলেও কি এখনো শিক্ষিত সমাজে এ জন্যই পুরুষতন্ত্রকে জিইয়ে রাখতে চাইছে? নারীবাদকে কেন তারা প্রশ্রয় দিচ্ছে না? আদৌ কি নারীবাদে ভিন্ন কোনো রাজনীতি কিংবা বাস্তবতা যোগ হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তরসহ নারীবাদ নিয়ে যারা সোচ্চার, তাদের কর্মপদ্ধতি দিয়ে আলোচনা এবং সমালোচনা থাকলে বইটি আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠত বলেই মনে হয়েছে।
সমাজে নারীবাদের অবস্থান, তাদের সংগ্রাম-যুদ্ধ, রাজনীতি, নারীবাদ শব্দটিকে ব্যবহার করে একশ্রেণির জনপ্রিয়তা পাওয়ার অপচেষ্টা—এসব কিছুর সংমিশ্রণে ভবিষ্যতে নিশ্চয় আরো পুস্তক রচনা করবেন সাদিয়া নাসরিন। শেষ করার আগে বলতে হয়, নারী যদি নিজেকে একটু ভেঙে দেখতে চান তবে তাকে সহযোগিতা করতে পারে ‘দাস জীবনের মালিক নারী?’ গ্রন্থটি।
গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে শ্রাবণ প্রকাশনী, প্রচ্ছদ করেছেন রবীন আহসান এবং গায়ের মূল্য ২৫০ টাকা। শেষটায় উল্লেখ করতে হয়, সাদিয়া নাসরিনের ‘দাস জীবনের মালিক নারী?’ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন তসলিমা নাসরিন।