প্রগতির প্রশ্ন ও বাংলাদেশে ফিদেল কাস্ত্রোর প্রাসঙ্গিকতা
অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স অনুবাদ করেছেন পণ্ডিত শিশির কুমার। তিনি অনূদিত কাব্যতত্ত্বের ভূমিকায় হাজির করেছিলেন বই-সংক্রান্ত সেই জনপ্রিয় গ্রিক অদিকল্প—মেগা বিবলিয়ন মেগা কাকোন। অর্থাৎ বড় বই বড় জঞ্জাল। জঞ্জাল বৃদ্ধির বিরুদ্ধে শপথ নিয়ে এবারের বইমেলায় হাজির হয়েছিল ‘প্রগতি’ নামক একটি সংকলন-পুস্তিকা। এখানে সংকলিত হয়েছেন কিউবা বিপ্লবের স্থপতি ফিদেল কাস্ত্রো। কাস্ত্রোর জীবন ও রাজনীতি, তত্ত্ব ও চর্চাকে সম্পাদকগণ (সাখাওয়াত টিপু, দীপংকর গৌতম, অভিনু কিবরিয়া ইসলাম, হাবীব ইমন, মীর মোশাররফ হোসেন, প্রশান্ত মণ্ডল ও রাহাত মোস্তাফিজ) হাজির করেছেন তরজমার মধ্যস্থতায়।
বাংলা ভাষার মৌলিক লেখালেখি নয়, বরং রুশ, স্প্যানিশ ও ইংরেজিতে লেখালেখির ভিত্তিতে এই বইয়ে খোঁজ করা হয়েছে ফিদেল কাস্ত্রো আসলেই কে? কাস্ত্রো কীভাবে হয়ে উঠেছেন। সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা, প্রবন্ধ, নিবেদিত কবিতা আর জীবনালেখ্য মিলিয়ে এই সংকলনের কাঠামো তৈয়ার হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকা ও ব্যক্তিকে দেওয়া কাস্ত্রোর পাঁচটি সাক্ষাৎকার, বিভিন্ন উপলক্ষে দেওয়া তাঁর চারটি বক্তৃতা, কাস্ত্রোর স্বরচিত তিনটি প্রবন্ধ এবং কাস্ত্রোকে নিবেদিত পাবলো নেরুদা ও এডওয়ার্ড ফিল্ডের কবিতা পাঠককে কাস্ত্রোর সংগ্রাম ও ভাবাদর্শের একটি নিবিড় পঠনের প্রতি সঞ্চালিত করতে সক্ষম, তা আমি এই সংকলন পাঠের অভিজ্ঞতার পুঁজি থেকে হলফ করে বলতে পারছি। অনবহিত পাঠকের জন্য ফিদেলের জীবন নিয়ে পঞ্জিভিত্তিক টিপ্পনীগুলো প্রয়োজনীয়ভাবেই এ বইয়ের বাড়তি যোজনা। তবে সম্পাদকীয়টি কেবল প্র্যাকটিশনারের দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখিত না হয়ে প্র্যাক্সিসের ভাবনা থেকে লেখা হলে কাস্ত্রোর প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্কটি হতে পারত আরো জ্ঞানতাত্ত্বিক।
যদিও এ বইয়ের একটিই সারাৎসার—বাংলাদেশে কাস্ত্রো কেন প্রাসঙ্গিক এই প্রশ্নের জবাব খোঁজা। ‘যাদের পা দুর্বল চেতনা সংশয়ী তারা পিছিয়ে পড়বে’ নামে ফিদেলের একটি ভাষণ আছে এই সংকলনে। সম্ভবত সংকলিত এই রচনাটিই এই প্রশ্নের উত্তর অনেকখানি নির্দেশ করে। শিক্ষা ও বিপ্লবের রাজনৈতিক রসায়ন হিসেবে পাঠ করা সম্ভব এই ভাষণে কাস্ত্রো বলেছেন : “আদতে শিক্ষা ছাড়া কোনো বিপ্লব হতে পারে না, কারণ—বিপ্লব হচ্ছে একটি দেশের জীবনধারায় সামগ্রিক পরিবর্তন। বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা হচ্ছে লড়াইয়ের উদ্বেগ, পুরোনো ধ্যানধারণা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা। বিপ্লবী ধারণাকে অবশ্যই সামনে রাখতে হবে; এ ধারণাকে অবশ্যই জনগণের জন্য বোধগম্য করতে হবে। আগে জনগণের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা হতো না, তাদের বোঝানো হতো ‘অনেক কিছু নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না’। বিপ্লব এ ধরনের প্রশ্ন না করার ‘মতবাদ’কে প্রশ্ন করবে; প্রশ্ন করবে ‘সত্য’ বলে চিহ্নিত সেসব রক্ষণশীল ধারণাকেও, যাদেরকে ‘মিথ্যা’ বললেই সবচেয়ে ভালো। বিপ্লব এসব মিথ্যাকে পুনর্পাঠ করবে” (পৃ. ৪৮)।
বাংলাদেশে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে উপনিবেশিক ইতিহাসের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দরজা দিয়ে। এ দেশে এন্তার বিরোধসমেত আধুনিকতার কোনো আস্ত প্রকল্প নেই, যা আছে তা বিস্তর ভগ্নাংশ মাত্র। এমনকি এখানকার ভাবান্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য, যা প্রাগাধুনিক একেও রাজনৈতিক ভিশন নিয়ে মোকাবিলা করা হয়নি।
এমনকি সমাজতান্ত্রিক অক্ষরেখা থেকেও স্থানীয় জীবনধারায় থাকা মিথ্যার পুনর্পাঠের কোনো সামগ্রিক চর্চা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে এ দেশে সাহিত্যের মণ্ডলে ও জীবনবাস্তবতায় প্রশ্নের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কাস্ত্রোর জীবন সাক্ষ্য দেয়, কীভাবে এক বৈরী পৃথিবীতে মানুষের রূপান্তরের সম্ভাবনা আবিষ্কার করা যায় এবং চিহ্নিত এই মানব-সম্ভাবনাকে জীবন-যাপনের সমগ্র পরিমণ্ডলকে বদলে ফেলার কাজে নিয়োগ করা যায়।
বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ তাদের ‘প্রগতি’ সংকলনে কাস্ত্রোকে দুই মলাটে পরিবেশন কেন করেছেন? হয়তো তারা এ দেশে কাস্ত্রোর জীবনের সঙ্গে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক সংলাপশীল ভূমিকা সৃষ্টির তাগিদ নিজেদের মর্মস্থলে অনুভব করেছেন। রাষ্ট্র ও সমাজের গুণবাচক অগ্রগতি, যাকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্যে সিক্ত করে বলা যায় ‘প্রগতি’—এই প্রগতির প্রয়োজনেই সাহিত্যের রাজনৈতিক সিদ্ধির মূল্য নিরূপণ জরুরি। এখানে মনে রাখা ক্ষতিকর হবে না সাহিত্য বিশেষ্য পদ নয়, সাহিত্য সর্বদাই ক্রিয়াপদ। যাপনের অন্দরে যদি এর সাড়া না থাকে, তাহলে সাহিত্যের স্থান হয় শৌখিনতার কফিনে। বাংলাদেশে বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর সংকলন পাঠ করে মনে পড়ছে মার্কসবাদী নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেখটের লেখা ‘লাইফ অব গ্যালিলিও’ নাটকে গ্যালিলিও এবং তাঁর ছাত্র আন্দ্রিয়ার বিখ্যাত দ্বান্দ্বিক সংলাপ। আন্দ্রিয়া বললেন, ‘দুর্ভাগা সেই দেশ যার বীরপুত্র নেই’। গ্যালিলিও প্রত্যুত্তর করলেন, ‘দুর্ভাগা সেই দেশ যার বীরপুত্রের প্রয়োজন আছে’। ফিদেল কাস্ত্রোর বৈপ্লবিক জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় জনগণই ইতিহাসের ভাগ্যবিধাতা।