তরুণদের কবিতা : পাঠ প্রতিক্রিয়া
বাংলা সাহিত্য কবিতাপ্রধান। বাংলাদেশ কবিতার দেশ। কবির এখানে অভাব নেই। অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত বলবার মতো কোনো পর্যায়ে পৌঁছতে না পারলেও, আর্থিক বা সামাজিকভাবে কবিদের বিশেষ গুরুত্ব না থাকলেও কবিতার উর্বর মৃত্তিকা বাংলা থেকে কবিতা কথনই যে তিরোহিত হবে না, তার প্রমাণ আজকের এই যন্ত্রনির্ভর একবিংশ শতকেও কবিতাচর্চায় বিপুল তারুণ্যের আগমন। অনেকেই জানেন, এই আগমনের অনেকটাই নিষ্ঠাশূন্য তারুণ্যের গভীরতাহীন প্রলাপের মতোই। তবু এর একটা ইতিবাচক দিক নিশ্চয়ই আছে, যা সময়ের চোখে সেভাবে ধরা না পড়লেও সময়োত্তর আগামীকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। পারুক না পারুক, সেই আশা নিয়েই কয়েকজন কবির কয়েকটি কবিতা পাঠ ও পাঠোত্তর মন্তব্যপ্রদানে সম্মত হয়েছি।
গিরীশ গৈরিক
‘মা সিরিজে’র বদৌলতে গিরীশ গৈরিক এখন কবিতাপাঠকের পরিচিত নাম। অবশ্য ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ নামে তাঁর একটি কাব্যও আছে, যেখানে বেশ কিছু সংবেদনশীল পঙ্ক্তিমালা রয়েছে। তবে ‘মা সিরিজ’ একেবারে ভিন্নরকম; একই শিরোনামে শতাধিক কবিতা ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। একটি সিরিজের নামে এতগুলো কবিতা এর আগে আমাদের চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। সংখ্যায় আলাদা হলেও মা সিরিজের কবিতাগুলোর আন্তর্সুরে অভিন্নতা রয়েছে অনেকটা। সুরের অভিন্নতা সত্ত্বেও কবিতা হিসেবে এগুলো আবার একেকটি স্বতন্ত্র কবিতার মূর্তি ও মর্যাদা নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হতে চায়। আলোচ্য ৯৯ ও ১০০ সংখ্যক কবিতা দুটিও স্বতন্ত্রতার দাবিকে সমুন্নত রেখেছে বৈকি। প্রতিবন্ধী মানুষের অঙ্গের অপূর্ণতা স্বাভাবিক, কিন্তু স্বাভাবিক অঙ্গযুক্ত মানুষেরও যে নানাবিধ অপূর্ণতা থাকতে পারে সেকথাই মায়ের অভিজ্ঞানে জানাচ্ছেন গিরীশ :
... আমি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও
আমার মা বলেন : আমার ভেতরে নাকি—
বোবা কালা ও অন্ধত্বের সমস্ত গুণাবলি অন্তর্নিহিত।
যুক্তিপূর্ণ এই কথাটির সূত্র ধরে নিজের কবিতা সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে চেয়েছেন তরুণ কবি :
সেই থেকে আমার নিজের কবিতা পাঠ করলে মনে হয়—
কবিতাটি হয় বোবা, না হয় কালা কিংবা অন্ধ।
বস্তুত, কোনোকিছুই একেবারে পূর্ণ নয়, পূর্ণাঙ্গ শরীরের মতোই পূর্ণ কবিতাশরীরেরও থাকতে পারে নানা অপূর্ণতা। গিরীশের নিজের এই কথাটিতেও সত্যতা আছে বৈকি; তবে বিনয়ও বিদ্যমান। মা সিরিজের শতক পূর্ণকারী কবিতাটি মানবতার একটি সুরে গাঁথা। একতারা-লালন-দাদু-মা... সব একাকার এখানে। একতারাটি বেসুরে বাজলেই দাদু যেমন মোচড় দিয়ে ঠিক করতেন, তেমনি বেপথে গেলেই কানে মোচড় দিয়ে ঠিক পথে নিয়ে আসতেন মা। লালনের দর্শন আর একতারা আসলে অভিন্ন মানবতাবাদের প্রতীক। গিরীশও সেই দীক্ষাই পেয়েছেন শৈশবে। এখন বলছেন :
আমাদের জীবন নাকি লালনের কাছে একতারার তার
তাই মোচড় দিয়ে তিনি গাইতেন মানবতার সুর।
কবিতা গিরীশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। কবিতাকে প্রায় জীবন-যাপনের পর্যায়ে অনুভব করেন তিনি। খুব অল্প সময়ে তাঁর যে আগমনকলা তা আগামীদিনের অনিন্দ্য উত্তোরণ হয়ে ধরা দেবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
পলিয়ার ওয়াহিদ
‘পৃথিবী পাপের পালকি’ কাব্যের রচয়িতা তরুণ কবি পলিয়ার ওয়াহিদের কবিতায় মাটি ও পল্লীপ্রকৃতি তার অকৃত্রিম পেলবতা নিয়ে হাজির হয়। তিনি যে মাটি থেকে উঠে এসেছেন, সেই মাটি ও তার পরিবেশ নিরাভরণ উঠে আসে তাঁর কবিতায়। ‘মাটিয়ালি গান’ ও ‘চালতা ফুল’ কবিতা দুটিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘গমবনে মানুষ’, ‘ভেতোশাক’, ‘বেলেশাক’, থানকুনি পাতা’, ‘চালতা ফুল’ এসব অনুষঙ্গকে একেবারে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গেই একীভূত করে তুলে ধরেছেন পলিয়ার। হতে চেয়েছেন ‘চালতা ফুলের মতো আড়ম্বরহীন, অতি সাধারণ!’ আড়ম্বরহীন হলেও চালতা ফুলের সৌন্দর্য যে অসামান্য নান্দনিকতায় পূর্ণ, সে কথা বলাই বাহুল্য। আমরাও চাই পলিয়ার সে রকম কিছু হোক। তবে সে ক্ষেত্রে তাঁকে কবিতাও ভাষা ও আঙ্গিকের দিকে আরেকটু সচেতন হতে হবে।
শঙ্খচূড় ইমাম
‘বস্তুত সাঁকো ভেঙে গেলে/শোকই চিরকাল উজ্জ্বল/উচ্ছ্বসিত পাঠ’ (বস্তুত)—সাঁকো মিলনের প্রতীক; জীবনেরও। বিপরীতে সাঁকো ভেঙে যাওয়া মানে বিচ্ছিন্নতা, বিরহের কথা; হতে পারে মরনেরও বারতা। আর বিচ্ছিন্নতা, বিরহ কিংবা মৃত্যু এসবই শোককে উজ্জ্বল ও উচ্ছ্বসিত করে তোলে বৈকি। সম্ভাবনাময় তরুণ কবিদের মধ্যে শঙ্খচূড় ইমামের নামটিও ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। একাধিক অনলাইন পত্রিকা তার গুচ্ছকবিতা ছেপেছে বেশ যত্নের সাথে। তার ভেতরে কাব্যের ভাব আছে, ভাষা আছে, ভাষাতে সীমাবদ্ধতাও আছে। বস্তুত, ভাষা ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা আছে তা কাটিয়ে উঠতে পারলে সম্ভাবনা কাজে লাগতে পারে।
মাজহার সরকার
‘যৌথ দুঃখ’ শিরোনামের কবিতাটিতে দুঃখকে ব্যক্তিক থেকে সামষ্টিক করে তুলবার আগ্রহ প্রশংসনীয়। কিন্তু পরিবেশে যে উৎসবহীণতা বিদ্যমান সেকথাও ভুলবার নয়। ‘কয়লা’ কবিতায় জয় গোস্বামীর ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ ধরনের কাব্যিক প্রবণতার লক্ষণ মিললেও তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি কোথাও কোথাও ছন্দস্পন্দের অবাধপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে বলে।
সিমন রায়হান
‘মুহুর্ত মাছি’ শিরোনামের শেষ লাইনে যখন পড়ি ‘...ম্যাজিক স্লেটে কেবলি মিলিয়ে যাচ্ছে উদ্ধৃতি চিহ্নের অহং’, তখন শেষ লাইনের সিদ্ধান্তপ্রবণতার কাব্যিক রূপায়ণ ধরা পড়তে চায়। ‘হাওয়া ব্রিজ’ নামের শেষের পঙক্তিগুচ্ছও কবিতাভাবে জেগে উঠতে চায়। ‘জালের অধ্যাদেশ’ এর মতো শব্দপ্রয়োগ কিংবা ‘পারাপার নাই তবু সেতুর জন্য চুম্বন তোলা থাকে’র মতো চরণ সিমন রহমানকে কবিতা লিখবার প্রেরণা দেবে নিশ্চয়ই। গুছিয়ে উঠতে পারলে সে প্রেরণা অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।
বাবুল হোসেইন
‘আত্মমুগ্ধ শিকল’-এ ঘাসফুলের দুঃখকে অনুবাদ করতে না পারার আফশোস নিয়ে ‘নিজস্বতা’য় এসে কিছুটা বাণীবহুল হতে চেয়েছেন। ‘চিন্তার থেকে অনুভূতিই মহত্তর’, ‘বিশ্বাস ঘাতকেরাই বিশ্বাসের/বীজ রুয়ে গেছেন তামাম জিন্দেগীর’ প্রভৃতি চরণেরা সেই ইঙ্গিতই দেয়। পরিচর্যায় সৎ থেকে এগোতে পারলে কবিতা বাবুলের হাতে ধরা দেবে।
হানিফ রাশেদীন
হানিফ রাশেদীন শুভবোধে উদ্বুদ্ধ আশাবাদীচেতনার কবি। ‘বৃত্তের বাইরে’ কবিতায় তিনি বলেন,
গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে প্রতিটি রাত্রি হেঁটে যাই আমি
সমস্ত জঞ্জাল ও অন্ধকার-পেছনে ফেলে এই পৃথিবী
সুন্দর এক পৃথিবীর পথে; যেখানে চোখ ধাঁধিয়ে যায় না
ভিন্ন ভিন্ন রঙে, সহস্র রঙের ভেতর একটি রঙ সৌন্দর্য।
‘একটি রঙ সৌন্দর্য’ এখানে মানবতার, শান্তির এবং আলোকিত জীবনের আহ্বান। প্রত্যেকটি সকালেই সুন্দর একটি উজ্জ্বল দিনের অপেক্ষা করেন হানিফ। এবং শুধু অপেক্ষাতেই যে থেমে থাকতে চান না, তার চিত্রায়ণ করতে চেয়েছেন ‘আমরা দেখব’ কবিতায়। বলেছেন :
আমরা দেখব, নিশ্চয়ই একদিন দেখব
আমাদের পায়ের তলে
ধসে পড়বে নির্দয়তার যত প্রাচীর
এত আমাদের নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি
এই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য কী দরকার, সেকথাও বলতে ভোলেন নি তিনি। শ্রেণিশোষণহীন একটি সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমাদের রক্ত ও ঘামে তৈরি করেছি হাতুড়ি
ভেঙে ফেলা হবে দেখতে মানুষ—
কিন্তু দানবের হাত
ছুড়ে ফেলা হবে সব পোশাকি মুকুট
কথাটি সত্য। এবং সাম্যবাদের প্রবক্তা থেকে শুরু করে সমর্থকরাও সে কথা জানেন। কিন্তু মানুষরূপী দানবের হাত ভেঙে ফেলা কিংবা ভণ্ডামীর সকল পোশাকি মুকুট ছুড়ে ফেলবে যারা, সেই জনগণও তো আজ পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের অধুনা রূপকে যে চিনতে চেষ্টা করছে না! কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঈষৎ প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হলেও বিবিধ প্রলোভন ও প্রতিকূলতায় তা যে সফলতার মুখ দেখছে না! তবে কি হানিফদের স্বপ্ন সার্থক হবে ? হোক, না হোক, আশাবাদী হতে তো দোষ নেই। কবিকে তো আশাবাদী তো হতেই হয়। ধন্যবাদ, হানিফ। আরেকটু আঙ্গিক সচেতন হলে প্রথাগত রূপেই স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে আপনার বক্তব্যসমূহ শিল্পিত রূপ পাবে নিশ্চয়ই।
জব্বার আল নাঈম
‘রোহিঙ্গা ও আরাকান রাজ্যের গৌতম’ কবিতায় মানবিক মূল্যবোধে জাগ্রত কবির আহাজারি লক্ষণীয়। তবে সেই আহাজারিকে অতিক্রম করে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রবল বিদ্রূপাত্মক চিত্রমালা। কবিরা মানবতার উপাসক। মানবতার বিপরীতে যা কিছু যায়, তার সবই কবির শ্লেষের বাণে বিদ্ধ হয়। তরুণ কবি জব্বার আল নাঈমও তার অন্যথা করেননি। মানুষ ও মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে বিখ্যাত মহমানবেরা মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের দিনে যে ব্যর্থ সে কথাগুলো জানাতেই তিনি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে টেনে এনেছেন কৃষ্ণ-রাম-যিশু-মুহাম্মদ-গৌতমবুদ্ধদেরকে। বাস্তবতার নিরীখেই বলেছেন :
আরব সাগরে মানুষের ফেনা
যিশুর উত্তর প্রজন্মের মুখে হিংস্র খাবার—
মানবতার মিথ্যা পাঠাগার!
মানুষের সব মুক্তি কুক্ষিগত। হে বেথেলহামের বৌদ্ধ বন্ধু,
(অ)সুবিধায় বলি— বাংলার রক্তে শোভনীয় আরাকান;
অথচ এইখানে পরাজিত মানুষ মুহাম্মদ!
রোহিঙ্গা,
এই আরাকান সেই আরাকান নয়
এই সন্ন্যাস সেই সন্ন্যাস নয়
এই মানুষ সেই মানুষ নয়
এই গৌতম সেই গৌতম নয়!
এমন হিংস্রতায় ধরণীতে নেমে আসে মানুষের পরাজয়!
সত্যই, মানুষের হিংস্রতার মাধ্যমেই নেমে আসে মানুষের পরাজয়। এবং এই পরাজয়ের ইতিহাস পুনঃ পুনঃ চিত্রায়িত হয়।
সাইফ সিরাজ
বর্তমান প্রজন্মের কবিরা জেনে বা না জেনে, ছন্দকে যখন ত্যাগের বাসনায় মগ্ন, তখন সাইফ সিরাজের ছন্দলগ্ন থাকার সদিচ্ছা আস্বস্ত করে কিছুটা। কিন্তু ছন্দই সব নয়, ভাষাতেও কাব্যিক ব্যঞ্জনা থাকতে হয়। অন্ত্যমিল বাংলা কবিতার অমূল্য অধ্যায়, তবে অন্ত্যমিলেই পূর্ণত মুক্তি মেলে না; যদি কেবল মিলই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। সাইফের কবিতাপ্রচেষ্টায় ১৪ মাত্রার পঙক্তি যেমন আস্বস্ত করে, তেমনি অন্ত্যমিলের প্রয়োজনে হালকা চালের চরণের পরে চরণ বিন্যাস কবিতা অপেক্ষা পদ্য বা ছড়ার ইমেজ তৈরি করে বৈকি। যেমন :
প্রহরীরা অস্ত্র ধরে মালিকের কাঁধে
বেখবর মালিকেরা মালামাল বাঁধে
মালিকের হয়ে আজ প্রহরীই কাঁদে
আটকে গেছে সবাই প্রভুত্বের ফাঁদে।
(ফিলহাল )
অবশ্য, দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় চরণে চৌদ্দ মাত্রার সমতা রক্ষিত হয়নি :
আমিত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে রোজ
নাগরিক আলাপনে গণতন্ত্র নিখোঁজ
কালের লিখন
নিশ্চয়ই ছদ্মনাম, কিন্তু কবি অপেক্ষা কবিতা বা কলামের নামই মনে হয় ঢের। কিন্তু নামে যেমনই মনে হোক না কেন, কবিতায় কালের লিখনের প্রয়াস প্রশংসনীয়। আঠারো মাত্রার অক্ষরবৃত্তে বেশ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ভাষা ও মিলবিন্যাসও সুন্দর। ‘তিরিশ বছর’ পুরাতন প্রেমের নষ্টালজি। ধ্বনি মাধুর্য আছে। তবে শব্দের শুদ্ধতা ও সাময়িকতা বিবেচনায় আরেকটু সতর্ক হতে হবে। ‘মানুষের সখ্যতা লাভ ও লোভে; সামান্য এ রীতি—/ অসামান্য অনুভবে প্রেমশস্য চাষ করে ভবে।’ এ অংশে ‘সখ্যতা’ শব্দটি ব্যাকরণসম্মত নয়। অন্যদিকে ‘ভবে’ শব্দটির প্রয়োগ আজ-কালকার কবিতায় নেই বললেই চলে। তবে ‘শব্দচাঁদ’ কবিতার তিনটি পঙক্তি পাঠককে মুগ্ধ করতে সক্ষম :
গালে তোর লগ্ন খেলে, মগ্ন পত্রে জলের কাঁপন—
*** *** *** ***
চুলে তোর সন্ধ্যা নামে, পাখিদের হয় রাত্রিযাপন—
সামান্য ভুঁই, আমি ও তুই, শব্দে করি লব্ধবপন।
কালের লিখন-এর ভেতরে যে মানুষটিই থাকুন, কবিতা থাকে সেখানে। কবিতাগুলো প্রকাশিত হোক।
গালিব রহমান
‘খাচার প্রাণী’ নয়, খাঁচার প্রাণী হওয়ারই কথা; তাই তো গালিব রহমান? চন্দ্রবিন্দুটিকে লাগিয়ে দিলে ‘খাঁচার প্রাণীরা কংক্রিট বোঝে বৃক্ষ বোঝে না’ চরণটি ভালো লাগার কথা।
বঙ্গ রাখাল
‘প্রেমিক হতে চাইনি’ কিংবা ‘চাষা’ কবিতা দুটি পড়ে সে রকম কোনো মন্তব্য করলে হয়তো তাঁর প্রতি বিশেষ সুবিচার করা হবে না। কেননা, এই কবিতা দুটিতে বিশেষ কাব্যিক ব্যঞ্জনা অনুভূত হয় না, দু-একটা পঙক্তি হয়তো ভালো লাগা তৈরি করে। ‘তোমাকে দেখলে মনে হয় পুরাতন জমিনে দরিদ্র পিতার আশাবাঁধা বুক, শান্ত নদীর বুকে উড়ে আসা বৃক্ষের খসে পড়া হলুদাভ পাতা আর থায় দাঁড়িয়ে থাকা বটের ছায়ায় ক্লান্ত পথিকের জুড়িয়ে নেওয়া শরীর।’—এ প্রেমানুভব ভালো লাগার মতো। ‘চাষা’ কবিতায় বাস্তবতাপ্রসূত কবিতানুভূতি শুরু থেকে যে ইমেজ তৈরি করে, তা শেষ পর্যন্ত সেভাবে টিকে থাকেনি।
চাষা
সময় বদলের সাথে পাল্লা দেয়
দুষ্ট চক্রের ত্রিমাত্রিক শূন্যের জীবন
কাঁসা গন্ধে ভেসে আসে বিষণ্ণকালীন সভ্যতার
দাঁড়িয়ে থাকা ফসলের ধানী জমিন
মালিক আর মহাজনিক দ্বান্দ্বিক দহনে
পুড়ে যায় ফসলের দিগন্তজোড়া মাঠ
শরীর থেকে ঝরে পরে যে বেদনার বিষ
তা তো ঘামেরই লবণ দেয়া পানি
শফিক সেলিম
নারীরা আদিপ্রেম, আদিম আধার
তারা সব নদী বলে বসন্তে বসন্তে
জন্মাই
জলের স্বভাব পেয়েছি বলে
পাতার স্বভাব পেয়েছি বলে
ঝরতে থাকি ঝরতে থাকি.......
‘জলে ভিজতে ভিজতে জলের স্বভাব’প্রাপ্ত শফিক সেলিমের কবিতাপ্রচেষ্টায় নিবেদন আছে, স্বপ্ন আছে; মায়াময় স্বাচ্ছন্দ্যও আছে। তবে সেই স্বাচ্ছন্দ্যকে আরেকটু ব্যঞ্জনাধর্মী করে তুলতে হবে; আরেকটু শিল্পসুশোভিত করে তুলবার চেষ্টা করতে হবে।
আবু সাঈদ সরকার
আবু সাঈদ সরকার এর ‘আরও একবার’ এবং ‘সেই নিদিষ্ট ভ্রমণগুলি’ শিরোনামের কবিতাপ্রচেষ্টা পাঠে কিছু বলবার মতো বক্তব্য খুঁজে না পেয়ে শুধু একথাই বলি : কবিতা কেবল ব্যক্তিগত আবেগকে ছোট ছোট চরণে প্রতিস্থাপন করা নয়, কবিতাকে নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনাধর্মিতায় উত্তীর্ণ হতে হয়। সে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে কবিতার শৈল্পিক দিকগুলোকে জানা এবং তা অনুসরণের স্বতন্ত্র প্রয়াস করতে হয়।
তুষার শুভ্র বসাক
‘প্রকৃতি’ ও ‘সিক্তশিখা’ কবিতাপ্রচেষ্টাযুগলে ভালো কিছু শব্দচয়ন আছে, কিন্তু তা অনেকটা কৃত্রিম এবং প্রক্ষিপ্ত। আধুনিক কবিতা কেবল ভারি ভারি সংস্কৃতগন্ধী শব্দ নয়, সাধারণ শব্দ সমন্বয়েই শব্দাতীত ব্যঞ্জনা দাবি করে। তা ছাড়া ভারি ভারি শব্দে লিখিত কবিতা প্রথাগত ছন্দ-অলংকারকে মেনে চলবার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাশা করে।
মাসুম মুনাওয়ার
চাকা যায়, চাকা আসে
রাস্তার পাশে ছড়িয়ে থাকে মরা গাছের ঝরা পাতা
আর বিকেলের পিলারগুলো সেঁটে যায় বিচ্ছেদের পোস্টারে।
বেশ ভালো লাগলো ‘বিচ্ছেদের পোস্টার’ কবিতার এই অংশটুকু। কবিতার চিত্রকল্প বাস্তবতাপ্রসূত। ভাষাতে কাব্যিক ব্যঞ্জনার ইঙ্গিত মেলে। কবিতার শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে পারলে এবং শব্দপ্রয়োগের শুদ্ধতাকে ছেঁকে নিতে পারলে, কবি হয়ে উঠবার মননটা মাসুম মুনাওয়ারের আছে বলেই মনে করি।
মঈন মুনতাসীর
যদি প্রাপ্য প্রেমটুকু পাই—
ঘর্মাক্ত পায়ে দিতে পারি চুমু।
ফেটে যাওয়া জুতা ঠিক করে দিতে পারি
ঠোঁটের লালা দিয়ে...
কিন্তু প্রেমহীনতায় আমিই তোমার ঘাতক!
অতএব আবদুর রহমান, আমি তোমার মতো
জুতা সেলাই থেকে খুন-সবকিছু করতে পারি
আগন্তুকের ভালোবাসা পাবার জন্য!
‘শিশমহল’ কবিতাটি ঠিক কবিতা হয়ে উঠেছে কি না এটা বলবার চাইতে বলা ভালো, এটা একজন প্রতিহিংসা পরায়ণ প্রেমিকের অহমকে শব্দরূপ দিতে চেষ্টা করেছে, যা কি না কবির বয়ানে অভিপ্রেত বলে মনে না-ও হতে পারে।
হাসনাত শোয়েব
‘মৃত ভেড়াদের চিঠি’ এবং ‘পৃথিবীর সান্ধ্যভাষা’য় হাসনাত শোয়েবের ভাবনার ভিন্নতা বেশ তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। ইতিহাসের পণ্ডশ্রম প্রবণতা যে আজও শেষ হয়নি, সেকথা কিঞ্চিৎ বিদ্রূপ এবং হতাশার সুরেই বলেছেন তিনি। ‘পৃথিবীর সান্ধ্যভাষা’তে চমৎকারভাবেই তুলে ধরেছেন মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং সম্প্রদায়গত দৃষ্টিভঙ্গির অপূর্ণতার কথা। নিজের আকাশটাকেই একমাত্র ভেবে নেওয়া পাখি আসলে মানুষেরই প্রতিনিধি। আর এ ধরনের আকাশ সম্পর্কে হাসনাতের বক্তব্য : ‘আকাশ তো কেবল পার্সিয়ান ফিল্মমেকারদের অসুখের নাম।’
রাজকুমার
‘রক্ত কণিকারাও চাঁদরঙ বেনারসীর হাট'; ‘বোবা শীত কানকো বাইছে দুধবর্ণ ঘাসের গলিতে'; ‘চাঁদের গলুইয়ে ঠেস দিয়ে পৃথিবী ঘুমায়’; ‘পপি ক্ষেতে লাল হয় ঘাসের ঠোঁটের শব্দ’ প্রভৃতি পঙক্তিপাঠে অনুমান করা যায় রাজকমার নামে বা ছদ্মনামে যিনিই লিখুন, কবিতা লিখবার মতো মনন তার তৈরি হচ্ছে। ‘মধুর শহর’ ও ‘পক্ষীরাজ বিষয়ক জটিলতা’ কবিতাপ্রচেষ্টা দুটিতে বক্তব্য ও ভাবের গভীরতার ইঙ্গিত মেলে। বক্তব্যকে আলংকারিক আবরণ প্রদানের চেষ্টা প্রশংসনীয়। তবে ছন্দসহ শব্দচয়নের শিথিলতাগুলোকে একটু ঘষে-মেজে এগিয়ে যেতে হবে।
মাহমুদুর রহমান
নিশিথের নৈঃশব্দ্য জেনেছি তোমারে সখি। পানবরজের পর্দা-পুসিদায় ঢেকে আছো। পাশে আমি সুপুরি গাছের মত দাঁড়িয়ে নিথর।
একবার জিজ্ঞেশ করেছিলে—পাখি ভালবাসি কিনা? উত্তরে বলেছিলাম—পাখি ও খাঁচার পাখি দুজনেই এক নয়। যে ওড়েনি রোদের চাতাল জুড়ে পুরোটা আকাশ। সে কেবল পাখিকায়া।
অথচ তোমাকে ভালবেসে প্রথম উড়াল শিখি। জেনে নেই গোপনেরও থাকে কিছু গোপন দেরাজ।
মধুমতি ঘোলাজল ছুঁয়ে দেয়নি যে রমণীর নিটোল চিবুক। সে জানেনি কখনোই—ভালবাসা ফসলের রুপোলি খনিজ।
(পাখিকায়া)
পুরো কবিতাটিই তুলে দিলাম। অমায়িক স্বাচ্ছন্দ্যময় মনে হয়েছে আমার কাছে। প্রথম পাঠেই এক মায়াবী ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায় এর চিত্রকল্পের নান্দনিকতায়। আমি বলি : প্রথাগত ছন্দ-মাত্রাদিকে যদি মাড়িয়ে যেতে চাও, এভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যের নূপুর পায়ে যাও। পরবর্তী কবিতা ‘ধানশালিক-এ এই অমায়িকতা কিছুটা বাধা পেয়েছে।
অনুপম মণ্ডল
অব্যক্ত বেদনারা গুমরে ওঠে অনুপমের পঙক্তিগুলোতে। নির্বাক কান্নারা গড়িয়ে পড়ে দৃশ্যাতীত অশ্রদানার স্বরূপে। এন্টি রোম্যান্টিক আবহ তৈরিতে কবির আগ্রহ লক্ষ্য করবার মতো : ‘কিম্বা আন্দালুসীয় মেয়েদের উদ্ধত / উরু / আজ ছড়িয়ে পড়েছে / বিষণ্ণ ড্রয়ারে / অতর্কিতে’ (অশ্রুদানা)। বিষণ্ণতা ঝুলে আছে পরের কবিতা ‘ঝুলে আছে রাত্রি’তেও। তবে পঙক্তি বিন্যাস এবং অন্যান্য আলংকারিক বিষয়াদি নিয়ে আরেকটু ভাবতে হবে।
সঞ্জয় ঘোষ
কবিতাভাবনায় সঞ্জয় ঘোষকে একেবারে অপ্রথাগতই মনে হয়। পঙক্তি নির্মাণের সহজবোধ্য ছান্দসিক ধারাকে পথের পাশে বসিয়ে রেখে একটি আপাত দুর্বোধ্য নিজস্ব পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ‘মুখোশের ঋতু’ এলে কোনো কিছুই স্বাভাবিক দৃশ্যমানতা ধরে রাখতে পারে না। সুতরাং দেখবার দৃষ্টিকেও একটু পরিবর্তন করে নিতে হয়ে বৈকি। ‘তাকানোর দিনক্ষণ ও আবহাওয়া বিভ্রাট’ হলে ‘দৃশ্যের ইতিহাসে কোন কথা লেখা হয়’ কে-ইবা জানে ! যেকথাই লেখা হোক, সঞ্জয়ের কবিতায় লেখা থাকে :
নিশানাও আড়াল করে রাখে
দেয়ালের অন্ধ তারিখ।
ডার্টবোর্ড তুলে আনো লুকানো চাবুক
দেখো ঘুমঘরে রাখা আছে আয়না ও কিসের বারুদ;
মানিব্যাগে ভুল চাবি সময়ের
তবু তিনখানা নোট।
উল্টানো ঠোটঘড়ি
তোমার
দৃশ্যত চোখের অসুখ।
‘প্রত্যাবর্তনের খাম’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘পৃথিবীর সব চিঠি জানে/ঠিক কবে তার উত্তর আসবে’ আমি জানি না, এ কোন চিঠি, যে নিজেই নিজের উত্তরপ্রাপ্তির কথা জেনে রাখে। কিন্তু তিনি যখন লেখেন, ‘চিঠিই জানে/কোন বীজ রেখেছে সে বুকের ভেতরে/শব্দের পাঁজরে পাঁজরে’; তখন অনুমান করতে পারি এই চিঠি সাধারণ কোনো চিঠি নয়, অন্য কোনো চিঠি, যার বুকের ভেতরেই সুপ্ত থাকে উত্তরের বার্তা। হয়তো লিখিত হওয়ার সময়ই সে জেনে রাখে উত্তরের সুর-ছন্দ-ধ্বনি।
আজিম হিয়া
‘ঈশ্বর’ শিরোনামে আজিম হিয়া লিখেছেন :
যদি কিছু কথা থাকে—চেপে যাও, হজম করো আর পায়ুপথে বের করে দাও। এখন ঈশ্বরের কাল। শোনো—কান দুটোকে ড্রেজিং করে আরও গভীরে জাগিয়ে, পলি-জল সরিয়ে চোখকে সাজাও বানভাসী চাঁদ; নাকের ফুটোয় চালান করতে শেখো পৃথিবীর তাবৎ নর্দমা। জেনো, একদিন এইসব বুলি আর তোমার ভেতর আটকে পড়া ললিত কথার মিথস্ক্রিয়ায় তুমিও ঠিক গেয়ে উঠবে ঈশ্বরের মতো।
দু-একটি জায়গায় ঈষৎ শৈথিল্যভাব ব্যতীত বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই পাঠ করা যায় কবিতাটি। নিরাপদে বেঁচে থাকতে হলে কী পরিমাণ সহ্যশক্তির অধিকারী হতে হবে, বোধ করি তারই নমুনা দিতে চেয়েছেন আজিম। ‘অভিজাত স্যান্ডেল নেমে আসে পথে/পথ ঢুকে যায় পায়ের নিচে’; ‘শহরে’ কবিতাটি শুরুর এই অংশটুকু চমৎকার। কিন্তু পরের পঙক্তিগুলোতে এই স্বাচ্ছন্দ্য কিছুটা ব্যাহত হয়েছে বৈকি।
ডাল্টন সৌভাত হীরা
‘প্রতি আলোকবর্তী’ শিরোনামে যা লেখা হয়েছে সেখানে কিছু বক্তব্য আছে, কবিতা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ‘দুইজন’ শিরোনামে যা আছে, তা একটি ধাঁধার মনে হয়।
কালপুরুষ কাফকা
জাপানের কুখ্যাত আত্মহত্যার অরণ্য ‘আওকিগাহারা’কে নিয়ে লিখেছেন কালপুরুষ কাফকা। ছদ্মনামের ওজন কতো ভারি রে বাবা! প্রেম ও প্রত্যাখ্যান এই পঙক্তিগুলোর প্রধান অবলম্বন। প্রত্যাখ্যাত হয়েই কালপুরুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চান। কিন্তু আত্মহত্যায় তার আফশোস নেই আফশোস প্রেয়সীর ভুল বুঝতে পারার পরবর্তী ধাপের জন্যে! ‘তোমার যদি গভীর অনুতাপ হয়/প্রত্যাখানের বেদনা নিয়ে ভাবি না/ভাবি নবান্নের মৌসুম শেষ হলে (শেষ, যেহেতু হয়)/তোমার যদি গভীর অনুতাপ হয়/আর ততদিনে তুমিও গিয়েছো ভুলে ঠিকানা/আমার/আর/আমিও দিয়েছি উড়িয়ে আওকিগাহারা'র দিকে ডানা/অরণ্য-বরফের গল্প শোনাবে কাকে?/কাকে বলবে; "এই শরীর দিলাম তোমাকে"/ভেবে, ব্যথা পাই তবু প্রত্যাখানের বেদনা নিয়ে আর ভাবি না’।
সায়মা হাবীব
অপমৃত্যু অথবা অন্যান্য
নিশি শশী সন্ধ্যা ও অরুণা পথ হাঁটে একসাথে একই হাওয়ায়
চুল ওড়ে আঁচল দোল খায় পাপড়ি জেগে থাকে
নিশি কাল ভোরের ট্রেন ধরবে
সন্ধ্যা আর একটু পরে মধ্যরাত হবে
বাকিরা সকলে আত্মহত্যার দিকে যাবে টলোমল
নিশি মানে রাত, সে তো ভোর হবেই; সন্ধ্যা যে, সে আরেকটু পরে মধ্যরাত হবে—এটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক—চাঁদ (শশী) আর সূর্যের (অরুণা) অদৃশ্য হওয়াটাও। কিন্তু চাঁদ-সূর্যের এই মিলিয়ে যাওয়াটা তো সাময়িক, এটাকে কি আত্মহত্যা বলা যায়? এভাবে লিখে সায়মা কী বোঝাতে চেয়েছেন ? এই নামের চারজন মানুষের জীবনের রোডম্যাপ? না কি অন্য কোনো ধাঁধা। এমন ধাঁধাকে কতোটা কবিতা বলা যাবে ?
মিছিল খন্দকার
প্রিজম শব্দটি বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। আলোকবিজ্ঞানে এক রকম, জ্যামিতিতে আরেক রকম। বাংলা ভাষাতে একই জিনিসের বিভিন্ন প্রতিশব্দ রয়েছে। আবার এই প্রতিশব্দগুলো এক-একটির ব্যবহারে একেক রকমের আমেজ তৈরি হয়। সমুদ্র শব্দের কয়েকটি সমার্থক শব্দ নিয়ে এরকমই ভিন্নার্থক আবহ তৈরি করতে চেয়েছেন মিছিল খন্দকার। যেমন :
সমুদ্র লিখলে মনে হয় উত্তাল ডাকাত।
তাই সমুদ্দুর লিখে ভাবি-
সামান্য দূরে থাকে; নিকটাত্মীয়।
মিছিল খন্দকারের এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই বললেই চলে। এবং এই কবিতার নাম যে প্রিজম দিয়েছেন, সেটাও এখানে তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। ‘বর্ষা’ কবিতার রোম্যান্টিক চিত্রকল্প পাঠককে আনন্দ দিতে পারে। ‘ছাতার উপরে ভেঙে পড়ছে/পুরোটা আষাঢ় মাস,/গোটা শহর যাচ্ছে ভিজে।/আর সে একটা ছাতায় মাথা ঢাকতে/ভিজিয়ে ফেলছে খনিজ পা—/ এই দৃশ্যে আটক হলো এবারের বর্ষা !’ আচ্ছা, ‘আটক হলো’ না লিখে ‘আটকে গেল’ লিখলে পড়তে আরেকটু আরামদায়ক হতো না কি ?
জাহিদুর রহিম
জাহিদুর রহিমের কবিতাপ্রচেষ্টায় বেশ খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য মেলে; মেলে ধ্বনিব্যঞ্জনাও। ‘মধুশালার কাব্য-৭’এ দেখি : ‘হারানো গানের পিছে সারা আকাশ আঁধারের সমতা মেনে সমাগত, কবিতার শেষ শিখা কুটিল ক্লান্তিতে মেলে ধরে বিস্মিত নয়ন।’ ‘হেমলক সন্ধ্যার গান -১’এ বলে, ‘গাছের বাকলে কান পেতে বুঝেছি প্রেমের সংকেত এক বাষ্পীভূত শোক। জল ভারি মেঘেরা উড়ে গেছে যেই পত্রহীন বৃক্ষের দেশে, যেখানে আমারও রয়েছে ছোট এক সন্ন্যাস কোণ। ঘুমের মাঝে অধিকার ছেড়ে নেমে আমি সিংহাসন হতে, নদীর পানিতে মুখ ধুতে গিয়ে দেখি কবেই ভেঙ্গে গেছে স্মৃতির আয়না, কিছুই রাখতে পারিনা হাতে।’ বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যেতে চাই না, জাহিদুরকে বলি : ভেতরে ভাব আছে, তাকে পরিচর্যা দিন, উৎকৃষ্ট ফল দেবে।
মেকদাদ মেঘ
সূর্যেরও আসে যদি ঘুম—এক
প্রেমের পাখনা মেলা রোগে ভোগে
ঢেঁকি বানে ধান সোনাপ্রাণ ভাঙে নীল ঢেঁকি
শব্দের সুতোয় উড়ে
প্রস্তুরিত পাথরের আখি, তুলোর পাহাড়
ঢেঁকি বানে ধান’ নয়, ঢেঁকি ভানে ধান—হবে; ‘শব্দের সুতোয় উড়ে’ নয়, ‘ওড়ে’ লেখাই সংগত। তবে কাব্যিক ব্যঞ্জনা যে বিদ্যমান সেকথা বলাই বাহুল্য। অনুরণনের সন্ধান মেলে পরের কবিতাটিতেও। পাঠ ও পরিচর্যা তো সকলে জন্যেই প্রযোজ্য।
ঐশী দত্ত
বিরতিহীন রোদের খেলা
জানলা দিয়ে
খেয়াল করে কে ভেসে যায়
নতুন নিয়ে
বল তো তুমি লাল-সবুজে
কোন মুহূর্ত?
কোন বিকেলে মাঠ জেনেছে
বালির শর্ত?
হাতছানিতে আসবে তুমি
বুকের কাছে?
মনের যত গাঢ় আদর
বাজুক ধাঁচে
এই শহরে কাগজ রেখে
একটু লেখ
আসবে যারা সব হটিয়ে
তাদের দেখ।
(রোদের খেলা)
পুরো কবিতাটি উদ্ধৃত করে আমোদিত হলাম। আমোদিত হলাম পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্তের চমৎকার প্রয়োগ দেখে। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি, যতোই নতুনত্ব বা পরিবর্তনের কথা বলি না ক্যানো, কবিতায় ছন্দস্বাচ্ছন্দ্য প্রায় অনিবার্য একটি বিষয়। বাংলা কবিতা গীতিময়। সুর-লয় এখানে সর্বদাই প্রাধান্য পেয়েছে। ছন্দের বিবিধরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে চলেছে; নতুন ছন্দের অভিনবত্বে চমৎকৃত হয়েছে কবিতাপাঠক। একেবারেই ছন্দ বা ছন্দস্বাচ্ছন্দ্য নেই, এমন কবিতা বাংলা কাব্যের ইতিহাসে টেকেনি। ঐশী দত্তের ‘রোদের খেলা’তে রোদ আসলে মাত্রাবৃত্তেই খেলা করেছে চমৎকার। এটাকে কেউ পদ্য বলবেন হয়তো; কিন্তু ছন্দের মিলনাত্মক বহিরাবরণকেই একমাত্র না ভেবে এর ভাবের দিকে তাকালে হয়তো কবিতা হিসেবেই মর্যাদা দেওয়া সহজ হয়।
তরুণ কবিদের উপর্যুক্ত কবিতা কিংবা কবিতাপ্রচেষ্টাগুলির সবই আমাকে আমোদিত করেছে তা নয়; অনেক কবিতাই আমাকে বিরক্ত ও বিব্রত করেছে। কোনো কোনো কবিতাকে, কবিতা হিসেবে গ্রহণ করতে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছি। কোনো কোনোটিতে আবার কাব্যের বিশ্বস্ত কোনো আবহও পাইনি। কবিতা কবির আত্মভাবের বহিঃপ্রকাশ, যা অন্যের পক্ষে পূর্ণত অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বিধায় কবিতার বিশ্লেষণ এমনিতেই জটিল। আরও জটিল সেই বিশ্লেষনকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা। সে চেষ্টাতে আমিও যাইনি। আমি শুধু এটুকুই বলি : ভালো-মন্দ, উৎকৃষ্ট-অনুৎকৃষ্ট যাই হোক না ক্যানো, উল্লিখিত কবিতার তরুণ-তরুণীরা প্রায় সকলেই সম্ভাবনাময়। কোনো শিশুকে দেখে যেমন তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যায় না, তেমনি সদ্যপ্রকাশিত কোনো কবি সম্পর্কে উচ্চবাচ্য কিছু বলা যায় না। আমি বরং কবিতাপ্রচেষ্টার জন্যে সমবেত সকলকে অভিবাদন জানাই। বলি, কবিতা কেবল লিখলেই হবে না, কবিতার যে কতগুলো প্রথাগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে; সে বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ছন্দ-অলঙ্কারাদিকে আপনি যদি গ্রহণ না করতে চান, না করুন; কিন্তু তাকে তো জানতে হবে। প্রথাগত ছন্দকে বর্জন করাটা মন্দ কিছু নয়, কিন্তু কী বর্জন করছেন, সেটাই যদি না জানেন, তবে চলবে ক্যামন করে? আপনার কবিতায় ছন্দ না থাকতে পারে, কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য থাকতেই হবে। প্রথাগত অলঙ্কার না থাকুক, অলঙ্কারাতীত ব্যঞ্জনা তৈরি করুন; পাঠক গ্রহণ করবে সেটা।
বাংলা কবিতার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সামনে রেখে যদি আত্মপরিচর্যাটাকে ঔচিত্যবোধের পর্যায়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়; অনেকেরই রয়েছে আগামী দিনের কবি হয়ে উঠবার রস ও রসদ।