বই আলোচনা
‘থালা বাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল’
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গ্যালেলিও বলেছিলেন, পৃথিবী কিন্তু এখনো সূর্যের চারপাশেই ঘোরে! তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছিল কারণ, টেলিস্কোপে গ্যালেলিও যা দেখেছিলেন, তা অন্যরা দেখতে পায়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা বই ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে গ্যালেলিওর কথা মনে পড়ল। তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে কারাগারে, নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসে অটল থাকা ও স্বকীয়তার কারণে। তাঁর কারাজীবনের অনুভব ও মনোলগ প্রকাশ পেয়েছে নতুন বই ‘কারাগারের রোজনামচা’য়।
১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর ওই বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার ও জামিন পান বঙ্গবন্ধু। এরপর মে মাসে আবার গ্রেপ্তার হন। ওই সময়ের বন্দিজীবনের দিনলিপি উঠে এসেছে বইটিতে।
জেলখানার জীবনের অন্য বন্দিদের গান শোনা, বাগান করা, বাগানে গোলাপের চারা লাগানো, গাছের যত্ন করা উঠে এসেছে তাঁর দৈনিক জীবনের কাজগুলোর মধ্যে।
জেলখানার একটা মুরগি মরে গেলে তিনি লিখছেন, ‘মুরগিটার চালচলনে একরকম গাম্ভীর্য ছিল। কি শিশুর মতো মন!’
জেলখানায় পাখিদের আসা-যাওয়া নিয়ে লিখেছেন। কাকের বাসা, কাকের অত্যাচার, কাক তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টার কথা লিখেছেন, ‘এখন তো তাদের ডিম পাড়ার সময়। বাসা ভাঙলে ওরা যাবে কোথায়?’
বইটির ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের সোপানগুলো যে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগোতে হয়েছে, তার কিছুটা এই বই থেকে পাওয়া যাবে।’
শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে, এ আত্মবিশ্বাস বারবার তাঁর (বঙ্গবন্ধু) লেখায় ফুটে উঠেছে। এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছেন কি না আমি জানি না।’
এ বইয়ে এসেছে বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগের অবস্থা, পাকিস্তান সরকারের একনায়কোচিত মনোভাব ও অত্যাচার-নির্যাতন ও একগুঁয়েমির নানা চিত্র। ফুটে উঠেছে একজন বন্দি বাবার আকুতি, অবুঝ সন্তানের প্রতি ভালোবাসা।
বইতে ১৯৬৬-৬৮ কালপর্বের কারাস্মৃতি রয়েছে। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় কারাগারে লেখা তাঁর দুটি ডায়েরি জব্দ করে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহায়তায় ডায়েরি দুটি উদ্ধার করা হয়। ওই ডায়েরি দুটো বই আকারে প্রকাশ হলো 'কারাগারের রোজনামচা'।
বইটিতে তিনটি পাণ্ডুলিপি স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিজে এর নাম দিয়েছিলেন, ‘থালা বাটি কম্বল/জেলখানার সম্বল’।
অবিভক্ত ভারতের ইতিহাস, এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মকথা প্রভৃতি বিষয়, সংশ্লিষ্ট ইতিহাস-চর্চায় অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংযোজন এ বই। একজন ছাত্রনেতার মহান রাজনৈতিক নেতা ও একটি জাতির প্রধান রূপকার হয়ে ওঠার ইতিহাস এই বইতে পাওয়া যাবে।
রাজনৈতিক নির্বাসনে থেকে বা কারাগারে থেকে বিশ্বসাহিত্যের অনেক গল্প-উপন্যাস ও আত্মজীবনী লেখা হয়েছে। যেমন—জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’, জন বানিয়ানের ‘দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস’, থমাস পাইনের ‘দ্য এজ অব রিজন’, নেলসন ম্যান্ডেলার ‘দ্য লং ওয়াক টু ফ্রিডম’, হুগো গ্রোশিয়াসের ‘অন দ্য ল অব ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ও বার্ট্রান্ড রাসেল ‘ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ফিলোসফি’, সার্ভেন্তেসের ‘দন কিহোতে’ ইত্যাদি। মাক্সিম গোর্কি রাজনৈতিক নির্বাসনে থেকে ‘মা’ লিখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ এই তালিকায় ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
বইয়ের ভূমিকায় শেখ হাসিনা লিখেছেন, “কারাগারের রোজনামচা পড়ার সময় জেলখানা সম্পর্কে পাঠকের একটা ধারণা হবে। আর এই লেখার মধ্য দিয়ে জেলের জীবনযাপন ও কয়েদিদের অনেক অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধ জগতে পা দিয়েছিল তা জানা যাবে।”
বইটিতে বাংলা তথা বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে প্রতিটি বাক্যে। তিনি জেলে থেকেও জনগণকে অনুভব করেছেন তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে।
তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত ২০ বছর জেল খেটেছিলেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে তাঁর কবিতা ‘আমি জেলে যাবার পর’ কবিতার একটি পঙক্তি :
“আমি জেলে যাবার পর/ সূর্যকে গুণে গুণে দশবার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী/ আর আমি বারংবার সেই একই কথা বলছি/ জেলখানায় কাটানো দশটা বছরে/ যা লিখেছি/ সব তাদেরই জন্যে/ যারা মাটির পিঁপড়ের মত/ সমুদ্রের মাছের মত/ আকাশের পাখির মত/ অগণন।”
সংক্ষেপে বই পরিচিতি
কারাগারের রোজনামচা
লেখক : শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশকাল : মার্চ ২০১৭
প্রকাশক : বাংলা একাডেমি
প্রচ্ছদ : তারিক সুজাত
পৃষ্ঠা : ৩৩২
মূল্য : ৪০০ টাকা