অন্তর্জলী যাত্রা : কাহিনীশূন্য সুরম্য ভাষাস্থাপত্য
উপন্যাস বলি, আর ছোটগল্পই বলি; সৃজনশীল বাংলা সাহিত্যের গদ্যভাষা বিনির্মাণে কমলকুমার মজুমদার এক বিরলতম অধ্যায়। তাঁর ভাষাভঙ্গিমা এমনই দুরূহ যে, সাধারণ পাঠকের পক্ষে এর পাঠ অব্যাহত রাখা ও পাঠোদ্ধার করা বড়ই কষ্টকর, কখনো কখনো প্রায় অসম্ভব বটে। শুরুতেই বাধা পর্বতপ্রমাণ, প্রথম দর্শনেই প্রতিহত হয়ে ফিরে আসার মতো দুর্গম; কিন্তু জয়ে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়ে এগিয়ে যেতে পারলে পাঠশেষে এভারেস্ট জয়ের আনন্দ হয়। কমলকুমারের প্রথম গ্রন্থ ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ উপন্যাসখানি পাঠে এ রকমই বিজয়ানন্দ ছড়িয়ে যায় পাঠকের হৃদয়ে।
কমলকুমার মজুমদারের জন্ম ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর, মৃত্যু ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯। মৃত্যুর পরে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘গোলাপ সুন্দরী’, ‘অনিলা স্মরণে’, ‘শ্যাম-নৌকা’, ‘সুহাসিনীর পমেটম’, ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’, ‘খেলার প্রতিভা’ এবং ‘শবরীমঙ্গল’ নামে আটটি উপন্যাস নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয় কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস সমগ্র। আরো পরে ২৯টি ছোটগল্পের সমন্বয়ে সুনীলেরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে গল্পসমগ্র। তথাকথিত জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা না করা কমলকুমার এই অল্পকিছু রচনার মধ্য দিয়েই বাংলাসাহিত্যে অমরত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন; এ কথা তাঁর পাঠকমাত্রই অবলোকন করতে পারেন।
‘অন্তর্জলী যাত্রা’ কমলকুমারের জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস। একটি অল্প পরিচিত পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় এটি প্রথম প্রকাশিত হলে কমলকুমার নিজেই বেশকিছু ফটোকটি করে নবীন লেখকদের কাছে বিলি করেছিলেন, এবং তারা পড়লেই তিনি খুশি- এ রকম একটি তথ্যের মাধ্যমে আমরা অনুমান করতে পারি- তিনি সত্যিই হয়তো লেখকদের লেখক হতে চেয়েছিলেন। বাংলা কথাসাহিত্যের অতল ব্যতিক্রম কমলকুমার মজুমদার তাঁর অতুলনীয় লিখনক্রিয়ার দ্বারা ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ উপন্যাসখানিতে এক অতি প্রাচীন, মুমূর্ষু পুরুষের অন্তর্জলী তথা মৃত্যুযাত্রা নিয়ে গঙ্গাতীরবর্তী শ্মশানঘাটে যে অন্ধকারময়, ভয়ঙ্করতর ও অবিশ্বাস্যপ্রায় ভাষাস্থাপত্য নির্মাণ করেছেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর।
ভারতীয় ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সতীদাহ প্রথা। মৃত স্বামীর সঙ্গে জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার বর্বরতম সামাজিকতার যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া অগণিত ভারতীয় রমণীদেরই একজন ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র যশোবতী। তাকে নিয়ে অন্ধ শাস্ত্র আর সামাজিক সংস্কারের অজুহাতে জ্যোতিষী অনন্তহরি, কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ আর তারই জন্মদাতা লক্ষীনারায়ণ যে অমানবিক খেলা খেলেছে তারই লোমহর্ষক বাস্তবতার ছবি ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। অতীব প্রাচীন, কালের নিষ্ঠুর ক্ষতচিহ্ন শরীরে ধারণকারী, অত্যাসন্ন মৃত্যুসম্ভাবনায় শ্মশানে আনীত সীতারাম প্রহরের পর প্রহর যখন জীবন্মৃত বেঁচে থাকে, তখনই ভবিষ্যৎ গণনার সূত্র ধরে ফতোয়া জারি করেন জ্যোতিষী অনন্তহরি। জানান, ‘চাঁদ যখন লাল তখন তার প্রাণ যাবে... যাবে কিন্তু একা যাবে না হে। দোসর নেবে। শুনে উপস্থিত লক্ষীনারায়ণ ও চণ্ডাল বৈজুনা’ প্রথমত বিভ্রান্ত হলেও কন্যাদায়গ্রস্থ লক্ষীনারায়ণ যেন এর ভেতরেই নতুন আশার সন্ধান পান। তবে বৈজুনাথ, যে কিনা আকাশের তারাগুলোকে আকাশে নয়, জলেই দেখে, মড়া পোড়ানোই যার প্রধান কাজ; সে বড়ো অধীর হয়, পতিত জমির ন্যায় নিজের অনাহত বুকে হাত বুলিয়ে, জ্যোতিষীর ভবিতব্যপ্রকাশী অঙ্কের দিকে তাকিয়ে, জল-স্থল-অন্তরীক্ষ ভেবে মহাকৌতুকে একসময় বলে ওঠে, ‘দোসর ! দোসর বলতে তবে বুঝি আমি ! বুড়ো বুজ্ঝি আমায় লিবে গো !’ কিন্তু তার এই কৌতুক জ্যোতিষীর জাত্যাভিমানে আঘাত করে। বলেন, ‘হারামজদা, তোর সাহস তো বড় কম নয়। সাধে কি চাঁড়াল জন্ম হয় তোর, কুট হবে, বেটা কুট হবে, বেটা বামুনের দোসর !’ অভিশাপ হানে, ‘পাষণ্ড, বেটা তুই কুকুর হয়ে জন্মাবি!’ আশ্চর্য বৈজুনাথ অসহায় হাসি হেসে বলে, ‘সে বড় ভাল হবে গো ঠাকুর—কুকুর হওয়া ঢের ভাল।’
বৈজুনাথ যেখানে এমন অমানবিক মানুষ হওয়ার জন্য লজ্জিত, সেখানে লক্ষীনারায়ণ কন্যাদায় থেকে মুক্তিলাভের জন্য ঘাটের মড়া সীতারামের সঙ্গে যশোবতীর বিয়ের জন্য অনন্তহরির কাছে অনুনয় করে। বলে, ‘মান বাঁচাও আমার। ব্রাহ্মণের ইহকাল পরকাল রক্ষা কর... কোন উপায়ে ওদের রাজী করাও... যদি না হয় আমি গঙ্গায় ঝাঁপ দেবো...।’ বাবা হয়েও ইহকাল-পরকাল রক্ষার শাস্ত্রান্ধ এই আবদারে বাধা দিয়েও, যে মানুষটা রাত কাটায় কিনা তার নিশ্চয়তা নেই, তার সঙ্গে একটা ষোড়শী কুমারীর ভবিষ্যৎ জুড়ে দেওয়ার এহেন অন্যায্য কাজে আপত্তি জানিয়েও শেষ রক্ষা করতে না পেরে চলে যান কবিরাজ বিহারীনাথ। বৈজুনাথও ব্যর্থ হয় আপত্তি জানিয়ে। বাবা সীতারামের কোমরের চাবিগোছা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত বলরাম ও হরেরাম, এমনকি সর্বশক্তিরহিত সীতারামও বিয়েতে সায় দিলে আহ্লাদিত লক্ষীনারায়ণ এক দৌড়ে গঙ্গার কাছে গিয়ে বলেন, ‘মাগো মা মা এতদিন বাদে দয়া করিলে মা’। গঙ্গার নাম করে এরকম অপকর্ম হয় বলেই হয়তো এ ঘাটকে বৈজুনাথ ‘খানকী খচ্চর ঘাট’ বলে বিদ্রুপ করে। আপন অঙ্গপ্রত্যঙ্গই যে নাড়াতে পারে না; যাকে দেখে বাজনদার’রা ভুলে যায় বাজানোর কথা; যে কোনো কুমারী মূর্ছা যেতে পারে যার কিমাকার মুখদর্শনে; সেই ঘাটের মড়া সীতারামকে গোধূলী সন্ধ্যায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো সালঙ্করা সুন্দরী যশোবতীর গলায়। পুরুষশাস্ত্রশাসিত অন্ধসমাজের শিকার যশোবতীরও যেন কিছু করার নেই।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়; পাঠকের আশ্চার্যান্বিত হওয়ার সবে বোধ হয় শুরুই হলো। রাত পোহাবার মতো প্রাণশক্তি যার আছে কি না সন্দেহ, সেই সীতারাম বিয়ের পর কেবল রাত্রিপারই করলেন না, আবার নতুন জীবনশক্তি ফিরে পেতে থাকলেন। আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলতে বলতে, অস্পষ্ট একটা দুটো শব্দ; অতঃপর প্রায় স্পষ্টতই, ‘বউ তোমাকে নিয়ে ঘর’- শব্দনিচয় উচ্চারণ করে। নববসন্তের আগমণে উদ্বেলিত যুবকের মতো গাইতে বলেন নববধূকে। বিস্মিত, লজ্জিত যশোবতী যখন মুখে কাপড় গুঁজে হাসি সংবরণ করতে ব্যস্ত, তখন তাকে আরো আশ্চর্যান্বিত করে দিয়ে বৃদ্ধ নিজেই গেয়ে উঠলেন, ‘কি হে বাঁশী বাজায় বধূ’। গাইলেন, ‘বলি পরান বাঁশী ফেলে দাও, আমাকে মজিওনা প্রাণ তোমাতে মজাও’। বেঁচে থাকবার এক আশ্চর্য সঞ্জীবনী সুধাই যেন পেয়ে গেলেন সীতানাথ। সে সুধা এমনই যে পরের দিন দিবস সাঙ্গ হয়ে যখন পুনরায় রাত্রি হলো, আত্মীয়পরিজনহীন শ্মশানভূমিতে অন্ধকারভীত যশোবতীকে সীতারামই নিরাপত্তা দিতে চাইলেন ! যশোবতীও স্বামীসহানুভূতিশীল হয়ে তাকে আগলে রাখতে উদ্দীপিত হয়ে ওঠেন। মৃতপ্রায় বৃদ্ধের সাথে শ্মশানেই শুরু করেন এক আশ্চর্য, অলৌকিক দাম্পত্যজীবনের ! স্বামীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘এ জীবন গেল, কি হয়েছে ? আবার জন্মাব আবার ঘর পাতব!’ কিন্তু প্রৌঢ়শিলাসম সীতারাম শিশুসুলভ আবেগে আহ্লাদিত; পরজন্ম নয়, এই জন্মেই আবার নবদম্পতির জীবন শুরু করতে উদগ্রীব। ‘বউ আমি আবার ঘর পাতব... ছেলে দুব’, এমন হাস্যউদ্রেককারী কিন্তু মর্মবিদারী বৃদ্ধবাচনে অবাকপ্রায় পাঠক যখন অসহ্য উৎসাহ আর অপ্রকাশ্য আশঙ্কায় প্রহর গোনে তখনই পুনরায় মঞ্চে আবির্ভূত হয় প্রবল জীবনাকাঙ্ক্ষিত বৈজুনাথ।
স্বামীর সঙ্গে সহমরণে কেবল স্বর্গলাভই হয় না, আপন জাতকূলকেও উদ্ধার করা যায়; চিরকাল সেই সতী-সাধ্বী রমণীর গুণকীর্তন করে সমাজ। পিতা লক্ষীনারায়ণ নিজেই যখন কন্যাকে মরার জন্য এভাবে প্রলুব্ধ করতে ব্যস্ত তখন সমাজকর্তাদের চোখে ছোটো জাত চণ্ডাল বৈজুনাথ যশোবতীর মতো নিষ্কলুষ সুন্দরীকে জীবিত পোড়াতে অপারগতা প্রকাশ করে। যশোবতীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে অমানবিক সহমরণের হাত থেকে। বলে, ‘কনে বউ, তুমি জান... তুমি কি ? দোসর... ভাঙা কুলো’। মড়া পোড়া তার সহ্য হয়, চিতায় কত লোক তার হাতে ঠেঙানি খায়; কিন্তু জ্যান্ত বউ পুড়বে, এটা সে মেনে নিতে পারে না। ভাবের পাগল নয়, ভবের পাগল হিসেবেই সে নিজেকে দাবি করে। যশোকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তুমি পুড়বে চচ্চড় করে... ভাবতে আমার চাঁড়ালের বুক ফাটছে গো’। কণ্ঠে তার উথলে ওঠে মানবিক আবেগের ঢেউ। ধ্বনিত হয়, ‘কনে বউ, তুমি পুড়বে, আকাশ লাল হবে, ভয়ে গরু পর্যন্ত বিইয়ে ফেলবে গো। তুমি গেলে, কি আর বলব আমি চাঁড়াল, দেশে আকাল দেখা দেবে... লাও... লাও তুমি পালও... কনে বউ পালাও।’
সমাজ-সংস্কার-স্বর্গের চাইতে মাটির মানুষ আর তার পৃথিবীর গুরুত্ব তুলে ধরার যে চেষ্টা বৈজু করে তা ব্যর্থ হয়, সংস্কারভীত যশোবতী লোভী ডাকাত বিবেচনাতেই তাড়াতে চায় তাকে। তবু পরম মমতা আর অপরিমেয় স্থৈর্যের সাথে পুনঃ পুনঃ প্রচেষ্টা চালায় বৈজু। জীবনভাবনায় দার্শনিক যুক্তির সন্ধান মেলে তার। বলে, ‘কাল শালা যাকে লিয়েছে সে যাক্ । কিন্তু কেউ কাউকে ঠেলে চিতায় ফেলবে, এটা কি বল ?’ অনন্তহরির মতো স্বর্গলোভী ব্রাহ্মণেরা যাকে যাকে ছোট লোক চণ্ডাল বলে গালি দেয়, সেই চণ্ডাল হয়ে ওঠে মানবিকতার জ্বলন্ত বিবেক। সত্যিকার স্বজনের আন্তরিকতাতেই সে জানায়, ‘আমি মারলে ঠেঙ্গা ফিরলে লাঠি নই, উঁচু নই চাঁড়াল গো, চাঁড়াল,... পুঁথিপাঠ নাই, তোমার চিতা করব না হেঁকে বললুম... আমি ঠাকরুণ ইন্দ্রত্ব আশা করি না, বৈকুণ্ঠ বাস চাই না, নয় হে দুঃখ হয়েছিল... দেহ বড় ভালবাসি মড়াকে যত্ন করি...।’ যশোবতীর মাঝে তবুও কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না। এবার চণ্ডালত্বের সম্পূর্ণ সীমা অতিক্রম করে বিজ্ঞের মতোই বৈজু বলে, ‘যে মানুষ নিজে ভস্ম হতে চায়, সে এ সোনার ত্রিভুবন জ্বালাতে পারে গো...।’
যশোবতীকে দেখেই যেন এই মনুষ্যত্বের দীক্ষা পেয়েছে সে, শব থেকে শিব হয়েছে। আবার পালানোর অনুরোধ অগ্রাহ্য হলেও সে যশোকে পুড়তে দেবে না বলে দৃঢ়চিত্তেই ঘোষণা দেয়। যশোর মতো যৌবনদীপ্ত কুমারীকে মৃত্যুপথিক সীতারামের হাতে তুলে দেওয়াকে কাঠের বিড়ালের দ্বারা ইঁদুর ধরবার মতো বিদ্রুপাত্মক ও হাস্যকর প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখে সে। আকাশ-বাতাস নয়, এমনকি লোকে যাকে পূণ্যস্থান বলে সেই গঙ্গার ঘাটকে বৈজু ‘খানকি খচ্চর ঘাট’ বলেও বর্ণনা করে; কেবল ধুক ধুক করা রক্তমাংসের মানবশরীরই তার ভালো লাগে। তাই মাঝরাতের চাঁদের আলোয় যখন অলৌকিক দম্পতি ঘুমে অচেতন তখন বৃদ্ধ সীতারামকে শয্যা থেকে তুলে নিয়ে নদীতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। পারে না সে কেবল সীতারাম তার কঙ্কাল দু’হাতে বৈজুর গলা জড়িয়ে ধরেছিল বলে নয়, যার জন্য এহেন ঝুঁকি নেওয়া, সেই যশোবতীই যখন শ্মশানকাঠ দিয়ে সজোরে আঘাত করে বৈজুকে তখন আহত বৈজুই সীতারামকে শয্যায় ফিরিয়ে দেয়। তবে যশোবতীও পরাভূত হয় বৈজুর কাছে। অন্যভাবে। হয়তো মুগ্ধতায়, রাগে, ক্ষোভে এবং শরীরী উদ্দীপনায় বৈজু জড়িয়ে ধরে গঙ্গাস্নানে চণ্ডালছোঁয়া থেকে শুদ্ধ হতে চাওয়া বিবসনা যশোকে। ‘তুই কৃমিকীট হয়ে থাকবি’— বলে অভিশাপ দিলে এর উত্তরে মর্মাহত বৈজু বলে, ‘মনুষ্যজনমে গড় করি, আমি আর চাই না কনে বউ... কৃমিকীট কুকুর হওয়া ভাল গো, তাদের জাগা ঘরে চুরি নেই, যাতনাও দেয় না।’
ব্যর্থ বৈজু শ্মশান ছেড়ে চলে যেতে চাইলে যশোই তাকে রাতের মতো থাকতে বলে। পরদিন পুনঃযৌবনাকাঙ্ক্ষী বৃদ্ধ যশোর কাছে ফুলশয্যার আবদার জানালে কাহিনীতে ঈষৎ বৈচিত্র্য সম্ভাবনা দেখা দেয়। পাশের বাড়ি থেকে দুধ এনে ফেরার পথে বৈজুর সাথে কথা বলতে গিয়ে সামান্য হাসাহাসি করলে ক্ষেপে ওঠে সীতারাম। ‘হারামজাদি নষ্ট খল খচ্চর মাগী’ সম্বোধনে গালি দেয়। মুখব্যাদান করে বলে, ‘রাক্ষুসী ন্যাঙনী মাগী— লেথিয়ে তোর মুখ ভাঙ্গি...’। তার পায়ে ধরে মাফ চাওয়া সত্ত্বেও হাজার বছরের পুরুষ শাসিত সমাজের প্রতিনিধি বুড়ো সীতারাম গর্জে ওঠে, ‘মাগী...পটানি ফাজিল...ডুবে মর গা’ বলে। গোঙরাতে থাকে। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন ডুবে মরতে যায় তখন যশোকে ফিরে আসার জন্য অনুনয় করে। আশ্চর্য নারী বটে যশোবতী! হিন্দু রমণীর চিরকালের কুসংস্কার থেকে সামান্যতমও বের হতে পারে না, বরং পতিই পরম গতি মনে করে এমন চরম অবমাননার পরও ফিরে আসে বৃদ্ধের কাছে। কেবল ফিরেই আসে না, ন্যাড়ার সিঁথি কাটার শখের মতো সীতারামের ফুলশয্যার শখ পূরণের জন্য ফুল আনতে যায় ! তার কাজ দেখে বৈজুনাথ বলে, ‘তুমি কি গো, তোমার মন কি গো; মোষের শিঙে সরষে দাঁড়ায় না’।
যশোরূপের মুগ্ধতা ছড়ায় তার কণ্ঠ-‘চন্দন চাঁদ তোমার কাছে পোড়া কাঠ গো... তুমি সত্যিই সুন্দর, তুমি ত্রিলোকেশ্বরীর ঘরণীর থেকে সুন্দর... তুমি।’ একটি মনুষ্যকঙ্কালকে নিজের বউ বলে পরিচয় করাতে গিয়ে যশোবতীর বাধা পেয়ে বলে, ‘বুড়ো যদি তোমার ইহকাল পরকাল হয়, এইইবা কি দোষ করলে গো কনে বউ’ । এরপর দৃশ্যায়িত হয় গল্পের সবচাইতে প্রত্যাশিত ও সত্যিকার রোমাঞ্চকর চিত্রকল্পটি। কঙ্কালটিকে ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়ে পড়ে যাওয়া যশোবতীর বুকে অনিবার্যভাবে শায়িত হয় বৈজুনাথ। জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মতো সত্যিকার পুরুষের আলিঙ্গনসুখ অনুভব করে যশোবতী। এরই মধ্যে ভরা কোটালের বিপুল জোয়ারে ভেসে যায় বৃদ্ধ সীতারাম। তাকে বাঁচাতে গিয়ে হয়তো যশোবতীরও ঘটে সলিলসমাধি।
২.
সতীদাহ প্রথার করুণ অমানবিকতার কথা আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি। জেনেছি সে প্রথাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য গোঁড়া সমাজপতিদের সীমাহীন স্বার্থপরতার কথা । কিন্তু সেই সতীদাহ নিয়ে এরকম অন্ধকারাচ্ছন্ন, ভয়ঙ্করতম ভাষাসৌকর্য গড়ে উঠতে পারে তার হয়তো কমল মজুমদার পাঠ না করলে উপলব্ধি করা যেত না। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের অনেক দৃশ্যেই হয়তো স্বামীর চিতায় স্ত্রীর জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার অথবা দগ্ধপূর্ব মুহূর্তে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যাওয়ার দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে, তবে তা এরকম করে একজন মৃত্যুপূর্ব বৃদ্ধের সাথে শ্মশানে, কেবল তার সহমরণের সঙ্গী করার জন্য একজন ষোড়শী সুন্দরীর জীবনকে বলী দেওয়া তথা সমগ্র নারী সম্প্রদায়কে পুরুষের চোখে মূল্যহীন করে তুলে ধরার এমন মর্মস্পর্শী বাস্তবতার চিত্র উপস্থাপন করা যেতে পারে তা বিরল কমল মজুমদারই বোধ হয় দেখালেন। আর এই দেখানোর ভাষাটাও যে এমন ভয়ঙ্কর চিত্ররূপময়, তাৎপর্যাতীত হয়ে উঠতে পারে তা মজুমদার ছাড়া আর কারো পক্ষেই দেখা ও দেখানো সম্ভব ছিল কিনা সন্দেহ। তাঁর সংস্কৃতপ্রধান শব্দপ্রসূত বর্ণনাবৈভব পাঠ করলে প্রথমত মনে হয় এ বুঝি বঙ্কিম বা বঙ্কিমপূর্ববর্তী বংলা গদ্যের প্রাণস্পন্দন ! সন্দেহ জাগে কমল মজুমদার বিশ শতকের কোনো কথাশিল্পী তো ! উদাহরণত উল্লেখিত হতে পারে সীতা-যশোর বিবাহোত্তর অন্তরের ভাবনাকে দৃশ্যায়িত করার বর্ণনাটি :
“অদ্যের এই বেলাতটের পড়ো-নিঃসঙ্গ সৌন্দর্যরে বাস্তব বিদ্যামানতার জন্য, এই আদিষ্ট ভূমি - ভূতগ্রামের জন্য, তিনি নিজেই বর প্রার্থনা করিয়াছিলেন; এবং বালকস্বভাব ভোলানাথ, যিনি সর্ব্বমঙ্গলময়, যিনি চিৎস্বরূপ, যাঁহার বিভূতির অন্তর্গত দৃশ্যাদৃশ্য সৃষ্টি, যিনি অদ্বিতীয় পুরুষ, ষড়ৈশ্বর্য্যময়ী শ্যামার চরণাশ্রিত প্রৌঢ়শিলাবৎ অনড়; ইদানিং যিনি শঙ্কর, যাঁহার বাম জঙ্ঘাপরি নবারুণ প্রকট-চম্পক-বিদ্যুৎপর্ণা আসীনা, অর্থাৎ পার্ব্বতী, অধরে মধুরার মিথুন-হাস্য এবং উদাসীকে প্রেক্ষণব্যস্ত- সেই পার্ব্বতীপ্রিয় শঙ্কর, যিনি অবিচারিত চিত্তে মানুষকে চারিফল দান করেন, তিনি নিশ্চয়ই, যশোবতীর প্রার্থনায়, বলিয়াছিলেন— তাহাই হউক। এবং তিনি, যশোবতী, বৃদ্ধকে জড়াইয়া ধরিলেন।”
অচলিত, অল্পচলিত শব্দ আর জটিলতর বয়াননির্ভর এরকম দুর্বোধ্য গদ্যে গল্প বলার সত্যিই কি কোনো দরকার ছিল? সাহিত্য যদি কেবল নিজের জন্য না হয় তবে তাতে পাঠক সংযুক্তির প্রয়োজনে আরো সহজবোধ্য কর উচিত ছিল না কি? এরকম অনেক প্রশ্ন, এমনকি অভিযোগও দানা বাঁধতে পারে সাধারণ পাঠকের মনে। কিন্তু কমল কুমার মজুমদারের তাতে যায় আসে না। জীবদ্দশাতেই তিনি কখনো নিজের লেখাকে অপরের পাঠের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করেননি; পাঠক চাইলেও লেখেননি; যেটুকু লিখেছেন একেবারে নিজের ইচ্ছেমতোই লিখেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখকও তাঁকে সহজ করে লিখতে বলে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে কি তাঁর লেখা কি কেবল দুর্বোধ্য বিধায়, জটিল বিধায় অমূল্যায়িত থাকবে? নিমের রস খেতে খুব কষ্ট হয় বলে কম লোকে খায় বলে কি নিমের গুণের কমতি হয়? না।
কমল মজুমদার যতই অপঠিত বা অল্পপঠিত হোন না কেন, যতই অপ্রচলিত ও তৎসম শব্দের বাহুল্যতায় জটিল গল্পভাষা তৈরি করুন না কেন, লেখক হিসেবে তিনি যে অত্যন্ত উঁচুস্তরের এবং দুর্লভ প্রজাতির তা গভীর বোধসম্পন্ন পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না। বরং তাঁর রচনায় ধরা পড়ে ভাষা বিন্যাসের অনন্যতা। এই অনন্যতায় অভ্যস্ত নয় বলে সাধারণ পাঠক ভিমড়ি খায়। পাঠক হিসেবে এটা তার অযোগ্যতা। পাঠকের এই অযোগ্যতাকে উদ্দেশ্য করে উপন্যাস সমগ্রের ভূমিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বাঙালি পাঠক তাতে অনভ্যস্ত বলেই হোঁচট খায়। যারা তাতে পেছন ফেরে, তারা কমলকুমারের পাঠক হবার যোগ্যতা তখনো অর্জন করেনি, বুঝতে হবে। যারা কাব্যপাঠে অভ্যস্ত, তারাই এগিয়ে যেতে পারে। এ ঠিক গদ্য নয়, কাব্যের সৌরভ সর্বত্র অথচ চকিতে এক একটি দেশজ শব্দ এসে ঘোর ভেঙে দেয়।’
“অন্তর্জলী যাত্রা’র শব্দ-উপমাগুলো যখন অনিন্দ্য সব চিত্রকল্পের জন্ম দেয় তখন তা অসামান্য মনে হয় । কমল কুমার অদৃশ্যকেও দৃশ্যমান করে তোলেন তাঁর ভাষা দিয়ে। গাম্ভীর্যকে নির্বোধরূপে প্রকাশ করেন। তাঁর চরিত্রের হাসি রাতের অন্ধকারের সাহায্যে অজানা তন্তু প্রস্তুত করে; শতচ্ছিদ্র সম্ভ্রম দিয়ে নিজেকে ঢাকবার চেষ্টা করে । তাঁর চরিত্র বিস্ময়কে সকালের প্রথম সূর্যে শুকিয়ে নেয়; তাদের কণ্ঠস্বরে জীরেন গাছের হিম অনুভূত হয়। তারা চক্ষুদ্বয়কে, মনকে, শ্বেতপদ্মকুসুমাদপি বিবেককে জিহ্বা দ্বারা লেহন করে। তাদের কর্ম বায়ুচালিত চৈত্রের বিশুদ্ধ পাতার মত উধাও হওয়ার পূর্বমুহূর্তে কামজ্বর পীড়িত হয়; জীবের মতো চঞ্চল হয়। তাদের উক্তিতে জলে নোঙর নিক্ষেপ করার আওয়াজ পাওয়া যায়। কেউ কেউ ‘নিদ্রাকে হস্ত দ্বারা স্পর্শ’ করে; কারো স্বরের মধ্যে বিড়াল ও পাখির ঘোরতর যুদ্ধের আওয়াজ পাওয়া যায়। তাদের গীতের বাণী পোড়া কাগজের মতো গঙ্গার হাওয়ায় ফরফর করে উড়ে যায়; ‘ভয় যেন অন্য কোথাও স্তন্যপানরত’ থাকে। ব্রাহ্মণদের কথাবর্তায় ‘কলহরত খানকী’দের আওয়াজ ধ্বনিত হয়; শ্মশানভূমি পক্ষীশাবকের ন্যায় কাতর হয়ে পড়ে। স্তব্ধতাকে শ্মশানে শায়িত দেখা যায়; সময় সেখানে শেফালী, হস্তীশাবকের ন্যায় চিত্রায়িত হয়। মানুষের প্রাণহীন শরীর পোড়ে যেখানে, মড়া পোড়া গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারিতে ভরে থাকার কথা, সেখানে, সেই শ্মশানদেশে এরকম রহস্যঘন, শৈল্পিক, লোমহর্ষক চিত-প্রতিচিত্রাদির উপস্থাপন সত্যিই বিস্ময়কর। এহেন বিস্ময়কর কাজটাই করেছেন কমল কুমার।
বাংলা সাহিত্যের অসামান্য সব্যসাচী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কমলকুমার ও ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বাংলা সাহিত্যে এসে পড়েছে আচম্বিতে, এর কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না, এই গদ্যরীতি ও কাহিনী বিন্যাস সম্পূর্ণ অভিনব।’ কথাটি যে কতবড়ো সত্য, গ্রন্থখানি পাঠ শেষে নিমীলত চক্ষে পুরো বাংলা সাহিত্যের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করলে তা উপলব্ধি করা যায়। সেই উপলব্ধি থেকেই বলতে দ্বিধা থাকে না যে, একজন মৃতপ্রায় প্রৌঢ়ের মৃত্যুযাত্রা নিয়ে এমন বিবিধ অলঙ্কারঠাসা, অতুল্য, অনিন্দ্য ভাষাস্থাপত্য বিনির্মিত হতে পারে, এই উপন্যাসখানি হাতে না এলে কোনোদিনই হয়তো তা জানা সম্ভব হতো না। কাহিনীপ্রধান বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের বিপরীতে কাহিনীশূন্য ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র এই সুরম্য ভাষাস্থাপত্যখানি এক অতল ব্যতিক্রমই বটে।