আবুবকর সিদ্দিকের খরাদাহ : একটি মুগ্ধপাঠ
একুশ শতকের অষ্টাদশ বার্ষিক বইমেলাতে কাটিয়েছি অনেকগুলো দিন। কথা হয়েছে নতুন-প্রবীণ অনেক লেখক-পাঠক-সমঝদার, সাহিত্যতাত্ত্বিকের সঙ্গে। ভেসে গেছি আলাপে-আলোচনায়। বইমেলা শেষ হওয়ার পর মনে করতে চেষ্টা করেছি সেইসব কথাবার্তার চুম্বক অংশ। তখন খেয়াল হয়েছে, আরে আববুবকর সিদ্দিকের নাম তো উচ্চারিত হতে শুনিনি একবারও। নিজেও করেছি বলে মনে পড়ে না। ধিক্কার জেগেছে নিজের ওপর। ১৯৪৭ সালের পর থেকে আমাদের দেশে যত উপন্যাস রচিত হয়েছে, তাদের মধ্যে যত হ্রস্ব একটি বাছাই তালিকাই করা হোক না কেন, আবুবকর সিদ্দিকের ‘খরাদাহ’ সেগুলোর মধ্যে আসবেই। শুধু গদ্যের বৈশিষ্ট্যের কারণে ধরলেও আসবে। অমন গনগনে গদ্য তো আর কারো কলমে দেখলাম না।
শুধু লেখকের জনসংযোগের ঘাটতি যদি এমন একটি উপন্যাস থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে, তাহলে স্বীকার করতে হবে, পাঠক হিসেবে আমরা নিতান্তই নিম্নশ্রেণির।
১.
‘ভূমিহীন দেশ’ নামের অপূর্ব গল্পের সংকলন দিয়ে আবুবকর সিদ্দিকের গদ্যের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সেই ছাত্রজীবনে। বলতে দ্বিধা নেই যাকে বলে মুগ্ধ হওয়া, সেটাই ঘটেছিল আমার ক্ষেত্রে। ভিন্নধর্মী এক স্বাদ পেয়েছিলাম। পেলব-কোমল-মোলায়েম নয় আবুবকর সিদ্দিকের গদ্য। বরং বলা যায়, তার গদ্য হচ্ছে ঋজু শানিত খাপখোলা তলোয়ারের মতো। এত তীব্র ঋজু গদ্য তার আগে আমার পড়া হয়নি। পরেও খুব একটা না। পাঠককে এই গদ্য ঠাঁইনাড়া করে, স্থির থাকতে দেয় না এক মুহূর্ত, তাকে ভাববার অবকাশ দেয় কম, ভাবার আগে মস্তিষ্কে জ্বালিয়ে দেয় তীব্র ক্রোধের আগুন। সেই সদ্য যুবকত্বে পা রাখা এই পাঠকের মনে হয়েছিল—খাপখোলা তলোয়ারের মতো গদ্যই আবুবকর সিদ্দিককে মানায়। মনে হওয়ার কারণ আছে। কোমল, পেলব গদ্যের ঠাসবুনোট দিয়ে কোনো কোনো লেখক চান মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে সুর তুলতে। তারা হৃদয়ের কারবারি। আর এই গদ্য যে গদ্য আবুবকর সিদ্দিকের তা আঘাত হানে মানুষের হৃদয়ে নয়—মস্তিষ্কে, মননে বিবেকে। কলাকৈবল্যবাদীরা যেভাবেই সাহিত্য-শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করুন না কেন, যতই তারা শিল্পের নিরপেক্ষতার দাবি করুন না কেন সাহিত্য কখনোই নিরপেক্ষ হতে পারে না। সাহিত্যিক তো ননই। কারণ শ্রেণিবিভক্ত সমাজকাঠামোয় দ্রুত মেরুকরণের যুগে নিরপেক্ষতার দাবি যে সুবিধাবাদিতারই নামান্তর তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাহিত্যিক যদি নিজের জীবনের কাছে, নিজের সাহিত্যের কাছে সৎ হন, তবে তিনি নিরপেক্ষতার মুখোশ কিছুতেই আঁটতে পারবেন না। আবুবকর সিদ্দিকও তাঁর সামনে কোনো আড়াল রাখেননি। চেষ্টা করেননি নিজেকে ঢাকার। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেন চন্দ, জগদীশ গুপ্ত, অমিয়ভূষণ মজুমদার যে ধারার লেখক আবুবকর সিদ্দিকের গদ্যও সেই ধারারই সনিষ্ঠ উত্তরাধিকার। তবে প্রকাশ একেবারে অন্যরকম। একেবারেই নিজস্ব।
২.
বাংলাদেশের, বিশেষত, উত্তরবঙ্গের, সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় খরা। যা কিছুটা প্রাকৃতিক এবং বহুলাংশে মনুষ্যসৃষ্ট। এই খরা এবং খরার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিষক্রিয়ায় এক বিশাল ভূ-ভাগের লক্ষ-কোটি মানবসন্তানের সর্বস্বান্ত হবার নিষ্করুণ ছবিকে ধারণ করেছে আবুবকর সিদ্দিকের উপন্যাস ‘খরাদাহ’।
খরার থাবা প্রকৃতিতে। লেখকের ভাষায়—‘গাছ নেই। থর থর করে রোদের কাঁপা। চোখ জ্বালা করে সে রোদের জেল্লায়। মাথার ভিতর সাদা আলো ছ্যাঁৎ করে জ্বলে ওঠে। নীচের মাটি ফেটে পাঁচ ছ’ইঞ্চি হাঁ হয়ে আছে। সেই ফাটলের বাষ্প চুষে বাঁচা কিছু ক্যাকটাস আর বাবলা গাছ দাঁড়িয়ে আছে। একটানা শূন্যতার চেহারা দেখতে দেখতে চোখের মণি কর কর করে ওঠে। কোথাও ছায়া নেই। শুধু একটি মাত্র সূর্য মাথার তালু সোজা গনগন করছে।’ (পৃ:১০)
এ রকম বর্ণনা আরো আছে। উপন্যাসের প্রায় সকল পৃষ্ঠাতেই রয়েছে খরার ছোবলে মৃত্যু-আক্রান্ত প্রকৃতির ছবি। তবে শুধু খরা আক্রান্ত প্রকৃতির ছবি নিয়েই লেখা নয় ‘খরাদাহ’ উপন্যাসটি। প্রাকৃতিক শুষ্কতা, রুক্ষতা ছাপ ফেলে মানুষের দেহে মনে মূল্যবোধে। সে সবেরও উজ্জ্বল বর্ণনা আছে উপন্যাসে। আর আছে সমাজ ভাঙা-গড়ার নিয়ত দ্বান্দ্বিকতা।
আমাদের আধা পুঁজিবাদী আধা সামন্তবাদী সমাজকাঠামোয় যেমন রয়ে গেছে জোতদারি, বর্গাদারি প্রথার মতো সামন্ত সমাজের অবশেষসমূহ, তেমনি এ দেশের পুঁজিবাদও বিকলাঙ্গ ও পঙ্গু; সুষ্ঠু ধারায় বিকাশমান নয়। সেই বিকাশ সম্ভবও নয়। আর এই দুয়ের মাঝামাঝি রয়েছে শোষিত বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির মানুষ। যারা নিষ্পেষণের শিকার হয় দুপক্ষ থেকেই। ‘খরাদাহে’ রয়েছে ক্ষীয়মান সামন্তবাদী সমাজের প্রতিনিধি মসিদ খাঁ। তেমনি রয়েছে বিকৃত পুঁজিবাদের প্রতিনিধি বাহা উদ্দিন বেপারী।
সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের চোখে তারা কেমন! ঘটক নাটু মিয়ার মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেন মসিদ খাঁর পরিচিতি—‘নাটু মিয়া ডাইনে বাঁয়ে সামনে আদিগন্ত মুলুকে হাত ঘুরিয়ে দ্যাখ্যায় সব স-ব মসিদ খাঁর পরগণা। এক মৌজায় এক দাগে যে যেখানে আছে স-ব তার প্রজা। কনের বাপও বটে।’
মসিদ খাঁর এই ‘মহাপরগণা’র সীমানাচিহ্ন কোথায় কোন কোন দেশের পাশ ঘেঁষে নাটু মিয়ার কোনো বোধ বা হদিস নেই। অতি আন্তরিক ভক্তি ও মুগ্ধতা নিয়ে সে তার যৎসামান্য ডান হাত পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি ঘুরিয়ে এনে একটা প্রকাণ্ড যোগফলে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে।
আর বাহাউদ্দিন। তার নিজেরই ভাষায় সে চামড়ার বেপারী। টাকা দিয়ে ইজ্জত কেনে। তার বাড়তি পরিচয় পাওয়া যায় দলিলের কথায়। যে দলিল বাহাউদ্দিনের হাতের পুতুল। প্রতিবছর দলিলকে বিয়ে দেয় বাহাউদ্দিন বিভিন্ন গ্রামে। আর মেয়েগুলোকে বৌ সাজিয়ে নিয়ে এসে তোলে গঞ্জে তার মালিকানায় পরিচালিত পতিতালয়ে। দেহ ব্যবসায়ে বাধ্য করে তাদের। এককথায় বিকৃত পুঁজিবাদের সার্থক প্রতিনিধি বাহাউদ্দিন।
বাকি যেসব চরিত্র আছে ‘খরাদাহে’ তারা সবাই হয় মসিদ খাঁ নয়তো বাহাউদ্দিনের শিকার। কিসমত, চিকন দাসী, তরু দাসী, দলিল, শীতল নবী, ভললা, রচা, সুবিদালী সবাই। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাহাউদ্দিনের টোপ, কেউ কেউ মসিদ খাঁর লেঠেল, জল্লাদ, ধর্ষক, শ্রমিক, বর, প্রজা। তারা সবাই জীবনবন্দি দাস। যাদের বাড়ির স্মৃতি মৃত। সুখের ধারণা অবাস্তব। যাদের বারুদের সলতে থুতু দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। দপ করে জ্বলে উঠতে দেওয়া হয় না। আবুবকর সিদ্দিকের ভাষায়—‘দুঃশাসন চালানোর জন্যে হাতে সব রকমের যন্তর মজুদ থাকে। জল্লাদ ধর্ষক, লেঠেল, হাফেজ সাহেব, যুবতী দাসী, কাঁচা টাকা।’
তবুও প্রতিবাদ আসে প্রতিরোধ আসে, আসে বিদ্রোহ। মসিদ খাঁর লেঠেল সর্দার ভললা, যে নিজেও মসিদ খাঁর দ্বারা সর্বস্বান্ত, চিকন দাসীর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে সে বিদ্রোহী হয়। তার সঙ্গে হাত মিলায় মসিদ খাঁর লেঠেল বাহিনী। বাড়িভর্তি দাস-দাসী। কারণ তারাও তো নিগৃহীত লাঞ্ছিত।
৩.
বেমানান ঠেকেছে মসিদ খাঁর অত তাড়াতাড়ি হার মেনে নেবার দৃশ্য। ভললার দল বিদ্রোহ করেছে, এগিয়ে আসছে—এ কথা শোনার পরেই হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মহত্যা করতে ছুটেছে মসিদ খাঁ। যেন সে এতদিন অপেক্ষা করছিল এই খবরটুকুর জন্যেই। অথচ তা তো নয়। লেখক আগাগোড়ো মসিদ খাঁকে যেভাবে চিত্রিত করে এসেছেন তাতে তার কাছ থেকে এতো সহজে পরাজয় বরণ আশা করা যায়নি। যদিও এখন সামন্তবাদ পৃথিবী থেকে (আমাদের দেশ থেকেও) প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু উপন্যাসের শুরু থেকেই মসিদ খাঁ চিত্রিত হয়েছে মহাপ্রতাপশালী হিসেবে। যার উন্নতি হচ্ছে শনৈঃশনৈঃ। তার এই প্রতিরোধহীন পরাজয় বরণকে ঐতিহাসিক বাস্তুবাদের অতি সরলীকরণ বলে মনে হয়েছে।
অতি নাটকীয়তাও রয়েছে উপন্যাসে। মেয়ের বিয়ের যৌতুক হিসেবে তিন হাজার টাকার জন্য কিসমত ভিটে বিক্রি করেছে মসিদ খাঁকে। ভোরে এসে গোমস্তারা দখল করবে কিসমতের ভিটে মাটি। রাতের শেষ প্রহরে বিদায় নিয়েছে বর-কনে-বরযাত্রীর দল। খেতে বসেছে কিসমত। ভাতের থালা এগিয়ে দিয়েছে স্ত্রী তরু দাসী। কিসমত ভাতে হাত দেবার বদলে জেগে জেগে সুখস্বপ্ন(!) দেখল কিছুক্ষণ তারপরে যেই হাত বাড়াল থালার দিকে তখনি হাজির হলো গোমস্তা-লেঠেলের দল। খাওয়া হলো না কিসমতের। থালার বারো ইঞ্চি উপরেই থেমে গেল তার হাত। কিসমতের নিঃস্বতা, ভাগ্যহীনতা বোঝানোর জন্যে পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণের জন্যে এখানে নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন আবুবকর সিদ্দিক।
৪.
শিল্পী-সাহিত্যিকরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। আবুবকর সিদ্দিক এ উপন্যাসে ভবিষ্যৎকে ধারণ করেছেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোকে। সামন্তবাদ-পুঁজিবাদের জোয়াল ভেঙে আসে মুক্তি। তার জন্য আত্মাহুতি দিতে হয়ে হাজার ভললাকে। কিন্তু মুক্তি নিশ্চিত হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। এটাই বিপ্লবীর সান্ত্বনা। ভললার জবানীতে আবুবকর সিদ্দিক বলেন—‘দুঃখটা কী বা ই মরণট্যাতে। হামরা তো জিত্যাই গেলচি!’
‘খরাদাহ’ এমন একটি উপন্যাস যা সম্পূর্ণ নতুন এক বাংলাদেশকে চিনিয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সজল কোমল ভূপ্রকৃতি সম্বন্ধে যে একটা প্রচলিত ধারণা আছে, উত্তরবঙ্গের ভূমিচিত্রের সঙ্গে তার আদৌ মিল নাই। কেন যেন মনে হয়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটুকরো কঠিন রাঢ় মৃত্তিকা এই বাংলাদেশের উত্তর এলাকায় ‘বরীন’ নামের ব্যতিক্রমী চেহারা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পাথুরে লাল মাটি, লু হাওয়ার হলকা, দয়ামায়াহীন খরা, পোড়াকালো নরনারী, তাদের গনগনে মেজাজ—এইসব মিলিয়ে অমানবিক শোষণ আর লড়াইয়ের এক ভয়াবহ ছবি আমূল উঠে এসেছে আবুবকর সিদ্দিকের কলমে।
এই উপন্যাসে এসেছে তেভাগা আন্দোলনের কথা। অমন আগুনঝরা রক্তঝরা আন্দোলনের কথা এই বরেন্দ্রভূমির অভাবী কৃষক-ক্ষেতমজুর কখনো ভুলবে না। তাদের দুঃখে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল আত্মনিবেদিত শ্রেণীচ্যূত সোনার মতো মানুষরা। তাদের একজোট হতে শিখিয়েছিল। বাঁচার জন্যে লড়তে শিখিয়েছিল। এই পথেই হয়তো এগিয়ে আসবে আরো মানুষ। হয়তো এভাবেই একদিন আসবে মুক্তি। এই প্রত্যয় কলমে ধারণ করে আবুবকর সিদ্দিকের আর্তি—‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।’