ঈদ আনন্দ
একগুচ্ছ কবিতা
সাখাওয়াত টিপুর কবিতা
গোলাব সোন্দরী
গোলাব দেখিতে দেখিতে কাঁটার কথাই আসে
তবুও মানুষ তাহা ফুটাইতে ভালোবাসে
কাঁটা মানে রোম, ট্রয়ের গভীরে, ভাসে
গোলাব রঙের রক্ত, তোমার এই যে ভাব
রক টান টান রক্ত রঙের গোলাব।
কতদিন গোলাব গাছে পাঁপড়ি ঝরিতে ঝরিতে
দুই হাতে ধরাধরি করিতে করিতে
বুঝিয়াছে যদ্দুর মানুষ
সব তম তমা নয়
সব তমা প্রিয় নয়
আকার তমার ভ্রম
কাঁটা হইতে গোলাব অধিক অধিক উত্তম
দুনিয়ার আয়ু প্রেমের চাহিতে একফোঁটা কম।।
মাজুল হাসানের কবিতা
পত্ররোমন্থন
১.
হাইওয়ের পানে এগুতে এগুতে বৃষ্টিবৃষ্টি ঝিলিক, প্রিয় ভ্রম
আমরা ঢুকে পড়লাম একটা শুষ্ক লেকের মর্ম অভ্যন্তরে
উবে গেছে কান্না, তবু তাদের তরে কেঁদে চলেছেন আদম
মানুষ এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি? কোনো গূঢ় রহস্য?
হয়তো ১০টা বিশ্বযুদ্ধ অথবা কোনো এক সূক্ষ মেলাঙ্কলি!
আচানক গান, আসো এবং আমাতে আঁকো অগ্নি-উল্কি
আমাকে দেখাও একটা সিক্ত অথচ খালি-চিবুকের ঝলকানি
আমি অন্ধ
জ্বলন্ত চিকচিকে চিবুকে অন্ধরাই সবচাইতে ভালো নাবিক
২.
মেঘ থেকে কথা পেড়ে আনার বিদ্যা রপ্ত হবে একদিন।
তুলে নাও বজ্রশাসন। আমার চুলে কিন্নর-বিদ্যুৎ খেলে
নাভিতে ঘোলাজল। নারনী—আমার গাধারা পাতা থেকে
নিবিড়তা চেটে খায়; জ্যোছনায় ওদের ঘোড়া বলে
ভ্রম হবে না কখনও। এমনই সৎ
ফুরিয়ে যায় প্রতিধ্বনিময় চরকা কাটা দিন
নারনী—আসছে বর্ষায় তদ্ধিত-মেঘ আনবো নিশ্চিত
সাথে গর্ধপের গল্পবিভ্রাট; সিন্দুরী শব্দকোষ...
৩.
সম্পর্কের ভেতর হে ঝুম-মুকুল আমগাছ
তোমা' ওপর লাফিয়ে পড়ে বিকটাকাশ
অদ্য গ্রীষ্ম—আমাকে জাগিয়ে রেখেছে
অনাগত আম-কাঠালের গন্ধ৷ শুয়েবসে
জানালা দিয়ে ইটের গাছ, প্রস্তর, নামফলক
নৃ—কখনো মুখ দেখিনি আমি, কেবল চোখ
স্কুলঘর মতো বিষণ্ণ,রোমশ গুড়োগুড়ো চক
ধোঁয়া—হে টলটলে স্মৃতি; পত্ররোমন্থন...
৪.
ধাতবের ক্লান্তি আমি জানি, তারও বেশি
অন্ধ গর্জন। মাঝ পথে স্থগিত চুম্বন—শুরু
হোক ভিন্নতর বিকালভ্রমণ। মুখস্ত পাখি
থেকে খসে পড়ুক উড্ডয়ন। কাব্যগোঁয়াড়
শতছিদ্র জালে আকাশ ধরো তবু। আরো
১টা হংসমিথুন, ছিল অনুগত কাঠগোলাপ
তোমাকেই ভাবি—ফুঁ; হে বিকল প্রপেলার...
অঞ্জন আচার্যের কবিতা
অসম্পূর্ণ অধ্যায়
কখনো এমনও হয়
ছুটির দিন ভেবে বসে থাকি একা
অথচ ঘরে থাকার দিন নয় মোটেও;
জমে থাকে কাজ— মাটির ব্যাংকে রাখা আধুলির মতো।
এমনও কখনো হয়
কাজের দিন ভেবে ছুটে ছুটে যাই
অথচ পথগুলো ভাতঘুমে কাতর— পড়ে থাকে ফাঁকা;
তবুও জমে থাকে কাজ
যেভাবে জমে থাকে ঘুম— বিনিদ্র বিছানায় বালিশের মতো।
জলরঙা শৈশব
আমি তো কেবল আঁকতে চেয়েছিলাম এক জলরঙা ছবি
পাশ দিয়ে বয়ে যাবে নদী— এমনটা নয়; শুষ্কও হতে পারে।
উত্তাল হতে পারে ভরা বর্ষায়। দুপাড়ে কাশফুল, স্নিগ্ধ শরতে।
মাঠের এক কোণে মাটির বাড়ি, পাশে তার বিস্তৃত বটগাছ।
নীলাকাশে উড়ন্ত মেঘদল। পাশাপাশি এক ঝাঁক কালোরঙা পাখি।
পাহাড়ের পদতলে এমন নিপাট গ্রামের ছবিই আঁকতে চেয়েছিলাম—
সেই কবে থেকে; সময় মেলেনি।
তার বদলে চেয়েছিলাম নিতে, আমার দারিদ্র্যক্লিষ্ট অনাহারী জলরঙা শৈশব।
সৈকত ঘোষের কবিতা
নির্জনতার স্ক্রিনসেভার
১
তোমাকে ছুঁতে চাওয়া মাত্র মুষল বৃষ্টি
সেদিন থেকে খেলনাবাটির পৃথিবীতে আমি বৃষ্টির নাম রেখেছিলাম তুমি
এরপর গল্পটা শুরু হতে পারত
মোটিভেশন ক্লাসের মাঝে অবাধ্য ফেসবুক
ইদানীং বৃষ্টিকে লাঞ্চবক্সে প্যাক করতে বসে ভাবি
কতটা সাবলীল হলে ভালোবাসা ছিঁড়ে খাওয়া যায়
যদি তুমি গাছ পাখি নিদেনপক্ষে
গাঢ় অন্ধকারে পা-ডুবিয়ে একা নদী হতে
লিখতে পারিনি, লেখার আগেই মুহূর্তগুলো ছিনিয়ে নিয়েছে বিজ্ঞাপন
নিরাপত্তা জনিত কারণে
আমি একা, আরো একা হতে হতে
একটা করপোরেট সন্ধ্যে লিখে ফেললাম
২
কিছু আবদার অক্ষর হয়ে যাক
ছুঁয়ে থাকা নিঃসঙ্গতা, কাছাকাছি
আদর বড় ছোঁয়াচে প্রাপ্তিযোগ
ছড়িয়ে পড়ে নখ থেকে ঠোঁটে
তোমাকে ছায়ায় মিশিয়ে নিই
এ বড় সুগন্ধী সিনড্রোম
চেনা দৃশ্যেরা উৎসব নিয়ে আসে
পাতার ভাঁজে লুকানো প্রতিশ্রুতি
এভাবেই ক্যালেন্ডারে আরো একটা দিন
চশমায় ছেঁড়া মনখারাপের মেঘ
হাজার মানুষের ভিড়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বেওয়াফাই
এসো, অন্ধকারকে সেলিব্রেট করি আজ
৩
আমি কারো দিকে তাকাচ্ছিলাম না। আসলে আমি
সবাইকে দেখছিলাম। কথার শরীর থেকে বিন্দু বিন্দু বাষ্প
তোমার লীনতাপ একটা কাগজের ফুল দিয়ে গেল
ধরে নিলাম তুমি অন্ধকার। আমি পিচ্ছিল হতে চেয়ে
এইমাত্র তোমার সিপ নিয়েছি। উড়ে আসে আবেগের পালক
ভয়। অভিমান। শূন্যতা
তোমার ননস্টিক আঙুল সংসার শুষে নিচ্ছে
আমি ঘুমের মধ্যে তোমাকে ছুঁয়ে দেখেছি
আকোরিয়াম। ঝুল বারান্দা। পিঙ্ক ফ্লয়েড
চাবি ঘোরাতেই স্বপ্নের প্রতিটা বাঁক বিছানায় উঠে আসে
স্টপেজ মিস করা গল্পেরা এভাবেই রোজ
৪
একটা দিন অসম্পূর্ণ থেকে যায় যতক্ষণ না একটা রাত
তোমাকে শরীরে ভরে নিচ্ছে। কিছু বলার আগেই তুমি
ফুলের মতো জেগে ওঠো
আমি একটা অসম্ভবকে স্বাভাবিক রাংতায় মুড়িয়ে দিলাম,
কথার শরীর থেকে উঠে আসেন মেহেদি হাসান।
গল্পটা একটা পাহাড় আর একটা নদীকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল।
মাঝরাতে কোনো এক ম্যাজিকে দুজনেই অনুরক্ত হলো সমুদ্রের।
একটা ছায়াঘেরা রেলিং, একটা বৃষ্টি ভেজা চিঠি,
সমস্ত আত্মহত্যার ইচ্ছে আর একবার শেষ ট্রেন মিস করবে
বাইশ ক্যারেট মুগ্ধতা নিয়ে সময় থেমে যাক,
কথার ঠোঁটে হাইভোল্টেজ চুমু
৫
প্রত্যেক মেয়ের মধ্যেই একটা এফ-এম স্টেশন থাকে
ঝুল বারান্দা থেকে ট্যাটুর মতো উকিঁ মারে জেব্রাক্রসিং
নীল অর্কিড আসলে শূন্যতার মায়াবী কোড
একটা আধখাওয়া আপেল
শরীরের প্রিমিয়ারে বোতাম লুকায়
স্থানিক এবার অস্থানিক হবে
রিসাইকেলবিন থেকে তুলে আনলাম অপরাজিতার গল্প
ইদানীং প্রতিটা হোঁচট খাওয়ার মধ্যে সন্দেহ ঢুকে যাচ্ছে
চুপিচুপি, চুপি এবং চুপি লাট খেতে খেতে
মুহূর্ত ছিটকে পড়ে ট্রাপিজের খেলায়
কমা দাড়ি ফুলস্টপ, আপাতত বিস্ময় একটা বালিশ রচনা করেছে
৬
একটা স্বপ্ন রঙের ভোর
ইতিহাস লিখে যাওয়ার আগে তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবে
স্ক্রিনসেভার জুড়ে সেই চেনা মুখ
বিকেলের কফিশপে আরও একবার
আনমনে বেজে ওঠে ই-মাইনর
যেভাবে সময় সময়ের কথা লিখে রাখে
ছুঁয়ে থাকে শব্দের ঘোর
আরো একবার কৈশোরে ফিরে যাবো আমরা
তোমার পুরোনো পাড়ায় ইচ্ছেরা কালপুরুষ
এভাবেই কুড়িটা বছর,
আমার শহর জানে কতটা ভালোবাসলে
এতগুলো বছর একসঙ্গে ঘর করা যায়...
সঞ্চারী গোস্বামীর কবিতা
চিঠি
খামের মুখ জোর ক’রে বন্ধ করে দেওয়া ছিল
খামের উপরের ঠিকানা মুছে দেওয়া ছিল!
গঙ্গার হাওয়ায় বসন্তের পাগলামি মিশে গেছে যখন
এ চিঠির জন্ম যেন তখনি।
ডাকবাক্সে কেউ ফেলেনি— ঠিকানা নেই যে!
তবু আশ্চর্য সব গল্প বলেছিল সে চিঠি—
কত মানুষের হারিয়ে যাওয়ার গল্প
কত পুনর্বাসনের গল্প— যেগুলো হয়নি কোনোকালেই।
এছাড়াও ছিল—
রাজা কেমন ক’রে সুস্বাদু মাংস খায়
আর কি আশ্চর্য উপায়ে
সেসব ফেলে রাখা হাড়-ছিবড়ে
হয়ে যায় মসলিন রুমালে ঢাকা দেওয়া গোলা পায়রা—
সেসব কথামালাও ছিল সে চিঠিতে।
এ চিঠি জন্ম-জন্মান্তরে উড়ে যায় কেবলই
এ ভাষার মাথামুণ্ডু আমিই কি জানি!
যতি
মাটির ওপর খাড়া হয়ে আছে মহীরুহ।
শিকড়ের গায়ে জমে আছে মাটি—
আর সেই মাটির গভীর থেকে
আকাশের দিকে উঠে আসছে বর্ণপরিচয়ের সকাল।
যত আলো ফুটবে
সে অক্ষর জুড়ে জুড়ে শব্দ হবে,
আর ক্রমশ তারা জুড়ে বসবে ডালপালাদের কোল।
গভীর দিনে সে শব্দেরা কথা হয়ে যাবে;
যত কথা— তত রঙ—
যত কথা—
তত গর্ভকেশরের বুকে দুলে উঠবে বীজের স্বপ্ন—
বড় আদিম, বড় স্বাভাবিক স্বপ্নের গান।
তখনই ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকবে কোনো বিকেল।
আমি হাতড়াতে থাকব—
প্রাণপণে খুঁজতে থাকব—
সমস্ত যতিচিহ্নকে।
কেবল সন্ধ্যে নেমে গেলে
সে গাছের ডালে বাসার মধ্যে যখন এসে বসবে কোনো সম্পর্ক
আমি আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকব
এর পাশে বসানোর মতো কোনো যতিচিহ্ন খুঁজে পাইনি আমি।
তন্ময় মণ্ডলের কবিতা
বস্তু ও বাস্তব
চোখ বন্ধ করেও অনেক কিছু দেখা যায়।
ক্লান্ত শহরের শরীর থেকে
দু-চার ফোঁটা অন্ধকার তুলে নাও।
একটা টেস্টটিউবে রাখো।
এরপর বেখেয়ালে মিশিয়ে দাও স্মৃতির বুদবুদ
হলফ করে বলতে পারি
প্রিয়জন বলে যে অনাকাঙ্ক্ষিত গণ্ডিকে চিনেছ এতকাল
দেখবে তার বেশিরভাগই ধূসর চরিত্র পোড়া ছাই।
তবু, মানুষকে যদি বস্তু ভাব
তবে জীবন এক কাকতলীয় নীরবতা।
অপ্রাপ্তি
কোলাপসেবল গেটের মতো আমার দ্বিখণ্ডিত মনকে
দু’দিক থেকে টানছে এক অদৃশ্য শক্তি
কষ্ট কীভাবে দুঃখ হয়ে ওঠে তা আমার জানা নেই...
তবে যখন মডার্ন বাসস্টপে কোনো ওড়না পরা যুবতীর মুখের আদল
বড্ড চেনা লাগে,
কেন যেন মনে হয়,
হেরে যাওয়া আর হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যেমন বিস্তর ফারাক,
ঠিক তেমনি ছোঁয়া আর ছুঁয়ে থাকার মধ্যেও।
বছর দিয়ে আমি কখনও স্মৃতির বয়স মাপিনি অবন্তিকা,
যতবার স্মৃতিরা পলি হয়ে মিশে যেতে চায়
চোখের অতল গহ্বরে- মহানন্দায় ;
ততবার আমি
ছোঁয়াকে ছুঁয়ে থাকা ভাবি
আর আমার নির্বাসিত দৃষ্টি এক অমোঘ প্রাপ্তি নিয়ে চেয়ে থাকে
অপ্রাপ্তির দিকে...