গল্প
যে গল্পের শেষ নেই
মগবাজারের ষষ্ঠ তলার বাসায় ঘটিবাটি, মালপত্র স্তূপ দিয়ে দম নিয়ে বসল তুলি। দুই রিকশা ভ্যান আসবাব তুলতে কতবার যে ছয় তলা পর্যন্ত সিঁড়ি ভাঙতে হলো, তার ইয়ত্তা নেই। হাঁটু জোড়া বেশ ধরে এসেছে। বুকের ভেতরটা শুকিয়ে মরুভূমি। জল নেই। আনা হয়নি। লেপ-তোশকের স্তূপের ওপর হেলান দিয়ে দম নিচ্ছে সুমনা। তুলির একমাত্র মেয়ে। চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরোতে পড়েছে। দশম শ্রেণিতে পড়ছে। হলিক্রসে।
সেই শৈশব থেকেই মেয়ে সুমনাকে নিয়ে মিরপুরে বাবার বাসাতেই থাকত তুলি। এখনো ভালোই চলে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে গরমিল যে হয়নি, তা নয়। ভাইয়ের সংসার, সাথে মা-বাবা আর অনিয়মিত আত্মীয়স্বজন। ঝুট-ঝামেলা তো হবেই।
দুটি পা-ই আর চলতে চাইছে না তুলির। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। জল চাই তো সিঁড়ি ভেঙে ছ’তলা থেকে নিচে নামতেই হবে। নতুন বাসায় উঠতে না উঠতেই পাশের বাসা থেকে জল চেয়ে নেওয়া বড় অশোভন মনে হলো তুলির। তারপরও সুমনাকে ছিটকিনি লাগাতে বলে নিচের দিকে পা বাড়াল। যাওয়ার কালে সুমনা মনে করিয়ে দিল দিয়াশলাইটা আনতে। না হয় চুলা জ্বালানো যাবে না। রাতের খাবারের জন্য আবার ছ’তলা থেকে নিচে নামতে হবে।
দেড় রুমের বাসা। থাকার ঘর একটি। বাকি অর্ধেক ঘরে ড্রইং-ডাইনিং, এক পাশে রান্নার একটি চুলো, হাঁড়ি-পাতিল ধোঁয়ার বেসিন সবই আছে। থাকার ঘরটির পাশেই ছোট্ট শৌচাগার। পুরোনো মোজাইকের মেঝে। দেয়ালের বাদামি রঙের পলেস্তারা উঠে খণ্ড খণ্ড নক্শা হয়ে পড়ছে। ঘরের ভেতরেরও একই অবস্থা। সুমনা ভাবল, মা ফেরার আগেই ফ্রেশ হয়ে নেবে। পরনের জুতো নিয়েই ঢুকল। আলাদা চপ্পল এখনো দেওয়া হয়নি। চারদিকে ময়লা। দুর্গন্ধ। দুটি আরশোলাও ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করছে।
বেরুল সুমনা। পুনরায় লেপ-তোশকের স্তূপের ওপর গিয়ে সবল। দেড় কক্ষের বাসা হলেও একটি আলাদা জায়গা। একা। ভয় করছে সুমনার। কিসের ভয়, কেন ভয়, তার কিছুই বুঝতে না পারলেও অজানা একটা ভয় সুমনার মনে কাজ করছে। নিজেকে বেশ দোষী মনে হচ্ছে। তার কারণেই মাকে আজ বাসা পাল্টাতে হলো। পরক্ষণেই নিজের ওপর আরোপিত দোষ উঠিয়ে নেয় সুমনা। দোষ! আমি কেন দোষী হতে যাব! অপরাধী তো ঐ... ভাবতে গিয়েই দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পায়। মা ফিরেছে। সুমনা উঠে গিয়ে ছিটকিনি খুলে দেয়। তুলি জলের কনটেইনারের সঙ্গে বেশ কিছু সদাই-পাতি নিয়ে ফিরে। জিনিসগুলো রেখেই ধপাস করে বসে পড়ে।
‘ওরে মা রে। ছয় তলা। উঠতে উঠতে জান শেষ। পায়ের নলার মগজ শুকাইয়া যাইব। অ সুমু যা তো মা কনটেইনার থেকে মগে একটু জল ঢেলে দে। জানটা বাইর হইয়া গেল’— জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে কথাগুলো বলে থামল তুলি। সুমনাকে আদর করে সুমু বলেই ডাকে মা তুলি।
সুমনা মগে জল এনে দেয়। ঢক ঢক করে সাবাড় করে তুলি। হাত-পা ছেড়ে বসে থাকে। কিছুটা সময় গড়িয়ে যায়। অতঃপর নীরবতা ভাঙে সুমনা। ওমা ঘর গোছাবা না?
হ্যাঁ রে। আয় তোশকটা বিছিয়ে দি। কাল তো শুক্রবার। আমার অফিস বন্ধ। গোছানোর বাকি কাজ কাল সকালে করব।
তুলি সুমনাকে নিয়ে তোশক বিছায়। উপরে পুরোনো আধোয়া বিছানা চাদরও সেটে দেয়। তারপর দেয়ালের সাথে বালিশ ঠেস দিয়ে শোয়। ও সুমু পলিথিনে পাউরুটি, কলা, কেক, জুস সবই আছে। তোর যা ইচ্ছে খেয়ে নিস। আজ আর চুলা জ্বালাতে পারব না।
আচ্ছা মা।
সুমনা সামনের ঘরে যায়। মায়ের অসহায়ত্ব দেখে স্থবির হয়ে পড়ে। নিজেও অসহায় বোধ করে। কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবে কী তার করা উচিত। কিছুই ভেবে পায় না।
তুলি দু চোখ বন্ধ করে। চাইছে গভীর ঘুম আসুক। চাইলেই কি ঘুম আসে? জীবনের বোঝাপড়ায় যে দখল গেল, শুধু গেল না যাচ্ছে এবং বাকি জীবন আরো কত যাবে সে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। জীবন মানে সংগ্রাম—এই প্রবাদবাক্যটি শুধু পুরুষের জন্যই প্রযোজ্য আর নারীর জীবন মানে ‘অতি সংগ্রাম’ আর ‘অনিশ্চয়তা’—এ রকম ভাবনাই মনে আসে তুলির।
একমাত্র কন্যা সুমনার বয়সে নিজেকে দাঁড় করায় তুলি। কত আর বয়েস। পনেরো হবে। সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। তুলির বাবা শফিক সাহেব মেয়ের বিশেষ যত্নের জন্য গৃহশিক্ষক রাখলেন। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট চাই। সপ্তাহে তিন দিন পড়ানোর চুক্তিতে আসতে লাগলেন তুলির বিদ্যালয়েরই শিক্ষক কবির আহমেদ। বিদ্যালয়ে তিনি কবির স্যার নামেই বেশ পরিচিত।
তার পরের গল্প একেবারেই সাদামাটা। আর ১০টি গৃহশিক্ষক ও ছাত্রীর প্রেম রসায়নের যে গল্প তুলি ও কবির স্যারের গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। পরীক্ষার অজুহাতে সপ্তাহে তিন দিনের কথা থাকলেও পাঁচ দিন অথবা প্রতিদিন আসতে থাকলেন কবির। এর মধ্যে পালিয়ে ঘুরতে যাওয়া, লুকোচুরি, রেস্টুরেন্টে আলো-আঁধারির অবারিত সময় পার করাসহ সবই চলল।
ম্যাট্রিক ভালোই পাস করল তুলি। এবং একই সাথে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সমাজে মুখ বলে একটা কিছু আছে সেটা রাখার জন্যই শফিক সাহেব তুলি ও কবিরের বিয়ে দিলেন। ওদের ঘর-সংসার হলো। বছর খানেকের মধ্যেই কবিরের বিদ্যালয় পরিবর্তন হলো। তুলি কলেজে পড়াশোনা শুরু করল। আর বছর ঘুরতে কোলজুড়ে এলো সুমনা। দু’পরিবারে বোঝাপড়াটা বেশ ভালো। শফিক সাহেব প্রায় ভালো বাজার-সদাই নিয়ে মেয়ে-নাতনিকে দেখতে আসেন। তুলির মা এসে ক’দিন বেড়িয়ে যান। ভাই-ভাবিও আসেন।
সবকিছুই যখন স্বাভাবিক চলছে, তখনই তুলি টের পায় কিছু একটা। নিশ্চিত হতে পারে না। হঠাৎ মুঠোফোনের একটি মুঠোফোন বার্তাতে চমকে ওঠে তুলি। দু পাটি দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে পড়ে নেয়। কবির ওয়াশরুমেই ছিল। পরপর অনেকগুলো মুঠোফোন বার্তা পড়ে নিশ্চিত হয় তুলি। ঈশানা নামের ছাত্রীটির সাথে কবিরের প্রেম, না প্রেম নয় বরং পরকীয়া তুঙ্গে। তুলি জানত—ঈশানা নামের একটি মেয়েকে কবির পড়াতে যায়।
তারপর স্বাভাবিক যা হয় তাই হলো। ঝগড়া, অসহযোগিতা, কথা বন্ধ এবং শেষ সমাধান বিচ্ছেদ। তুলি আর কবিরের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। তুলি-সুমনাকে নিয়ে বাবার বাসায় উঠল। পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের অসহনীয় কথা সয়ে খড়কুটো কামড়ে পড়ে থাকল। নিজে টিউশন করে পড়াশোনা চালিয়ে গেল। সরকারি অফিসের সহকারী হিসাবরক্ষকের চাকরিও জুটিয়ে নিল। সুমনাকে স্কুলে দিল। বাবার পরিবারে আর্থিক অংশগ্রহণও নিয়মিত করল।
তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে খটমট লেগেই থাকল। বাবা শফিক সাহেব অনেকবার চেয়েছে তুলি আবার বিয়ে করুক। অন্য একটা বাসা নিক। আলাদা থাকুক। তাহলে ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে সমস্যা হবে না। তুলি কোনোভাবেই বিয়েতে মত দিল না। কষ্ট হলেও তুলির মা চায় তুলি মেয়েকে নিয়ে এই বাসাতেই থাকুক। কিন্তু বাবা চায় না। যেখানে ছেলের বউ আর মেয়ে একে অপরের মুখ দেখতে ঘৃণা করে সেখানে একসাথে থাকার দরকার নেই।
নিজের চাকরি আর মেয়ের স্কুলের কথা ভেবেই আলাদা বাসা নিতে অনীহা দেখিয়ে আসছিল তুলি। কিন্তু ভাই-ভাবির ষড়যন্ত্রে সেই অনীহা ধোপে টিকল না। কী এমন ঘটল, যে তুলি মেয়ে সুমনাকে নিয়ে আলাদা বাসা নিতে বাধ্য হলো! সে ঘটনা কি এ সমাজের মানুষ বিশ্বাস করবে? ঘটনা যা ঘটল তার পুরোপুরি জানতে পারল না তুলি। বেশ কিছুদিন ধরে সুমনাকে অসুস্থ দেখছিল। সাধারণ কোনো শরীর খারাপ করলেই তুলি মহল্লার দোকান থেকে ওষুধ আনিয়ে সারিয়ে নেয়। মায়ের দেখাদেখি সুমনাও তাই করে। কয়েকবার ওষুধ আনিয়ে খেল। কিন্তু অসুখ সারল না। তুলি সুমনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। আর ডাক্তারের কথা শুনেই আকাশ থেকে পড়ল! কী! সুমনা প্রেগন্যান্ট!
ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ। প্রায় তিন মাস হতে চলল। ভূত দেখার মতো চমকে সুমনার দিকে তাকিয়ে থাকল তুলি। ডাক্তারের পাঠ চুকে বাসায় ফিরল। পথে কোনো কথা হলো না।
রাতের খাবার মুখে উঠল না তুলির। বাসায় মা-বাবা, ভাই-ভাবি কাউকেই কিছু বলল না। সুমনা খেয়ে-দেয়ে বিছানায় গেলে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে বসল।
তুই কি কারো সাথে প্রেম করছিস?
না। সুমনা মাথা নিচু করে জল ছলছল চোখে বলল।
তাহলে?
সুমনা চুপ করে থাকল।
চুপ করে থাকিস না। বল। না হয় এখন তোকে গলা টিপে মেরে ফেলব। তোর মতো এ রকম মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। তোর জন্যই এত বঞ্চনা-গঞ্জনা সহ্য করে আমি এ বাড়িতে পড়ে আছি। তোর বাবাকেও ছেড়ে এসেছি। ইচ্ছে করলে আবারও বিয়ে করতে পারতাম। করিনি। আর তুই! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তুলি। সুমনা কান্না করে মাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। তুলি ধরতে দেয় না।
আগে বল কার সাথে কী করেছিস? আমি এখন মা-বাবাকে এ মুখ দেখাব কী করে। তোকে অবলম্বন করেই বাঁচতে চেয়েছিলাম!
এখন!
মা। শোন!
তিন মাস আগে তুমি এক সপ্তাহের জন্য অফিসের ট্রেনিংয়ে মালয়েশিয়া গিয়েছিলে।
হ্যাঁ।
তুমি যে দিন গিয়েছিলে, সে দিন রাতে খাবার পর মামা আমাকে একটা জুস দেয়। মামিকেও দেয়। দুজনেই আমার সাথে বেশ গল্প করে। মনেই হয়নি ওদের সাথে আমাদের শত্রুতা। জুসটা খাওয়ার পর আমার বেশ ঘুম পায়। মামা বলেছিল, যা ঘুমোতে যা। তুই তো অনেক সময় রাতে ঘুমে ভয় পাস। তাই মামি তোর সাথে শুবে। আমিও রাজি হয়ে যাই। মামি আমার সাথে বিছানায় যায়। গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, আমি টের পাইনি। তবে মাঝরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন দেখি আমি মামার বুকে শুয়ে আছি। মামা জোরে জোরে শ্বাস ফেলে ঘুমোচ্ছে। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিই। পরপর তিন দিন ওরা আমার সাথে এভাবে শোয়। একদিন রাতে আমি টের পেয়ে যাই।
মামা আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। তাই আমি কাউকেই কিছু জানাইনি।
রাতের অন্ধকার আরো ঘনীভূত হয়। যেন সারা পৃথিবী আঁধারে ঢেকে গেছে। কোথাও আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। তুলি বিছানায় জমে পাথর হয়ে আছে। ডাক্তার বলেছে, এখন আর অ্যাবরসান করারও সুযোগ নেই। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। তারপরও ঘেমে একাকার। আবার হঠাৎ করেই শরীর ঠান্ডা হয়ে লোম খাড়া হয়ে গেল তুলির। ভাবনার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কূল-কিনারা নেই। শুধু বাসা থেকে তাড়ানোর জন্যই নিজের ভাই তার এই সর্বনাশ করল! পৃথিবীতে এ রকম ঘটনা ইতোপূর্বে ঘটেছে কি না তুলির জানা নেই। হয়তো এটাই পৃথিবীতে প্রথম।
মুহূর্তেই তুলি সিদ্ধান্ত নেয় এই বাসায় আর নয়। বাসা ছেড়ে যাবে। তবে পনেরো বছরের অবুঝ মেয়ে সুমনার কী হবে! এ সর্বনাশের বিচার সে কোথায়, কার কাছে চাইবে? সুমনার অনাগত সন্তানের পিতা কে হবে? মামা! তুলি কি তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করবে? মামলা করলেই কি সুমনার পেটে বেড়ে ওঠা অবৈধ বাচ্চাটি খসে পড়ে যাবে? এতসব হাজারো প্রশ্নের কোনো উত্তর তুলির জানা নেই। শুধু প্রশ্নগুলোই সিলিং ফ্যানের সাথে ঘরঘর করে ঘুরছে আর ঘুরছে।