বইয়ের কথা
সামন্ত যুগে মানুষ ও কুকুরের ভালোবাসা
রুশ সাহিত্যের যে কয়েকজন মহান শিল্পীর নাম আমরা উচ্চারণ করি, তুর্গেনেভ তাঁদেরই একজন। তাঁর সাহিত্য আমাদের হৃদয়কে সিক্ত করে, সরস করে এবং ভাবতে শেখায়। ইভান তুর্গেনেভের ছোট অথচ অসাধারণ এক মানবিক উপন্যাস ‘মুমু’। শোনা যায়, তুর্গেনেভের এই গল্পটা নাকি তার নিষ্ঠুর জমিদার মাকে মাথায় রেখে লিখেছিলেন। বাংলাদেশে বইটি প্রকাশ করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গেরাসিম একজন বোবা-কালা, তবে প্রচণ্ড শক্তিশালী ও সহজ-সরল গ্রাম্য যুবক। তাকে মস্কো শহরে এনে এক নিষ্ঠুর জমিদারনীর বাড়িতে পাহারাদার বানানো হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় একসময় গেরাসিম ওই বাড়িতে ধোপানির কাজ করা তাতিয়ানার প্রেমে পড়ে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বাড়ির বাকি চাকররা ষড়যন্ত্র শুরু করে। এরপর নিষ্ঠুর জমিদারনীর আদেশে তাতিয়ানাকে বিয়ে দেওয়া হয় এক মাতাল ও অকর্মণ্য লোকের সঙ্গে। গেরাসিম কষ্ট পায়, কিন্তু কাউকে কিছু বলে না। একসময় তাতিয়ানা ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
তাতিয়ানা চলে যাওয়ার দিনই পানিতে প্রায় আধমরা একটা কুকুরের ছানা পায় গেরাসিম। আদর-যত্নে কুকুর ছানাটাকে সারিয়ে তুলে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করতে শুরু করে সে; নাম দেয় ‘মুমু’। মুমুও গেরাসিমের খুব ভক্ত হয়ে ওঠে। একদিন বাড়ির কর্ত্রীর চোখে কুকুরছানাটা পড়ে যায়। সামান্য ঘটনায় এই কুকুরকে বাড়ি থেকে তাড়াবার জন্য সে উঠেপড়ে লেগে যায়। গেরাসিমকে ফাঁকি দিয়ে মুমুকে বাজারে বেচে দেওয়া হয়। কিন্তু মুমু পালিয়ে আবার গেরাসিমের কাছেই ফিরে আসে।
গেরাসিম মুমুকে লুকিয়ে রাখে, যেন নির্দয় কর্ত্রী না দেখে। কিন্তু তবু একদিন মুমুর আওয়াজ কানে যায় তার। এবার আর রক্ষে হয় না। মুমুকে মেরে ফেলার নির্দেশ আসে। শেষ অবধি গেরাসিম নিজেই মুমুকে মারবে বলে কথা দেয়। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে গেরাসিম মুমুকে সেই নদীতে নিয়ে যায়, যেখানে সে মুমুকে পেয়েছিল। অগাধ বিশ্বাস নিয়ে মুমু গেরাসিমের কাছে হাতে-পায়ে পাথর ঝোলানো অবস্থায় নৌকায় বসে ছিল। মুমুকে যখন গেরাসিম পানিতে ফেলে দেয়, তখন মুমুর আর্তনাদ কালা গেরাসিমের কানে যায়নি। মুমুর মৃত্যুর চেয়েও মর্মান্তিক ব্যাপার হলো মুমুর আর্তনাদ গেরাসিমের শুনতে না পাওয়া। উপন্যাসের এ অংশটা সংবেদনশীল পাঠককে স্পর্শ করবেই।
এরপর গেরাসিম চলে যায় তার গ্রামে। আবার আগের মতো ক্ষেতে-খামারে কাজ শুরু করে। কিন্তু সে আর আগের মতো হাসে না, মেয়েদের সঙ্গে আর মেশে না। কোনোদিন কোনো কুকুরকে সে আর তার কাছে রাখেওনি। যেন সে বেঁচে থেকেও মরে গেছে, নিষ্প্রাণ এক মানুষ।
এই উপন্যাসটা পড়তে পড়তে আমার দুটো বিষয় মনে হয়েছে। এক, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেণিবিভক্ত সমাজের শোষণ-নিপীড়নের ভয়াবহতা। আর দুই, নিপীড়িত মানুষ কিছু না কিছুকে আশ্রয় করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখে। সেই আশ্রয় হতে পারে মানুষ, অথবা একটা অবলা প্রাণী, অথবা কোনো আদর্শ অথবা অন্যকিছু। কিন্তু সবই যদি তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে সেই মানুষ একটা জ্যান্ত লাশ হয়ে যাবে।
মানুষের ইতিহাসে একটা সময় ছিল যখন দাসপ্রথা ছিল। দাসদের প্রতি প্রচণ্ড অমানুষিক আচরণ করা হতো। গেরাসিমের মতো অসংখ্য দাসের জীবনে প্রেম-ভালোবাসা, মানবিক অধিকার–সবকিছুকে অস্বীকার করা হতো সে সময়। এখনো অনেক জায়গায় এই দাসপ্রথা পরোক্ষভাবে টিকে আছে। আবার অনেক জায়গায় ওই যুগের মতো দাসপ্রথা না থাকলে পুঁজিবাদ সমাজে আরেক রকম দাস তৈরি করছে তার স্বার্থে।
‘মুমু’ উপন্যাসের গেরাসিম আর সেই ছোট কুকুর আমাদের সামনে বারবার তাগিদ দেয়, এমন একটা পৃথিবী হোক যেখানে মানুষের ওপর সব ধরনের নির্মমতার অবসান হবে, মানুষ সব ধরনের দাসত্ব আর নিপীড়ন থেকে মুক্ত হবে। একই সঙ্গে মানুষের মন থেকে নিষ্ঠুরতা দূর হোক, এ গল্প আমাদের মনে সে আকাঙ্ক্ষাও জাগিয়ে দেয়।