বইয়ের কথা
তোত্তো-চান : আমাদের শিশু-কিশোরদের দীর্ঘশ্বাস!
এক দেশে ছিল এক ছোট্ট মেয়ে। সে ছিল ভারি চঞ্চল আর দুষ্টু। মা-বাবা আর পোষা কুকুর রকির সঙ্গে সে বাস করত জাপানের পাহাড়ঘেরা এক শহরে। সেই মেয়েটির নাম তোত্তো-চান। খুব দুষ্টু হওয়ার তোত্তো-চানকে কোনো স্কুলে রাখতে চাইত না। নিরুপায় হয়ে তার মা তাকে নিয়ে গেল ‘তোমোই গাকুয়োন’ নামে এক আজব স্কুলে।
সেই দুষ্টু মেয়েটি আর সেই আজব স্কুলের গল্প নিয়েই জাপানি লেখক তেৎসুকো কুরোয়ানাগির বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘তোত্তো-চান : জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটা’। বইটির কাহিনীর সঙ্গে মিল রেখে চমৎকার সব ছবি এঁকেছেন চিহিরো ইবাসাকি। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মৌসুমী ভৌমিক।
‘তোমোই গাকুয়োন’ নামের স্কুলে ভর্তি হয়ে তোত্তো-চান বুঝতে পারল, এ এক মজার স্কুল। পরিত্যক্ত রেলের কামরায় ক্লাস নেওয়া হতো সেই স্কুলে। প্রত্যেক ছাত্রই একেকটি ক্লাসের রেলের কামরার যাত্রী হতো। স্কুলে ধরাবাঁধা কোনো ক্লাসের বালাই ছিলো না। গান গেয়ে, খেলাধুলা করে, ঘুরে বেড়িয়ে, ছবি এঁকে, মজার মজার সব কাজ করতে করতেই পড়াশোনা করত স্কুলের ছেলেমেয়েরা। স্কুলের সব শিক্ষক বন্ধুর মতো, একটুও বকা দেন না, শাস্তিও হয় না দুষ্টুমি করলে।
স্কুলের হেডমাস্টারমশাই সোসাকু কোবায়াশি চমৎকার মানুষ। স্কুলের সবার সব কথা শোনেন আর দারুণ সব সমাধান দেন। তিনি চাইতেন, শিশুরা তাদের মনের সৌন্দর্যকে বিকশিত করুক, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠুক। আর তাই একটা নতুন ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি তিনি প্রয়োগ করলেন স্কুলে। সংগীত ও সুরের সাহায্যে শিক্ষা দেওয়া হতো শিশুদের, যাকে বলা হয় ‘ইউরিদমিক্স’। আসলে কোবায়াশি জাপানের অন্যতম বড় শিক্ষাবিদ ছিলেন।
এই স্কুলে স্কুলে কাউকে নতুন জামা পরে আসতে হতো না। তাতে করে খেলতে গিয়ে জামা ছিঁড়ে গেলে বা নোংরা হয়ে গেলে সমস্যা হয় না। ‘সাগর থেকে, পাহাড় থেকে’ টিফিন আনতে হতো। মানে সাগর থেকে পাওয়া মাছ জাতীয় খাবার আর পাহাড় থেকে শাকসবজি জাতীয় খাবার মিলিয়ে পুষ্টিকর খাদ্য দিয়ে হতো দুপুরের টিফিনা। কেউ তা না আনলে স্কুল থেকেই দেওয়া হতো ‘সাগর থেকে, পাহাড় থেকে’। স্কুলের লাইব্রেরি, সুইমিংপুল, গ্রীষ্মের ছুটিতে ক্যাম্প করা, গান করা, ছবি আঁকা—সবকিছু থেকেই শিশুরা নানা বিষয় সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে শিখে ফেলছে। এমনকি ন্যায়-অন্যায়, দায়িত্ববোধ, অন্যকে সহযোগিতা করা, মিলেমিশে থাকা—সবকিছুই খেলতে খেলতে শিখে ফেলছে এই স্কুলের শিশুরা।
স্কুলে অনেক শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধকতা থাকা শিশুরা পড়তে আসত, তাদের কেউ যেন আলাদা না ভাবে, সে জন্য নানারকম আয়োজন করতেন হেডমাস্টার মশাই। এই বাচ্চারাও যেন নিজেদের দুর্বল না ভাবে, অসুন্দর না ভাবে—সেজন্য সচেতন থাকতে হতো স্কুলের সবাইকে। শিশুরা যেন নিজেদের শরীর সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবে ভাবতে শেখে, নিজেদের পার্থক্য নিয়ে বিব্রত বা অতিরিক্ত কৌতূহলী না হয়, সেজন্য সুইমিংপুলে নামার সময় সবাইকে খালি গায়ে নামার সুযোগ রাখা হতো। স্কুলের বাচ্চাদের সবারই একটা করে গাছ থাকত, ওই গাছের পরিচর্যা করার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হতো। তেমনি করে স্কুলের সব কাজেই বাচ্চারা অংশ নিত। আর এভাবেই গড়ে উঠত দায়িত্ববোধ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তোমোই গাকুয়েন একদিন ধ্বংস হয়ে যায়। বোমার আঘাতে ধ্বংস হয় তোত্তো-চান, তাকাহাশি, মিয়ো-চান,সাক্কো-চানদের প্রিয় স্কুল। কিন্তু তোত্তো-চানদের মন থেকে মুছে যায়নি এই স্কুলের স্মৃতি। আর তাই তো বড় হয়ে নিজের ছোটবেলাকার সেই স্কুলের মজার মজার সব গল্প লিখে গেছে তোত্তো-চান ওরফে তেৎসুকো কুরোয়ানাগি।
এই বই পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে : কেন আমাদের ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া আর গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ার জন্য দৌড়াতে হয়? কেন পরীক্ষা আর পড়ার চাপে আমাদের সুন্দর শৈশব-কৈশোর চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে? কেন কোচিং-গাইড বইয়ের হাত থেকে আমরা নিস্তার পাচ্ছি না? আহা, বাংলাদেশের স্কুলগুলো কেন এমন মজার হয় না!