বাঁক : ছোটকাগজের বড় জগৎ
কখনো কখনো ‘ছোট’ শব্দের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয় এবং ছাড়িয়ে যায় নিজের সীমারেখা। এমনি একটি ছোটকাগজ ‘বাঁক’। মুহাম্মদ ফরিদ হাসান সম্পাদিত গল্পবিষয়ক কাগজটির এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রতিটি সংখ্যাই অনেক সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে সমসমায়িক লিটলম্যাগগুলোর মধ্যে ‘বাঁক’ উল্লেখযোগ্য ছোটকাগজে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এ ছোটকাগজটির তৃতীয় সংখ্যা। চলতি সংখ্যা নিয়ে সম্পাদক নিজেই বলেছেন, ‘বাঁক পড়ে পাঠকের যেন সময় বৃথা না যায়। বিগত দুটি সংখ্যায় সেই স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।’
চলতি সংখ্যাসহ তিনটি সংখ্যারই পাঠক হিসেবে আমিও সম্পাদকের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করছি। আমি মনে করি, বাঁক গল্পপড়ুয়াদের প্রত্যাশা পূরণে যথার্থ ভূমিকা পালন করে চলছে। আলোচ্য সংখ্যাটি দেশের প্রবীণ-নবীন গল্পকারের লেখায় সাজানো হয়েছে। এতে গল্প রয়েছে ১২টি। সদ্যপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক শওকত আলী এবং এ সময়ের আলোচিত গল্পকার মাসউদুল হকের সাক্ষাৎকার আলোচ্য সংখ্যার শোভা বৃদ্ধি করেছে। এ ছাড়া রয়েছে প্রবন্ধ ও গল্পগ্রন্থ আলোচনা।
চলতি সংখ্যার প্রথম রচনা বিধান রিবেরুর লেখা ‘জলসাঘর : জমিদার বনাম নব্যধনীর গল্প’ শীর্ষক প্রবন্ধটি। তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’ গল্পটি নিয়ে সিনেমা তৈরি করতে গিয়ে সত্যজিৎ রাজনৈতিকভাবে কোথায় অবস্থান নিয়েছেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে এ প্রবন্ধে। প্রবন্ধে যুক্তিসহ প্রাবন্ধিক বলেছেন, সিনেমায় রূপ দিতে গিয়ে তারাশঙ্করের গল্পের ভাব অনেকখানিই বদলে ফেলেছেন সত্যজিৎ। বিধান রিবেরু লিখেছেন, ‘তারাশঙ্করের গল্পে জমিদার কর্তৃক প্রজাদের বাড়িতে আগুনের ঘটনা যেমনি আছে, তেমনি আছে বাইজির সঙ্গে যাত্রিযাপনের কথাও। তবে সত্যজিতের ছবিতে জমিদারি চরিত্রে এসব বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। সামন্তপ্রভুর নিষ্ঠুর ও নির্যাতনকারী বৈশিষ্ট্যের বদলে তার সংগীতপ্রেমকেই মুখ্য ও একমাত্র বিষয় করে তুলেছেন সত্যজিৎ।’ জলসাঘর সম্পর্কে প্রাবন্ধিক যে প্রসারিত দৃষ্টি দিয়েছেন, উপরোক্ত মন্তব্য দেখে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাঁকে ‘লেখকের প্রিয় গল্প’ হিসেবে শাহিন আখতারের ‘অলৌকিক ছড়ি’ প্রকাশিত হয়েছে। গল্পটি সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক ঘটনা নিয়ে লেখা। গল্পে রাখাইন রাজ্যের মুসা শিশু চরিত্র দিয়ে রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক পীড়নের কথা তুলে ধরেছেন লেখক। গল্পে নবী হজরত মুসা (আ.)-এর ঘটনাও মিথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এ গল্পের প্রধান চরিত্র মুসা। গল্পকারের ভাষায়, ‘মুসাদের কাফেলা যখন নাফের তীরের বালু চরে পৌঁছায়, তখন বালিতে বোঝা নামিয়ে লাঠিটা ভারমুক্ত করে সে। বালুর চরে তখন কারবালা। পানির কষ্ট, খানার কষ্ট।’ গল্পকার এমন চমৎকার বর্ণনায় ঐতিহাসিক ঘটনার সংমিশ্রণে ফুটিয়ে তোলেন রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক অভিঘাত ও চিত্রগুলো। গল্পে রাখাইন রাজ্য আর ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করেন গল্পকার।
বাঁক-এ গল্প লিখেছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আফসানা বেগম, হাবিব আনিসুর রহমান, হামিদ কায়সার, মহসীন চৌধুরী জয়, মঈনুল হাসান, মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, তাপস রায়, কাজী লাবণ্য, সানোয়ার রাসেল ও সুবন্ত যায়েদ। কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্যামল চন্দ্র নাথ। মাসউদুল হকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদক নিজেই। সবশেষে কাদের পলাশের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দীর্ঘশ্বাসের শব্দ’ বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন কবি শাহ বুলবুল। গল্প, আলোচনা ছাড়াও আরেকটি বিষয় আমার বিশেষ দৃষ্টি কেড়েছে। সেটি হলো ‘বাঁক’ প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞাপনের ঝক্কি-ঝামেলাবিহীন। বিজ্ঞাপনবিহীন লিটলম্যাগ প্রকাশ করা খুবই দুরূহ। সব মিলিয়ে চমৎকার একটি সংখ্যা পাঠককে উপহার দেওয়ার জন্য বাঁক সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাই।
বাঁক
প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০১৮ সংখ্যা। প্রচ্ছদ : সারাজত সৌম। শুভেচ্ছা মূল্য : ১০০ টাকা।