বইয়ের কথা
ম্যাক্সিম গোর্কির ছোটবেলা
রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩৬), যাঁর সাহিত্য সৃষ্টি আজো পৃথিবীর অগণিত মানুষকে আলোড়িত করে। মহান এই সাহিত্যিকের নিজের ছোটবেলাকার আত্মজীবনীমূলক ‘পৃথিবীর পথে’ বইটা নিয়ে কিছু বলতে চাই। অনুবাদক সত্য গুপ্ত।
ম্যাক্সিম গোর্কির শৈশব নানা অভিজ্ঞতায় ভরপুর। ছোটবেলায় মা-বাবা হারানো এতিম গোর্কি লালিত-পালিত হয়েছেন দিদিমা ও ঠাকুরদার কাছে। গোর্কির দিদিমা ছিলেন স্নেহময়ী, কিন্তু তারা ঠাকুরদা বেশ বদমেজাজি। গরিব পরিবারে জন্ম নেওয়া গোর্কিকে পেটের তাগিদে ছোটবেলা থেকেই কাজ করতে হয়েছে। জুতার দোকানের বয়ের কাজ, কারখানার শ্রমিক, জাহাজে থালাবাসন ধোয়ার কাজ, পাখি ধরে বিক্রি করা, বনে কাঠ কাটা, অন্যের বাসায় কাজ করা, আইকন চিত্রশালার কাজ—এমন নানা বিচিত্র পেশায় ম্যাক্সিমের জীবনে ওই বয়সেই জমা হয়েছিল অনেক অভিজ্ঞতা। কত বিচিত্র রকমের মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে, কত বিচিত্র ঘটনার মুখোমুখি হয়ে কত কিছুই না করতে হয়েছে তাঁকে, কত উপলব্ধিই না জীবন থেকে ঠেকে তাঁকে শিখতে হয়েছে—তার হিসাব নেই।
শত কষ্ট, অমানুষিক পরিশ্রম, মালিকদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, অপমানের মধ্যেও ম্যাক্সিম বইকে ভালোবেসেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তিনি বাল্যকালে পাননি, কিন্তু লুকিয়ে বই পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। বইয়ে পাওয়া জ্ঞান আর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ম্যাক্সিমের চিন্তা আর দশজনের থেকে আলাদারকম হয়ে উঠেছিল। মানুষ সম্পর্কে, তার চারপাশ সম্পর্কে, নারী সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে, ধর্ম সম্পর্কে তার বোধ বদলে যেতে শুরু করে। এই বদলে যেতে থাকা চিন্তাগুলো পাঠককেও ভাবাবে।
ম্যাক্সিম যে শ্রেণির মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, তাতে বই পাওয়া সহজ ছিল না। ভালো বই, মন্দ বই—সবই তাঁকে পড়ে বুঝতে হয়েছে। বই সম্পর্কেও তাঁর ধারণা পাল্টেছে বিভিন্ন সময়ে। ম্যাক্সিম অনেক বইয়ের নায়কদের সঙ্গে তাঁর পাশের শ্রমজীবী মানুষদের জীবন মেলাতে পারেন না। সেই মানুষেরা, যাঁরা জীবনে কিছুই পাননি। পাননি কবিতার রস আস্বাদন করার শিক্ষা, জীবনকে অন্যভাবে ভাববার মনন। সমাজের নোংরা গলিতে যাঁদের জন্ম, যাঁদের বেড়ে ওঠা, তাঁদের কথা এসব বইয়ে কই? গোর্কির মাতাল, জুয়ারি, মারকুটে বন্ধুদের জীবনের কষ্ট তো লেখা নেই এসব বইয়ে। এসব বইয়ের মানুষরা বাস্তব পৃথিবী থেকে আলাদা জগতে বাস করে যেন, দুঃখ-কষ্ট নেই। তিনি খুঁজতে থাকেন সেই বই, যা তাঁকে দেখাবে মানুষের কষ্ট-বেদনা। ম্যাক্সিমের এই উপলব্ধি আর বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণেই বোধহয় পরবর্তী সময়ে তিনি এমন উঁচুমানের সাহিত্যিক হতে পেরেছিলেন।
এক জায়গায় গোর্কি লিখেছেন, ‘মানুষকে আমি ভালোবেসেছি আর এই ভালোবাসতে গিয়ে, মানুষকে ব্যথা দেওয়ার হাত থেকে দূরে সরিয়ে দিতে গিয়ে আমি দেখেছি ভাবপ্রবণ হওয়া আমাদের উচিত নয়। কঠোর সত্যকে চকচকে কথার বাক্যজালে বা মনোরম মিথ্যা দিয়ে যেন আমরা ঢেকে না রাখি। আমাদের দাঁড়াতে হবে জীবনের কাছে, আরো কাছে। আর তার ভেতরে উজাড় করে ঢেলে দিতে হবে আমাদের মনপ্রাণের যা কিছু শিব, যা কিছু মানবিক সব।’
গোর্কি তাঁর চারপাশের মানুষদের দেখেছেন, যারা নারীদের সম্পর্কে খুবই নিচু ধারণা পোষণ করে, নারীরা যেন যৌনসামগ্রীর বাইরে আর কিছুই নয় সমাজে। গোর্কি তাঁর চারপাশে স্নেহময়ী নারীদের দেখেছেন, তাই বালক গোর্কি কোনোভাবেই নারী সম্পর্কে লোকেদের বলা বাজে মন্তব্যগুলোকে হজম করতে পারতেন না। নারীদের জীবনের কষ্ট, তাঁদের প্রতি অপমানগুলো বালক গোর্কিকে পীড়া দিত। গোর্কি লিখেছেন, ‘মেয়েদের সম্পর্কে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি সবচাইতে বেশি অপমানিত করে তুলত আমাকে।’
ধর্ম, পাপ, নরকের শাস্তি, অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস—এসব নিয়েও বালক গোর্কির চিন্তা বিভিন্ন সময়ে বদলাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন প্রচলিত ধর্মগুলোর অসাড়তা। ধরতে পারেন ধর্মের নামে ভণ্ডামিগুলো, তাঁর কাছে উন্মোচিত হতে থাকে সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ। গরিবদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ধর্মীয় কুসংস্কারকে পুঁজি করে ব্যবসা করে ধনীরা, গোর্কি তাদের ঘৃণা করতেন।
এক জায়গায় ম্যাক্সিম লিখেছেন, ‘যে ধর্মবিশ্বাসের জন্য ওরা এমন আকুল আগ্রহে, এমন মিথ্যে গরিমায় আত্মবলি দিয়ে চলেছে সে বিশ্বাসের ভিত সুদৃঢ় সন্দেহ নেই। কিন্তু তা যেন একটা পুরোনো পোশাকের ওপরের ধুলো-ময়লার পুরু আস্তরণ—যা এমনই বোঝাই যে আর নষ্ট হওয়ার নয়। ওরা ওদের চিন্তা, ওদের অনুভূতি, গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের শক্ত খাঁচার ভেতরে দৃঢ়ভাবে বন্দি থেকে এমন অভ্যস্ত হয়ে উঠছে যে তাতে করে ওরা যেন পঙ্গু বিকলাঙ্গ, অচল অনড় হয়ে পড়েছে—তার জন্য এতটুকুও বিক্ষুব্ধ নয়।’
ম্যাক্সিম আরো লিখেছেন, ‘এই অভ্যাসে পাওয়া বিশ্বাস আমাদের জীবনের একটা ভীষণ দুষ্ট ক্ষত, একটা নিদারুণ পরিতাপের ব্যাপার। পাথুরে দেয়ালে ঘেরা ছায়ার মতো এই বিশ্বাসের গণ্ডির ভেতরেও নতুন জন্ম নিয়ে অতি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে বিকৃত, রক্তশূন্য হয়ে। ওই অন্ধবিশ্বাসের তমসা ভেদ করে প্রেমের আলোকরেখা আসে, অতি অল্প, অনেক বেশি পরিমাণে আসে হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, ভাইয়ের প্রতি ঘৃণা আসে প্রচুর পরিমাণে। এই বিশ্বাসের অগ্নিশিখা শুধু ধ্বংসেরই উত্তাপহীন দীপ্তিমাত্র।’
চারপাশের এত কঠোর বাস্তবতাকে অবলোকন করেও গোর্কি নতুনের স্বপ্ন দেখতেন, সুন্দরের স্বপ্ন দেখতেন। তাই বইয়ের শেষের দিকে গোর্কি লিখেছেন, ‘ইচ্ছে হলো এই মাটিকে আর নিজেকে এমন পদাঘাত করি, যাতে সবকিছু বিঘূর্ণিত হয়ে ওঠে আনন্দের আবর্তে, আত্মহারা নৃত্যে, যেখানে নাচছে তারা যারা পরস্পরকে ভালোবাসে। ভালোবাসে এই জীবনকে, এই জীবনকেই—আরো সৎ, আরো সাহসী, আরো সুন্দর এক জীবনের স্বপ্নে।’
একদিন পৃথিবীটা বদলে যাবে—এই বিশ্বাস করতেন গোর্কি। নিজেকে বদলাতে হবে, মানুষকে বদলাতে হবে—এমন চিন্তা করতেন। ১৫ বছরের বালক গোর্কি তাই পড়ালেখা করার একটা উপায় খুঁজতে কাজানে পাড়ি জমান ১৯১৪ সালে। গোর্কির ১৫ বছরের এই জীবনের পথপরিক্রমা যেন একটা মহাকাব্য। মহাকাব্যময় গোর্কির জীবনটা পড়লে পাঠক জীবনকে আরো কতভাবে দেখা যায়, তার একটা ধারণা পাবেন। চিন্তায় আঘাত দেওয়ার মতো গোর্কির সব অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি জানতে চাইলে বইটা পড়ুন।