বইয়ের কথা
সত্যজিৎ যখন ছোট ছিলেন
- পঞ্চম জর্জ নাকি তোর দাদু? সত্যি নাকি?’
-‘রবিবাবু তোর কে হন রে? জ্যাঠামশাই?’
স্কুলে থাকতে এসব মসকরা করে ছেলেরা জ্বালাতন করত শান্তশিষ্ট ( কেউ কেউ জুড়ে দিত ‘লেজ বিশিষ্ট’) একটা ছেলেকে। করবে না-ই বা কেন! ক’দিন পরপর ছেলেটির নানা পরিচয় বের হতে থাকে। এই জানা গেল ছেলেটি সুকুমার রায়ের ছেলে, কদিন পর শোনা গেল সে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নাতি। আবার সে এইচএমভির আর্টিস্ট কনক দাশের ভাগ্নে কিংবা বাংলার সেরা ক্রিকেটার কার্তিক বোসের ভাতিজা। তাহলে রবিবাবু তার জ্যাঠামশাই হলেও ছেলেরা আশ্চর্য হতো না! ছেলেটি আর কেউ নয়, আমাদের সবার প্রিয় সত্যজিৎ রায়। পরবর্তী জীবনে সত্যজিৎ নিজের প্রতিভায় বিশ্বখ্যাত হয়েছিলেন। একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, সাহিত্যিক, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার…!
পড়ছিলাম সত্যজিৎ রায়ের লেখা ছোটবেলার স্মৃতিচারণামূলক 'যখন ছোট ছিলাম' বইতে। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ সত্যজিতেরই করা। সেই সাথে স্মৃতিময় নানা ফটো ও ফ্যাকসিমিলিও যুক্ত করা আছে বইয়ে। এই স্মৃতিকথা প্রথম বেরিয়েছিল 'সন্দেশ' মাসিক পত্রিকার দুই সংখ্যায়। পরে ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ বের করেছে বইটি। বেরিয়েছে বাংলাদেশ থেকেও।
সত্যজিতের বাবা বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়, ছেলের বয়স যখন আড়াই তখন মারা যান। ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীও নাতি সত্যজিতের জন্মের সাড়ে পাঁচ বছর আগে মারা যান। ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রের নিজ হাতে নকশা করা গড়পাড়ের আলিশান বাড়ি ও ছাপাখানার বর্ণনা যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় পাঠকের কল্পনায়। তবে উপেন্দ্রকিশোরের যত্নে গড়া এই বাড়িতে তিনি নিজে থাকতে পেরেছিলেন মাত্র চার বছর। বাড়ির নাম দিয়েছিলেন- ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স প্রিন্টার্স অ্যান্ড ব্লক মেকার্স’।
এই বাড়িতে সত্যজিৎও পাঁচ বছর বয়স পর্যন্তই থাকতে পেরেছিলেন। জন্মস্থান গড়পাড়ের বাড়ি ছেড়ে পরে তাকে মায়ের সাথে ভবানীপুরে মামার বাড়িতে চলে আসতে হয়। ওই শিশু বয়সে সত্যজিতের দেখা কলকাতার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সাথে এখনকার কলকাতার হয়তো আর কোনো মিলই খুঁজে পাবে না পাঠক।
সত্যজিতের ছেলেবেলার মজার মজার সব স্মৃতি হয়তো পাঠকের শৈশবের স্মৃতিকে আবার জাগিয়ে তুলবে। সত্যজিতের অদ্ভুত সব মামা, ছুটিতে বিভিন্ন জায়গায় ঘটনাবহুল সব ভ্রমণ, স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে, বন্ধুদের নিয়ে মজার মজার সব স্মৃতি, কত রকমের খেলা, হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, সাহেব দোকানে গিয়ে গ্রুপ ছবি তোলা, জুডো শেখা- এমন কত আনন্দের স্মৃতিতে ভরা সত্যজিতের শৈশব!
সত্যজিতের শৈশবের অনেক মজার ঘটনার মধ্যে একটা ঘটনার উল্লেখ করি। জীবনে প্রথমবার আইসক্রিম খাওয়ার স্মৃতি- ‘প্রথম চামচ মুখে দিয়ে দাঁত সিরিসির করায় আমি বলেছিলাম আইসক্রিমটা একটু গরম করে দিতে।’ আর এই নিয়ে কতদিনই তাকে ক্ষ্যাপানো হয়েছে!
সাড়ে আট বছর বয়সে ‘বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল’-এ ভর্তি হয়েছিলেন সত্যজিৎ। এই স্কুলকে ঘিরে কত না সুখ-দুঃখের স্মৃতির উল্লেখ করেছেন সত্যজিৎ। স্কুল ছুটির মজা নিয়ে সত্যজিৎ তার অনুভূতি লিখেছেন- ‘ছুটি জিনিসটা যে কী, আর তার মজাটাই বা কী, সেটা স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে জানা যায় না।’
এই স্কুল ছাড়ার ১০ বছর পর এক অনুষ্ঠানে শৈশবের স্কুলে এসে সত্যজিতের বদলে যাওয়া অনুভূতিটাও চমৎকার করে লিখে গেছেন- ‘এ কোথায় এলাম রে বাবা! এ ঘর কি সেই ঘর—যেটাকে এত পেল্লায় বলে মনে হত? দরজায় যে মাথা ঠেকে যায়! শুধু দরজা কেন, সবই যেন ছোট ছোট মনে হচ্ছে—বারান্দা, ক্লাসরুম, ক্লাসের বেঞ্চিগুলো।
অবশ্যি হবে নাই বা কেন। যখন স্কুল ছেড়েছি তখন আমি ছিলাম পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, আর এবার যে ফিরে এলাম, এখন আমি প্রায় সাড়ে ছ’ফুট। স্কুল ত আছে যেই কে সেই, বেড়েছি শুধু আমিই।’
আর এই অনুভূতির পর লিখেছেন উপলব্ধিটাও- ‘যেসব জায়গার সঙ্গে ছেলেবেলার স্মৃতি জড়িয়ে থাকে, সেসব জায়গায় নতুন করে গেলে পুরোন মজাগুলো আর ফিরে পাওয়া যায় না। আসল মজা হল স্মৃতির ভাণ্ডার হাতড়ে সেগুলোকে ফিরে পেতে।’
আমরাও বোধহয় সত্যজিতের মতো স্মৃতির ভাণ্ডার হাতড়ে শৈশবের সেই আনন্দের দিনগুলোকে খুঁজতে থাকি, আনমনে হেসে উঠি। সত্যজিতের শৈশবের স্মৃতি পড়ে নিজের শৈশবের স্মৃতিগুলো পাঠকের মনেও দোলা দেবে আশা করি।