মোনা লিসার হাসি
চিত্র ১, মোনা লিসা (আলোকচিত্র : ডেনিস হ্যালিনান)
পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতিকৃতিটি তৈলচিত্রে আঁকা একজন মধ্যবয়সী নারীর। মাঝারি আকারের এই প্রতিকৃতিটি, জাদুঘরের দেয়ালে বসে, আজো প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শকের সাথে হাসি বিনিময় করে চলছে। যারা প্রতিকৃতিটির মুদ্রিত চিত্রটি দেখে প্রশ্ন করেছেন একদিন, কেন এই শিল্পকর্মটি এত বিখ্যাত ও জনপ্রিয়? তারা তাদের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন মূল তৈলচিত্রটি থেকে। এই প্রতিকৃতিটিই শুধু বিখ্যাত নয়, এর সৃষ্টির পেছনে যিনি রয়েছেন তিনিও এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাধর ও সৃষ্টিশীল মানুষদের একজন। শিল্পী ও শিল্পকর্মের এই অসাধারণ মিথষ্ক্রিয়ায় পৃথিবী আজ পেয়েছে এমন এক ভুবনভোলানো হাসি, যা কি না শুধু রহস্যের জালই বোনে না বরং অনেক বৈজ্ঞানিক রহস্যেরও সমাধান ইঙ্গিত করে।
মোনা লিসার প্রতিকৃতিটির সামনে দাঁড়ালে অনেকের মনে হতে পারে যে, আমাদের গোপন মনোজাগতিক বিষয়গুলো আর গোপন থাকছে না এবং সে সব বুঝতে পারছে, আর পারছে বলেই মিটিমিটি হাসছে। মোনা লিসাকে মনে হবে রক্তমাংসের জীবন্ত কোনো মানুষ। এবং আপনি ঘরের যে দিকেই হাঁটুন না কেনো মোনা লিসার দৃষ্টি আপনাকে অনুসরণ করবে। এমন একটা বিভ্রম সৃষ্টি করবে যেন এটি কোনো স্থিরচিত্র নয় বরং চলচ্চিত্র। সেভাবে বিবেচনা করলে মোনা লিসাকে ৫০০ বছর আগে সৃষ্ট একটি ভিডিও ইন্সটলেশন বলা যেতে পারে।
মোনা লিসার হাসি সৃষ্টির নেপথ্যে আছে শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির (লিওনার্দো দ্য সের পিয়েরো দ্য ভিঞ্চি) অক্লান্ত পরিশ্রম এবং গভীর জ্ঞান-গবেষণা। মোনা লিসার কাজটি তিনি শুরু করেছিলেন ১৫০৩ সালে এবং এর ১৬ বছর পর তাঁর মৃত্যু অবধি যার উপর তিনি একটানা কাজ করা অব্যাহত রেখেছিলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বিছানার পাশেই মিটিমিটি হাসছিল মোনা লিসা। সেই হাসির রহস্যের নেপথ্যের কিছু কথা আজ আমরা জানব।
মোনালিসার হাসির জাদু সৃষ্টি হয়েছে, গতি ও আবেগের সমন্বয়ে, মনে হয় যেন আমাদের দৃষ্টির প্রতি এটি একটি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করছে, তার রহস্যময় হাসি প্রত্যুত্তর হয়ে ফিরে আসে। তার কম্পমান অবয়বে হাসিটির যেন ঈষৎ পরিবর্তন হয় সর্বদা। এমনকি আমরা যখন অন্য দিকে তাকাই, সেই রহস্যময় হাসিটি আমাদের মনের মধ্যে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে, যেমন করে মানবতার সামগ্রিক মনে এটি টিকে থাকে। লিওনার্দোর আর কোনো চিত্রকর্মেই এভাবে গতি আর আবেগের জোড়া কষ্টিপাথর পরস্পর গ্রন্থিত হয়ে নেই।
লিওনার্দোর সমসাময়িক শিল্পী ও শিল্পকলার ইতিহাসবিদ জর্জিও ভাসারি বর্ণনা করেছিলেন, লিওনার্দো কীভাবে ফ্লোরেন্সের এক রেশমি কাপড় ব্যবসায়ীর স্ত্রী, লিসা ডেল জকন্ডোর প্রতিকৃতি আঁকার সময় তার মুখে হাসি ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। গায়ক আর বাজিয়েদের তিনি শুধু নিয়োগ করেননি, লিসাকে আনন্দ দেবার জন্য ভাঁড়দেরও ভাড়া করেছিলেন। কারণ, আমরা যখন অলসভাবে একই স্থানে অনেকটা সময় নিয়ে বসে থাকি, আমাদের অবচেতন মনে ভাবনাগুলো তখন ভেসে ওঠে মনের পর্দায় আর তার আভাস মেলে অবয়বে। ধীরে ধীরে আমাদের অভিব্যক্তি হয়ে যায় গম্ভীর কিংবা মলিন। লিওনার্দো সফল হয়েছিলেন সেই বিষণ্ণতার একটি সমাপ্তি ঘটাতে, যা অন্য অনেক শিল্পীরা প্রায়ই তাদের সৃষ্ট প্রতিকৃতিতে প্রদর্শন করতে সফল হতেন। লিওনার্দো যা করেছিলেন সেটি ছিল উত্তর-আধুনিক সময়ে অ্যান্ডি ওয়ারহল ও মারিনা আব্রাহমোভিচ যা পরে করেছিলেন, ঠিক তার বিপরীত।
ভাসারির বর্ণনায় মোনা লিসার হাসি একটি ‘স্বর্গীয়’ হাসি এবং এতই সুন্দর যে সেটি মানবিক হতে পারেনা। এবং তিনি এটাও দাবী করেছিলেন যে, এটি অতিমানবীয় দক্ষতার একটি ফসল, যা সরাসরি ঈশ্বরপ্রদত্ত। স্পষ্টতই মোনা লিসার হাসি স্বর্গীয় কোনো হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি। বরং শৈল্পিক দক্ষতা ও প্রায়োগিক বিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু বছরের পরিশ্রমসাধ্য এবং চর্চিত মানবিক প্রচেষ্টার একটি পরিণতি বলা যেতে পারে। লিওনার্দো তাঁর কারিগরী এবং শরীরস্থান সংক্রান্ত জ্ঞান ব্যবহার করে, দর্শকের দৃষ্টির উপর একটি প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন, যা অসাধারণ শৈল্পিক এই দক্ষতাটির প্রদর্শন সম্ভব করেছিল। মোনা লিসা সৃষ্টি করার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন শিল্পকলা আর বিজ্ঞানের সম্মিলনে কিভাবে সৃজনশীলতার সবচেয়ে প্রগাঢ় উদাহরণটির জন্ম হতে পারে। বাস্তবিকভাবেই লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তাঁর সমস্ত প্রতিভাকে একত্র করেই মোনা লিসাকে সৃষ্টি করেছিলেন। শারীরস্থান থেকে শুরু করে শিল্পশৈলী নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, উপাদান প্রস্তুতের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে তুলির শেষ আঁচড় পর্যন্ত তিনি ব্যবহার করেছিলেন মোনা লিসার হাসির সেই ‘স্বর্গীয়’ রূপটি সৃষ্টি করতে।
চিত্র ২: লিওনার্দোর নোটবুক, রয়্যাল কালেকশন ট্রাস্ট, যুক্তরাজ্য
লিওনার্দো ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে শারীরস্থানের চর্চা করেছিলেন। তাঁর নোটবুকের প্রায় ৭০০০ পৃষ্ঠায় তিনি লাখ লাখ শব্দ ও রেখাচিত্র এঁকেছিলেন। এই প্রক্রিয়ার শুরুতে তিনি মানুষের মুখের ব্যবচ্ছেদ করে প্রতিটি মাংশপেশিকে স্বতন্ত্রভাবে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। যে মাংসপেশিগুলো আমাদের ঠোঁট নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের গতিবিধি ও ক্রিয়াকলাপ বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। যে বছরগুলো তিনি লিসার হাসিকে ক্রটিহীন করে তুলতে ব্যয় করেছিলেন, সেই বছরগুলোয় লিওনার্দো বহু রাত কাটিয়েছিলেন ফ্লোরেন্সে তাঁর স্টুডিওর কাছেই সান্তা মারিয়া নুওভা হাসপাতালের মর্গের অন্ধকারে, মৃতদেহের শরীর ব্যবচ্ছেদ আর চামড়া ছাড়িয়ে মাংসপেশী আর এর নীচের স্নায়ু নিয়ে গবেষণা করে। মুখের প্রতিটি অংশের সম্ভাব্য সব গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে এর প্রতিটি মাংসপেশীকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুর উৎস নির্ধারণ করে কিভাবে হাসির সূচনা হয় সেটি জানতে তিনি তীব্র আগ্রহ অনুভব করেছিলেন। অনেক সমস্যা সত্ত্বেও, লিওনার্দো বিস্ময়কর নির্ভুলতার সাথে মুখের মাংসপেশী এবং স্নায়ুগুলো এঁকেছিলেন।
লিওনার্দো অনুধাবন করেছিলেন যে আলোক রশ্মি চোখের মধ্য একটি একক বিন্দুতে এসে মিলছে না বরং এটি রেটিনার পুরো জায়গাজুড়ে পড়ছে। রেটিনার কেন্দ্রীয় জায়গাটি, যা পরিচিত ‘ফোভিয়া’ নামে, যেখানে গাদাগাদি করে থাকে ‘কোন’ কোষগুলো, এবং জটিল সূক্ষ্ম বিস্তারিত নানা বিষয় দেখার জন্য এই জায়গাটি শ্রেষ্ঠ। ফোভিয়ার চারপাশের জায়গাটি ছায়া এবং সাদা কালো ছায়াগুলো সুস্পষ্টভাবে বোঝার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। যখন কোনো কিছুর দিকে আমরা সরাসরি তাকাই, এটি খুব স্পষ্ট মনে হয়, যখন আমরা একপাশ থেকে সেটি দেখি, চোখের একটি কোনা দিয়ে তাকাই, এটি খানিকটা অস্পষ্ট অনুভূত হয়, যেন মনে হয় এটি অপেক্ষাকৃত দূরে অবস্থান করছে।
চিত্র ৩ : লিওনার্দোর নোটবুক, রয়্যাল কালেকশন ট্রাস্ট, যুক্তরাজ্য
এই জ্ঞানটি ব্যবহার করে, লিওনার্দো সক্ষম হয়েছিলেন একটি ‘পারস্পরিকভাবে সক্রিয়’ হাসি সৃষ্টি করতে, এমন হাসি যা সহজে ধরা যায় না যদি আমরা সেটা দেখার জন্যে বেশি উদগ্রীব হই। লিসার মুখের কোনায় সূক্ষ্ম রেখাগুলো খানিকটা নীচের দিকে বাঁকানো, ঠিক শরীরস্থান সংক্রান্ত ড্রইঙের কাগজটির উপরে আঁকা ভেসে থাকা সেই ঠোঁটের মত। আপনি যদি সরাসরি ঠোঁটের দিকে তাকান, রেটিনা সেই সূক্ষ্ম বিস্তারিত বিষয় এবং রেখাগুলো ধরতে পারে, তাকে দেখে মনে হয় লিসা আর হাসছে না। কিন্তু যদি আপনি আপনার দৃষ্টি খানিকটা দূরে সরান, তার চোখের দিকে তাকান অথবা গালে অথবা চিত্রকর্মটির অন্য কোথাও, আপনি শুধু মুখটি প্রান্ত থেকে দেখবেন, এটি খানিকটা অস্পষ্টতর হবে। মুখের কোনায় বিস্তারিত খুঁটিনাটি এবং দাগগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু আপনি তারপরও মুখের প্রান্তে ছায়াগুলো দেখতে পারবেন। এই ছায়াগুলো আর তার মুখের প্রান্তে মৃদু ‘এসফুমাতো’ দেখে মনে হয় তার ঠোঁটগুলো ঈষৎ উপরের দিকে উঠে গেছে সূক্ষ্ম একটি হাসিতে। ফলাফল হচ্ছে একটি হাসি যা আরো বেশি উজ্জ্বলভাবে চমকে ওঠে, আপনি যত কম সেটি খোঁজার চেষ্টা করেন।
রেনেসাঁ পর্বে চিত্রকর্মের চারটি প্রধান কৌশলের একটি ছিল এসফুমাটো বা ফুমাতো; শব্দটি ইতালি ফুমো, বা ধোঁয়া থেকে এসেছে, ইংরেজী অনুবাদ, অস্পষ্ট, ধোয়াটে হতে পারে। এই শৈলীটি মূলত একটি সূক্ষ্ম শেডিং এর কৌশল, আরো বিশ্বাসযোগ্য চিত্র সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে রং এবং টোনগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম, মৃদু পরিবর্তনের ধাপ সৃষ্টি করা; প্রায়শই এটি ব্যবহার করা হতো সূক্ষ্ম ক্রমান্বিত রূপান্তরের ধাপ সৃষ্টি করার জন্যে যার মধ্যে কোনো রেখা বা সীমারেখা অন্তর্ভুক্ত করা হতো না। এই কৌশলটি চিত্রকর্মে মানুষের চেহারা সহজে বোঝা সম্ভব নয় এমন বিভ্রম সৃষ্টি করা ছাড়াও একটি সমৃদ্ধ পরিবেশগত প্রভাবও সৃষ্টি করত। লিওনার্দো এই কৌশলটিকে বর্ণনা করেছিলেন, ‘রঙের মিশে যাওয়া, কোনো রেখা বা সীমারেখার ব্যবহার ছাড়া, ধোঁয়ার মতো।’
মোনা লিসার হাসির সেই বিশেষ প্রভাবগুলো সৃষ্টি করার জন্য লিওনার্দোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল চিত্রকর্মটির জন্য ব্যবহৃত কাঠের পাত বা উড প্যানেলটির প্রস্তুতিপর্ব থেকেই। একটি পপলার গাছের কাণ্ডের ঠিক কেন্দ্র থেকে কেটে বের করা পাতলা আঁশ-বিন্যাসসহ একটি তক্তার উপর প্রথাগত নিয়মে চক আর পিগমেন্টের মিশ্রণের পরিবর্তে প্রথমে তিনি লেড-হোয়াইটের একটি প্রাইমার কোট বা আস্তরণ দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন এই আন্ডারকোটটি, আলোর যে রশ্মিগুলো তার আরোপিত গ্লেইজের স্বচ্ছ পাতলা স্তরগুলো অতিক্রম করতে সক্ষম হবে, সেগুলো আবার এই স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে পুনঃপ্রতিফলিত হবার সময় প্রথাগত প্রক্রিয়ার চেয়ে উত্তম প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে এবং এভাবেই এটি চিত্রকর্মটির গভীরতা, উজ্জ্বলতা এবং ব্যাপ্তির প্রভাবটিকে বৃদ্ধি করবে। আলোর রশ্মিগুলো যা রঙের স্তরগুলো অতিক্রম করে সাদা আন্ডারকোট অবধি পৌঁছায় এবং সেগুলো একই স্তরগুলো দিয়ে পুনরায় প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে ফিরে।
চিত্রকর্মটির পৃষ্ঠদেশ থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা এবং চিত্রকর্মটির গভীর থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা আলোকরশ্মিগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোই আমাদের চোখে ধরা পড়ে। আর এই প্রভাবটি একটি পরিবর্তনশীল, পলায়নপর সূক্ষ্মতা সৃষ্টি করে। লিসার গালের এবং হাসির দেহরেখাগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে টোনের মৃদু স্নিগ্ধ পরিবর্তনের মাধ্যমে, আপাত দৃশ্যমানভাবেই গ্লেইজের স্তরগুলো যা লুকিয়ে রেখেছে এবং সেগুলো পরিবর্তিত হয় যখন ঘরের মধ্যে আলো আর দৃষ্টিকোণ পরিবর্তিত হয় এবং হাসটি জীবন্ত হয়ে ওঠে।
লিওনার্দোর স্বতন্ত্র শৈলীটি ছিল অসাধারণভাবেই খুব পাতলা গ্লেইজের স্তর ব্যবহার করা এবং তারপর খুব ছোট ছোট আঁচড়ের মাধ্যমে, খুব ধীরে, বহু মাস বা কখনো কয়েক বছর ধরে তিনি সেই পাতলা স্তরগুলোর উপরে আরো বাড়তি স্তর যোগ করতেন। তাঁর তুলির আঁচড় এতই হালকা এবং বহুস্তর বিশিষ্ট যে সেখানে তুলির বহু একক আঁচড় অবোধ্য। এটি তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল এমন কিছু ফর্ম বা রুপ সৃষ্টি করতে যা দেখতে ত্রি-মাত্রিক মনে হয়, যা ছায়াগুলোর খুব সূক্ষ্ম ক্রমান্বিত রুপান্তরের ধাপ প্রদর্শন করে এবং এভাবেই বস্তুগুলোর সীমারেখাগুলোকে অস্পষ্ট করে দেয় সম্ভব হতো ‘এসফুমাটো’ শৈলীতে।
যে ছায়াগুলো মোনা লিসার মুখের হাসির চারপাশের দেহরেখাটি গঠন করেছে, সেখানে লিওনার্দো প্রথম বারের মত পোড়া অ্যাম্বার (গাঢ় হলুদ থেকে গাঢ় বাদামী যার রং) ব্যবহার করেছিলেন। লোহা আর ম্যাঙ্গানিজের মিশ্রণ ব্যবহার করেছিলেন পিগমেন্টটি সৃষ্টি করতে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা দেখিয়েছে, মোনা লিসার গালের গোলাপি রঙের বেইজের উপর একটি বাদামি গ্লেইজ খুব মসৃণভাবে ক্রমান্বিত ধাপ সৃষ্টি করেছে ২-৫ মাইক্রোমিটার থেকে প্রায় ৩০ মাইক্রোমিটারের কাছাকাছি এর সবচেয়ে গভীরতম ছায়ায়। এই আঁচড়গুলো উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে লিওনার্দো অনিয়মিতভাবে ব্যবহার করেছিলেন, চামড়াটিকে আরো জীবন্ত ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য।
একজন শিল্পপ্রেমিক যখন পারির ল্যুভ জাদুঘরের দেয়ালে রাখা মোনা লিসার সামনে এসে দাঁড়ান তিনি মূলত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাদুঘরই দেখেন মোনা লিসার মধ্যে। যার প্রতিটি স্তরে রয়েছে জ্ঞানের খোরাক, প্রতিটি দেয়ালে রয়েছে সময়ের সাক্ষ্য বহনকারী প্রলেপ। তিনি একটি ইতিহাসের অভিজ্ঞতালব্ধ হন, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সমন্বয়ে যা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি হাসি বিনিময় করেন মোনা লিসার সাথে, যে হাসির মধ্যেই লুকিয়ে আছে শিল্পী-বিজ্ঞানী-দার্শনিক লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির হাসি এবং তাঁর হাসির লক্ষ্য চিরন্তন মানবতা।
চিত্র ৪ : লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি