বইয়ের কথা
মুক্তবুদ্ধির খৈয়াম ও নজরুলের তর্জমা
পারস্যের কবি ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎগুলো অনেকেই বাংলায় অনুবাদ করেছে। এখন পর্যন্ত চারজনের অনুবাদ পড়েছি—কান্তিচন্দ্র ঘোষ, সিকানদার আবু জাফর, নরেন্দ্র দেব ও কাজী নজরুল ইসলাম। তবে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত 'রুবাইয়াৎ -ই-ওমর খৈয়াম'। ফার্সি মেজাজ আর ছন্দস্তবক ঠিক রেখে এত চমৎকার অনুবাদ বাংলায় বোধ হয় নজরুলই করেছেন।
কবি ওমর খৈয়ামের জন্ম ইরানের খোরাসান প্রদেশের নিশাপুর শহরে। আনুমানিক একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের দিকে তাঁর জন্ম, মৃত্যুর সাল মোটামুটি ১১২৩ খ্রিস্টাব্দ। পুরো নাম গীয়াসুদ্দিন ইবন্ আবুল ফতেহ্ ওমর বিন্ ইব্রাহিম অল্ খৈয়াম (খৈয়াম শব্দের অর্থ 'তাঁবু নির্মাণকারী’, যা তাঁর পারিবারিক পদবি)। গণিতশাস্ত্র, জড়বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানে অসাধারণ পণ্ডিত হলেও খৈয়াম লিখে গেছেন অসংখ্য চতুষ্পদী কবিতা (রুবাইয়াৎ মানে চতুষ্পদী কবিতা)।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি মুক্তচিন্তার অধিকারী ছিলেন। অদৃষ্টবাদী হওয়ায় কবির স্বর্গ-নরকের প্রতি অনাস্থা ছিল। পরকাল বলে কিছু আছে কিনা, সেখানে স্বর্গ-নরক আছে কিনা, তা তার যুক্তিশীল মননে অনাস্থার তৈরি করেছিল। তাই কবি বর্তমানকেই প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলে গেছেন। বাকি সব মায়া বা কুহক তাঁর মতে। জীবন-মৃত্যু, ইহকার-পরকাল, পাপ-পুণ্য, সত্য-মিথ্যা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, প্রেম ও আনন্দের স্বরূপ—সবকিছুতেই যেন এক মায়াজালে বোনা।
অনেকে তাঁকে সুফি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর কাব্যে প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগোড়াদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ স্পষ্ট দেখা যায়।
আবার কারো কারো মতে, কবি ওমর খৈয়াম Epicurean ছিলেন। অর্থাৎ জড়বাদী ও দেহাত্মবাদী। তাঁর লেখায় শরাব, সাকী ইত্যাদির প্রতি অগাধ প্রীতি দেখে সেটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু ইতিহাসবিদরা বলেছেন ভিন্ন কথা। ব্যক্তিজীবনে খৈয়াম শারাব পান করতেন না। সে সময়কার মোল্লারা তাঁর লেখার কারণে তাঁকে অপছন্দ করত ঠিকই, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মদ পানের অভিযোগ আনতে পারেনি। কবি মদ খেতেন না, আর তাঁর কোনো সাকীও ছিল না। সবই তার কল্পনা, অনেকের মতে রূপকার্থে এসবের অর্থ আলাদা কিছু। খৈয়ামের শরাব আসলে সত্যিকারের শরাব নয়। পৃথিবীতে আনন্দের প্রতীক হিসেবে রূপকার্থে তিনি শরাব বলেছেন। আর সাকী বলতে বুঝিয়েছেন সেই গুরু বা মুর্শিদকে, যিনি সেই শরাব বা আনন্দ দেন।
প্রমাণ হাজির করতে না পারলেও ইংরেজ লেখক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড ও অধ্যাপক কাউয়েল ওমরকে দেহাত্মবাদী বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, বস্তুবাদী ওমর যে শরাবের কথা বলেছেন তা দ্রাক্ষারস, আর তাঁর সাকিও রক্ত-মাংসের।
ফারসি রুবাইর গঠন পদ্ধতি মেনে ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজ কবি এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড (Edward F. Fitzgerald) অনূদিত ইংরেজিতে ওমর খৈয়ামের ১১০টি রুবাই।
নজরুল কবির এই শরাব প্রীতি থাকা সত্ত্বেও শরাব পান না করার দিকটিকে তুলনা করেছেন এভাবে :
‘এ যে মরুভূমি-নিম্নে হয়তো বহু নিম্নে কান্নার ফল্গুধারা, ঊর্ধ্বে রৌদ্র-দগ্ধ বালুকার জ্বালা, তীব্র দাহন। ওমর যেন মরুভূমির বুকের খর্জুর-তরু, মরুভূমির খেজুর গাছকে দেখলে যেমন অবাক হতে হয়—ওমরকে দেখেও তেমনি বিস্মিত হই। সারা দেহে কণ্টকের জ্বালা, ঊর্ধ্বে রৌদ্রতপ্ত আকাশ, নিম্নে আতপ-তপ্ত বালুকা—তারি মাঝে এত রস সে পায় কেমন করে?’
আরেক জায়গায় নজরুল লিখেছেন :
“...এর নামেই এত নেশা, পান করলে না জানি কি হয়, হয়তো-বা ওমর খৈয়ামই হয়। অবশ্য আমরা খেলে’ এই রকম বখামি করি, ওমর খেলে রুবাইয়াৎ লেখেন।”
শঠতা, কূপমণ্ডূকতা, মিথ্যা, পরাধীনতা, বিধিনিষেধের বেড়াজাল ছিন্ন করার দৃপ্ত বাণী যেন ওমরের রুবাইয়াতে।
নজরুলের ভাষায়, ‘ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সমতালে—ভণ্ডামি, মিথ্যা বিশ্বাস, সংস্কার, বিধিনিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে।’
লোকছন্দ বা স্বরবৃত্ত ছন্দে ওমর খৈয়ামের কাব্যের ভাব ও মিল বিন্যাস অক্ষত রেখে কাজী নজরুল ইসলাম রুবাইয়াৎগুলোকে আগাগোড়া ক-ক, খ-ক ছন্দ শৈলীতে অনুবাদ করেছেন। ফার্সি ভাষায় নজরুলের দক্ষতা ভালো থাকায় মূল ভাবের পাশাপাশি ফার্সি মেজাজটাও পাওয়া যায় তাঁর অনুবাদে।
নজরুল নিজের অনুবাদ সম্পর্কে বলেছেন :
“আমি আমার ওস্তাদি দেখাবার জন্য ওমর খৈয়ামের ভাব ভাষা বা স্টাইলকে বিকৃত করিনি—অবশ্য আমার সাধ্যমত। এর জন্য আমার অজস্র পরিশ্রম করতে হয়েছে, বেগ পেতে হয়েছে। কাগজ-পেন্সিলের, যাকে বলে আদ্যশ্রাদ্ধ, তা-ই করে ছেড়েছি। ওমরের রুবাইয়াতের সবচেয়ে বড় জিনিস ওর প্রকাশের ভঙ্গি বা ঢং। ওমর আগাগোড়া মাতালের ‘পোজ’ নিয়ে তাঁর রুবাইয়াৎ লিখে গেছেন—মাতালের মতোই ভাষা, ভাব, ভঙ্গি, শ্লেষ, রসিকতা, হাসি, কান্না—সব। কত বৎসর ধরে কত বিভিন্ন সময়ে তিনি এই কবিতাগুলি লিখেছেন, অথচ এর স্টাইল সম্বন্ধে কখনো এতটুকু চেতনা হারাননি। মনে হয় এক দিনের বসে লেখা। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি—ওমরের সেই ঢঙ্টির মর্যাদা রাখতে, তাঁর প্রকাশভঙ্গিকে যতটা পারি কায়দায় আনতে। কতদূর সফল হয়েছি, তা ফার্সি-নবিশরাই বলবেন।
“...সেই উচ্চৈঃশ্রবা আমার হাতে পড়ে হয়ত—বা বজদ্দি মোড়লের ঘোড়া-ই হয়ে উঠেছে—আমাদের গ্রামের কাছে এক জমিদার ছিলেন, তাঁর নাম বজদ্দি মোড়ল। তাঁর এক বাগ-না-মানা ঘোড়া ছিল, সে জাতে অশ্ব হলেও গুণে অশ্বতর ছিল। তিনি যদি মনে করতেন পশ্চিম দিকে যাবেন, ঘোড়া যেত পূর্ব দিকে। ঘোড়াকে কিছুতেই বাগ মানাতে না পেরে শেষে বলতেন—‘আচ্ছা চল্, এদিকেও আমার জমিদারি আছে।
“ওমরের বোর্রাক বা উচ্চৈঃশ্রবাকে আমার মতো আনাড়ি, সওয়ার যে বাগ মানাতে পারবে, সে ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে ওই বজদ্দি মোড়লের মতো সে ঘোড়াকে তার ইচ্ছামত পথেও যেতে দিইনি। লাগাম কষে প্রাণপণ বাধা দিয়েছি, যাতে সে অন্য পথে না যায়। অবশ্য মাঝে মাঝে পড়ব-পড়ব অবস্থায়ও যে হয়েছে, তা স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই। তবে এটুকু জোর করে বলতে পারি, তাঁর ঘোড়া আমার হাতে পড়ে চতুষ্পদী ভেড়া-ও হয়ে যায়নি—প্রাণহীন চার-পায়াও হয়নি। আমি ন্যাজ মলে মলে ওর অন্তত তেজটুকু নষ্ট করিনি।”
যা হোক, ওমর খৈয়ামকে বলা হতো সে সময়কালে ইরানের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মানুষ। তাঁর অনেকগুলো রুবাই আমার খুব ভাল লেগেছে। সেগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটা পাঠকদের জন্য দিলাম।
১.
যোগ্য হাতে জ্ঞানীর কাছে ন্যস্ত কর এই জীবন,
নির্বোধদের কাছ থেকে ভাই থাকবে তফাত দশ যোজন!
জ্ঞানী হাকিম বিষ যদি দেয় বরং তাহাই করবে পান,
সুধাও যদি দেয় আনাড়ি—করবে তাহা বিসর্জন!
২.
স্রষ্টা মোরে করল সৃজন জাহান্নাম জ্বলতে সে,
কিংবা স্বর্গে করবে চালান—তাই বা পারে বলতে কে!
করব না ত্যাগ সেই লোভে এই শারাব সাকি দিলরুবা,
নগদার এ ব্যবসা খুইয়ে ধারে স্বর্গ কিনবে কে?
৩.
ঘুমিয়ে কেন জীবন কাটাস? কইল ঋষি স্বপ্নে মোর,
আনন্দ-গুল প্রস্ফুটিত করতে পারে ঘুম কি তোর?
ঘুম মৃত্যুর যমজ ভ্রাতা, তার সাথে ভাব করিসনে,
ঘুম দিতে ঢের পাবি সময় কররে তোর জনম ভোর।
৪.
মসজিদ মন্দির গির্জায় ইহুদ-খানায় মাদ্রাসায়
রাত্রি দিবস নরক-ভীতি স্বর্গ -সুখের লোভ দেখায়।
ভেদ জানে আর খোঁজ রাখে ভাই খোদার যারা রহস্যের
ভোলে না এই খোশ গল্পের ঘুম-পাড়ানো কল্পনায়।
৫.
প্রেমের চোখে সুন্দর সেই হোক কালো কি গৌর-বরণ,
পরুক ওড়না রেশমি কিংবা পরুক জীর্ণ দীন বসন।
থাকুক শুয়ে ধুলোয় সে কি থাকুক সোনার পালঙ্কে,
নরকে সে গেলেও প্রেমিক করবে সেথায় অন্বেষণ।
৬.
মসজিদ আর নামাজ রোজার থামাও থামাও গুণ গাওয়া,
যাও গিয়ে খুব শারাব পিও, যেমন করেই যাক পাওয়া!
খৈয়াম, তুই পান করে যা, তোর ধূলিতে কোন একদিন
তৈরি হবে পেয়ালা, কুঁজো, গাগরি গেলাস মদ-খাওয়া।
৭.
জ্ঞান যদি তোর থাকে কিছু—জ্ঞানহারা হ সত্যিকার,
পান করে নে শাশ্বতী সে সাকির পাত্রে সুরার সার!
সেয়ান—জ্ঞানী! তোর তরে নয় গভীর আত্মবিস্মৃতি,
সব বোকারা জ্ঞান লভে না সত্যিকারের জ্ঞানহারার।