বইয়ের কথা
মৌলানার ভালোবাসা
অরণ্য আপন প্রতিভাবান নবীন কবি। ছোট একটা হৃদয়কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। পারস্যের বলখ্ নগরের কবি জালাল উদ্দিন রুমির বাছাই প্রবাদপ্রতিম কবিতার তরজমা করেছেন। রুমির অসংখ্য কবিতার তুলনায় আপনকৃত তরজমার পরিমাণ নিতান্তই কম। তবুও রুমির অন্তর্গত জগৎ ও কবি-বৈশিষ্ট্যের একচিলতে রূপ আপনের অনুবাদে দর্শন করা যাবে। রুমি ফার্সি ভাষার বাণী প্রধান কবি। অতি সাধারণ কথাও রুমির জবানে চিরন্তনী কাব্য হয়ে ওঠে। সরল পাঠে মনে হতে পারে—সহজ বাক্য। রুমির সহজ বাক্যের গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায়—রূপ রহস্যের জ্ঞান কত দিব্য জ্যোতিতে ভরা। কতভাবে দেখা যায় বস্তুর বাইরের ভাবজগৎকে।
মহাত্মা জালাল উদ্দিন রুমি বেঁচে থাকলে বয়স গড়াত ৮১২ বছরে। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে কারো কবিতা আট শতাব্দী পর সাধারণ পাঠকের পড়ার নজির এক পারলৌকিক বিরল ঘটনা। নিজের সময়কাল তো নিতান্তই কম, রুমির অত্যাশ্চর্য ভবিষ্যৎমুখী ভাব আজও আমাদের সময়কে সমাচ্ছন্ন করে রেখেছে। রুমি তাঁর দেশ ও ভাষার সীমা মাড়িয়ে অপর ভাষায়ও সমধিক জনপ্রিয়। এত বছর পরও রুমির চিন্তা আর লেখার আবেদন একটুও কমেনি; বরং দিন দিন মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও সংবেদনার নতুন আয়নায় হাজির হচ্ছেন রুমির কবিতা। বর্তমানের নিত্য বস্তুভাব ডিঙিয়ে রুমির কবিতা এখন অনিত্য দর্শনের মরমি শ্লোক।
‘রুমি’ তাঁর আদিনাম নয়। আদিনাম জালাল উদ্দিন। তবে রুম প্রদেশের সন্তান হিসেবে ‘রুমি’ নামডাক উৎসারিত। আদি সভ্যতার যুগে জন্মস্থানকে নামের উপাধিরূপে উপযোগ করা হতো। রুমি নামায়নের উপাধিও তাই। এমনকি তাঁর আব্বার নামের ‘বলখ্’ উপাধিও একই সিলসিলায়। বালকবেলায় সন্তানের অনন্য প্রতিভা দেখে স্নেহসুলভ পিতা রুমিকে ডাকতেন ‘মৌলানা’ সম্বোধনে। মৌলানা শব্দের প্রায় তিরিশের অধিক ভাবার্থ। কিন্তু রুমির আব্বা মাছুম সন্তানকে ‘পণ্ডিত’ বা ‘জ্ঞানী’ অর্থে মৌলানা সম্বোধন করতেন। জালাল উদ্দিন রুমির আব্বা বাহাউদ্দিন বলখ্ও গ্রন্থাকার ছিলেন। পিতার প্রভাবে রুমির চিন্তা বিকশিত হয়। জ্ঞানতাপস শেখ ফরিদউদ্দিন আত্তার আর শামসির তাবরিজ রুমির দুই অনন্য গুরু।
রুমি পাঠ সব সময় নতুন। যদিও অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে নানা মুনির নানা মত। যত মত থাকুক না কেন—অনুবাদ অপর ভাষার সাহিত্যকে আপন ভাষায় নব-রূপান্তর ঘটায়। ফলে অন্য ভাষার সাহিত্য বাংলা ভাষায় নব দীপ্তি পায়। দুটো আলাদা ভাষা আর ভাবের যত দূরত্ব থাকুক না কেন—মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, সংবেদনশীল মন আর চিন্তার নৈকট্যের বিশেষ রূপ আছে। তাই অনুবাদে অপর ভাষার সাহিত্য রস আপন ভাষায় উৎপাদনে অর্থ খুব ব্যাহত হয় না। অনুবাদ হচ্ছে ভাবের লীলার বদল। এক ভাষার ধ্যান হতে অন্য ভাষায় ধ্যানান্তরিত হওয়া। বাংলাভাষার ঐশ্বর্য এখানেই—অন্য ভাষার চিন্তাকে নিজ অন্দরে ভাব আর রসে ঠাঁই করে নেওয়া। প্রশ্ন হচ্ছে—আপনের অনুবাদকৃত রুমির কবিতায় কি আছে?
আপন রুমির অনূদিত বইয়ের নাম দিয়েছে ‘আত্মার দরোজা’। বইয়ে অনেক আলোক আর পরলোক ভাবের ভেতর তিন টুকরো ভাব টুকে নিচ্ছি আমরা। প্রথম ভাব—নিত্য বস্তুর ভেতর থেকে ভাব তুলে আনা। জগৎ বস্তুময়, কিন্তু ভাব ছাড়া বস্তুর আপন ভাষা নাই। দ্বিতীয় ভাব—অনিত্য সংসারে প্রেম বিনে সবই তুচ্ছ। প্রেম অধরা, তাই অধরাকে ধরবার উপায় মাত্র আত্মার দরোজা খুলে দেওয়া। তৃতীয় ভাব—হৃদয়ে ভালোবাসা গ্রহণ করো হিসাব-নিকাশ ছাড়া। ভালোবাসায় যুক্তি অসাড়। কেননা যুক্তির পথ সীমাবদ্ধ, অনন্ত নয়। অনন্ত প্রেম বা ভালোবাসা ভোগের নয়, অনাবিল খোদায় মশগুল।
রুমির কবিতা নিয়ে অনেক তত্ত্ব ফাঁদা সম্ভব। ছোট্ট পরিসরে কবিতা নিয়ে কম বলা বেহতর। পাঠক, রুমির কবিতা পড়ে ইহ আর পারলৌকিক আনন্দ পাবেন—এটা নিশ্চিত। রুমির এক কাহিনী বলে ইতি টানব। পারস্য দেশের দুঃখ-জ্বরা, ব্যথিত-তাপিত, দগ্ধ-নিপীড়িত মানুষজন রুমির শিষ্যাদর্শ গ্রহণ করতেন। একবার কুনিয়ার শাহ পরোয়ানা রুমির শিষ্যদের দৈন্যদশার জন্য বক্রোক্তি করেছিলেন। জবাবে মৌলানা রুমি বলেছিলেন, তারা পতিত বলেই আমার কাছে আসেন। কিন্তু যাদের সদ্গতি আছে, তাদের তো চালকের দরকার নাই। রুমির ভাবাদর্শের মাহাত্ম্য এখানেই।
শেষাবধি বলতে হয়—‘আত্মার দরোজা’ বইয়ে কবি আপনের দৌলতে মেলাদিন পর রুমির কবিতা পড়ার অবসর পেলাম। আনন্দ পেলাম। ভাববার অবকাশ পেলাম। বাণীহীন সময়ে আপনের অনূদিত রুমির কবিতা পড়ে যারপরনাই আমোদিত। পাঠক আপনারা মৌলানার ভালোবাসায় আমোদিত হন। হৃদয়ের দরোজা প্রসারিত হোক। আহা শান্তি। আহা কবিতা।