মেঘে ঢাকা তারা আর্টেমিসিয়া জেন্টিলিস্কি
১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে একজন আত্মবিশ্বাসী, সাহসী শিল্পী যিনি লৈঙ্গিক পরিচয়ে একজন নারী ছিলেন, তাঁর আত্মপরিচয়ের উপসংহার টানতে গিয়ে, একটি চিঠিতে লিখেছিলেন—‘আমার নারী আত্মায় যেন সিজারের প্রাণশক্তি’। ইতালিয়ান বারোক শৈলীর অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী আর্টেমিসিয়া জেন্টিলিস্কি ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই, রোমে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ধারণা করা হয় ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে, নেপলসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর মৃত্যুর কারণটি আজও একটি রহস্যাবৃত ঘটনা। অধিকন্তু অনেক গবেষক মনে করেন, শিল্পকলার জগতের দৃশ্যপট থেকে সবার অলক্ষে তিনি হঠাৎ করেই হারিয়ে গিয়েছিলেন। আবার অনেকে ধারণা করেন, সেই সময় নেপলসে, যে প্লেগ মহামারী দেখা গিয়েছিল, তিনি তার শিকার হয়েছিলেন। শিল্পী আর্টেমিসিয়ার জন্ম সাল নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে, অনেকের ধারণা তিনি ১৫৯৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেনি, বরং আরো দশ বছর আগেই তাঁর জন্ম হয়েছিল।
এই নান্দনিক শিল্পী সম্পর্কে শিল্পকলার ইতিহাসে কোনো তথ্য সহজলভ্য ছিল না। শিল্পী ও শিল্পকলার ইতিহাসের জগতে অনেকটা সময় তাঁর কোনো অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল না। তাঁকে কোনো শিল্পকলার ইতিহাসবিদ মর্যাদাসহকারে তাদের লেখনীতে স্থান দেননি, স্থান দেননি তাদের আলোচনাতেও। যে কোনো সাধারণ বারোক শিল্পীদের সমকক্ষ বলে ধরা হতো তাঁকে এবং সেভাবেই মূল্যায়ন করা হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসের একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আমরা জানতে পারি তাঁর সম্পর্কে। শিল্পী আর্টেমিসিয়া সেই নক্ষত্রের নাম যা অনেক বছর ধরে মেঘের আড়ালে লুকানো ছিল। শিল্পকলার জগতে তাঁকে পৃথকভাবে কেউ চিনতে পারেনি, বিশ্বের মানুষ তাঁর সৃজনশীলতার খোঁজও পায়নি, কিন্তু এমন উজ্জ্বল নক্ষত্রকে মেঘ দিয়ে আড়াল করে রাখা সম্ভব নয় কোনোদিন। তাই আর্টেমিসিয়া আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শিল্পপ্রেমীরা তাঁকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন, সাধারণ কোনো নক্ষত্র রূপে নয় বরং উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, সূর্যরূপে।
শিল্পী আর্টেমিসিয়ার জন্ম এমন একটা সময় যখন ইউরোপে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। সবকিছু আধুনিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। ধর্ম, রাজনীতি বা সামাজিক অবকাঠামোতে পরিবর্তনের জোয়ার আসা শুরু হয়েছে। ঠিক সেই সময়টিতেই ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) ব্যক্ত করেছিলেন—‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমার অস্তিত্ব আছে’। মানুষ চিন্তা করতে শুরু করে, শুরু করে প্রশ্ন করতে। সমসাময়িক সময়ে ইতালিয়ান বারোক শৈলীর চর্চা করছেন এমন শিল্পীরা সারা ইউরোপ মাতাচ্ছেন। এবং প্রসিদ্ধ শিল্পীরা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য। যেমন বারোক শিল্পী বার্নিনি (১৫০৮-১৬৮০), বারোমিনি (১৫৯৯-১৬৬৭), কারাচ্চি (১৫৬০-১৬০৯) কারাভাজ্জিও (১৫৭৩-১৬১০), পুশ্যাঁ (১৫৯৪-১৬৬৫), হলস (১৫৮০-১৬৬৬), রুবেন্স (১৫৭৭-১৬৪০), ভেলাযকায (১৫৯৯-১৬৬০), রেনি (১৫৭৫-১৬৪২), ক্লদ লরেইন ( ১৬০০-৮২), রেম্ব্রাঁ (১৬০৬-৬৯), ভারমিয়ের (১৬৩২-৭৫), সবাই ছিলেন শিল্পী আর্টেমিসিয়ার সমসাময়িক এবং বর্তমান সময়ে, সকলের কাছে সমাদৃত ও সুপরিচিত। শুধুমাত্র শিল্পী আর্টেমিসিয়া ব্যতীত।
শিল্পী আর্টেমিসিয়ার সৃষ্টি আজ তাঁকে দিয়েছে স্বাতন্ত্র্য এবং অনেক ক্ষেত্রেই তিনি স্বকীয় ও স্বাধীন। তিনি আমাদের কাছে অজ্ঞাত থাকলেও তাঁর সমসাময়িকদের কাছে ছিলেন বিশেষ পরিচিত এবং সমাজের নানা গুণী মানুষদের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। সমসাময়িক সময়ে গ্যালিলেও সহসমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর পত্র যোগাযোগ ছিল।
আর্টেমিসিয়ার প্রথম স্বাক্ষতির চিত্রকলা, সুজানা অ্যান্ড দি এল্ডার্স, ১৬১০, ক্যানভাসে তৈলরং।
সতেরোশ শতাব্দীর সেই রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় যখন নারীদের পেশা নির্বাচনে ছিল সীমাবদ্ধতা। পিতা ওরাজিও জেন্টিলিস্কি (১৫৬৩-১৬৩৯) তাঁর কন্যাকে প্রায়ই তাগাদা দিতেন একজন খ্রিস্টান ধর্ম যাজিকা হওয়ার জন্য। কিন্তু খুব অল্প বয়স থেকেই কন্যা পিতার মতো শিল্পী হবেন বলে মনোস্থির করেন। যখন তাঁর চারপাশে চলছে তাঁর সহশিল্পীদের সফলতার জয়জয়কার, ঠিক সেই সময় আর্টেমিসিয়া, তাঁর ব্যক্তিগত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন একজন কন্যা হিসেবে, একজন নারী হিসেবে, একজন প্রেমিকা হিসেবে, একজন স্ত্রী হিসেবে, একজন মা হিসেবে সর্বোপরি একজন শিল্পী হিসেবে। তিনি নিজেকে একজন শিল্পীর পরিচয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি নারীবাদীও ছিলেন না কিংবা কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের, তাঁর রক্তে শিল্পকলা বহমান ছিল।
আর্টেমিসিয়া নিজেকে কখনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরিস্থিতির শিকার বলে মনে করেননি। তিনি সারাজীবন একজন পুরুষের মতোই কাজ করে গেছেন নিজস্ব, একান্ত প্রাণশক্তির জোরে। তিনি তাঁর কন্যাকেও শিল্পকলার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। নিয়তি কখনো সদয় হয়নি শিল্পীদের জীবনের প্রতি, আর্টেমিসিয়া তাঁর কন্যাকে হারান যখন তার কন্যার বয়স ছিল মাত্র বারো বছর। এদিকে আরো অতীতে, ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে, সন্তান দানকালে তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন, তখন তাঁর নিজের বয়সও ছিল মাত্র বারো বছর। নিরুপায় হয়ে তাকে তাঁর মায়ের স্থানটি নিতে হয়েছিল সংসারে। ছোট্ট ভাইদের নিজের সন্তানের মতো প্রতিপালন করা ছাড়াও তাঁর আরো অনেক দায়িত্ব ছিল। সেগুলোর মধ্যে শিল্পকলার প্রশিক্ষণ নেওয়াটা ছিল তাঁর সব থেকে প্রিয়।
আর্টেমিসিয়া একজন সুন্দরী নারী হিসেবে বেড়ে উঠছিলেন। পিতা ছিলেন ম্যানারিজম শৈলীর সমাপ্তির দিকের শিল্পী এবং কারাভাজ্জিওর চিত্রশৈলীর যোগ্য উত্তরসূরি। পিতার কাছ থেকে আর্টেমিসিয়া পেয়েছিলেন শিল্পকলার শিক্ষা। ওরাজিও তাঁকে শিখিয়েছিলেন কারাভাজ্জিওর সব কৌশল, অঙ্কনশৈলী, পদ্ধতি, বিন্যাস, চিত্রের ভারসাম্যতা রক্ষা করা, রং তৈরি এবং রঙের মিশ্রণ পদ্ধতি, পরিশেষে চিত্রে শেষ প্রলেপ দেয়া বা বার্নিশ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নিজ দক্ষতা দেখানো শুরু করেন, সৃষ্টি করেন নিজস্ব শৈলী এবং পিতার সুনাম অতিক্রম করতে থাকেন । এমনকি বিশেষ পরিস্থিতিতে ওরাজিও নিজেকে আর্টেমিসিয়ার সহযোগী হিসাবে নিজের পরিচয় দিতেন। তাঁর আরো তিনটি পুত্রসন্তান থাকলেও, তারা কেউই আর্টেমিসিয়ার মতো প্রতিভাবান ছিল না।
আর্টেমিসিয়ার এই অর্জন অবশ্যই সহজ ছিল না। তিনে শিল্পকলার ইতিহাসের প্রথম নারী শিল্পী যিনি তাঁর কাজের মাধ্যেমে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং পরবর্তীকালে নিজেকে সফল পেশাগত চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হন। সেই সময় অন্য নারী শিল্পীরা উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসতেন শিল্পকলার জগতে। তাদের সামাজিক অবস্থানটি সহায়ক হতো তাদের প্রতিভার সহজ প্রসার ঘটাতে এবং শিল্পকলাকে তারা শৌখিন শখ হিসেবে খুব নির্ভারভাবে চর্চা করতেন, পেশা হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে অবশ্যই না। নারীবাদীরা তাঁকে যেভাবে দেখাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন যে তিনি একজন আক্রম্য নারী, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ব্যাভিচারের শিকার। আর্টেমিসিয়া নিজেকে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হিসেবে দেখেননি। তিনি নিজেকে লৈঙ্গিক পরিচয়ের সংকীর্ণতায় আবদ্ধ রাখেননি। তিনি নিজেকে প্রথাবিরোধী মানুষরূপে দেখেছেন।
আর্টেমিসিয়ার আঁকা মাদার এ্যান্ড চাইল্ড, ১৬১২।
শিল্পকলায় সে সময় নারী শিল্পীদের পদচারণা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে কম, তার কারণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থানে নারীদের অবাধ যাতায়াত ছিল নিষিদ্ধ। তাদের অনুমতি ছিল না ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রেও। সে কারণে শিল্পীর স্বামী এই কাজগুলো করতেন তাঁর সহকারী হিসেবে। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে, আর্টেমিসিয়ার বয়স যখন ২৩ বছর তখন তিনি ফ্লোরেন্সের (একাডেমিয়া ডেল ডিজেগনো) একাডেমি অব দি আর্টস অব ড্রইংয়ের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তিনিই ছিলেন প্রথম নারী শিল্পী যিনি এই সম্মানে ভূষিত হন এবং সে কারণে তিনি একজন পুরুষের সমান যোগ্যতা ও স্বাধীনতা অর্জন করেন। এর পরে স্বাধীনভাবে নিজস্ব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারতেন। তাঁর যাত্রায় কোনো বাধা ছিল না বলে স্বামীকে মুক্তি দেন ও জীবনে এগিয়ে যান তাঁর সন্তানেদের নিয়ে। কোনো কোনো শিল্পকলার ইতিহাসবিদরা বলেন আর্টেমিসিয়া ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা নারী, তাই কোনো পুরুষের সঙ্গে তাঁর এক ছাদের নীচে বসবাস করা ও একই সঙ্গে শিল্পচর্চা করা ঠিক সম্ভব ছিল না। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডন রাফোকে চিঠিতে জানান, ‘আমি মহামান্য লর্ডকে দেখিয়ে দেবো একজন নারী কী করতে পারে।’
আধুনিক সময়ে ১৯৭০ সালে নারীবাদী শিল্পকলার ইতিহাসবিদ লিন্ডা নচলিন লেখার মাধ্যমে আর্টেমিসিয়া বিশ্বের সবার নজরে আসেন, এখন পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত প্রদর্শনশালাগুলোতে তাঁর চিত্রকর্ম স্থায়ীভাবে স্থান পেয়েছে। তিনি দুটো কারণে আজ সবার কাছে পরিচিত। এক: তাঁর শিল্পকর্ম এবং দুই: তাঁর ধর্ষণের জন্য যে বিচারকার্য পরিচালিত হয়েছিল, সেই ইতিহাসের জন্য। ওরাজিও শিল্পী আর্টেমিসিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শিল্পী অগোস্টিনো টাসি (১৫৭৮-১৬৪৪)’র সঙ্গে। ওরাজিওর আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে টাসির ছিল অবাধ চলাফেরা এবং টাসি ওরাজিওকে অনেক ধরনের কাজের সুযোগ এনে দিতো। ওরাজিও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়াতে তিনি টাসিকে বেশ সমীহ করে চলতেন। অন্যদিকে আর্টেমিসিয়ার মায়ের মৃত্যুর কারণে ওরাজিও, বাড়ির উপরের ঘরে এক নারীকে ভাড়া দেন, তার নাম ছিল টুজিয়া।
যেদিন আর্টেমিসিয়া টাসির আক্রমণ ও ধর্ষণের শিকার হন, তখন টাসির সঙ্গে আরো একজন পুরুষ সঙ্গী উপস্থিত ছিল । কিশোরী আর্টেমিসিয়া টুজিয়ার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে থাকেন কিন্তু, টুজিয়া ইচ্ছা করেই তাঁকে অবজ্ঞা করে। এবং টাসি তার অভিসন্ধি পরিপূর্ণ করে এবং এই ব্যভিচার চলতে থাকে আরো বেশ কয়েক মাস। তবে এতে আর্টেমিসিয়ারও কিছুটা সম্মতি ছিল। অবশেষে ওরাজিও টাসিকে অনুরোধ জানায় তাঁর কন্যাকে যেন সামাজিক মর্যাদা দেয়, টাসি সেটা করেননি বিধায় ওরাজিও টাসির বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা নেন। প্রায় দীর্ঘ সাত মাস ধরে চলতে থাকে সেই আইনি লড়াই। আজো সেটা লিপিবদ্ধ করা আছে দলিলে, ধর্ষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়, যে বিষয়টি বেশ দুর্লভ। শেষ পযর্ন্ত এই আইনি লড়াইয়ে আর্টেমিসিয়ার জয় হলে তিনি, নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য পরিশ্রম আরম্ভ করেন, সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র উনিশ বছর।
১৬২১ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর পিতা পিয়েরান্টোনিও স্টিয়াটটেসি নামে একজন সাধারণ শিল্পীর সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ করান। একটি ছোট্ট গোপনীয় পারিবারিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ভয়ে যে, তাঁর কন্যার বিয়ে যেন কেউ না ভেঙে দিতে পারে অতীতের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আর্টেমিসিয়ার স্বামী তাদের সংসার জীবনে, বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেন আর্টেমিসিয়ার জন্য কাজ করে। নিজেকে সফল কোনো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেননি শিল্পী হিসেবে, তবে আর্টেমিসিয়ার প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
আর্টেমিসিয়ার আঁকা জুডিথ স্লাইং হলোফের্নেস (১৬১৪-২০)।
বারোক শিল্পরীতির নারী শিল্পীরা যখন সহজ বিষয়বস্তু নির্বাচন করতেন তাদের শিল্পচর্চার জন্য (যেমন জড় জীবন বা প্রতিকৃতি), তখন আর্টেমিসিয়া ইতিহাস, ধর্ম, পৌরাণিক কাহিনীর মতো জটিল বিষয়বস্তু থেকে চিত্রনির্মাণ করতেন। তিনি বোলানিয়া স্কুলের প্রথাবিরোধী কাজ করতেন। তিনি তাঁর চিত্রকলায় সাহসী, শক্তিশালী, বুদ্ধিমতি নারীদের কথা বলেছেন। তাঁর চিত্রকলায় নারী একাধারে মমতাময়ী মা, অন্যদিকে যুদ্ধংদেহী নারী, দুষ্টু শক্তির হাত থেকে সমাজের নিরীহ মানুষকে মুক্তি দেবার জন্য লড়ছেন। তিনি নিজেকেও দেখিয়েছেন তেমনি শক্তিশালী নারীরূপে। তাঁর সৃষ্টিতে বারবার উঠে এসেছে; বাথশেবা, সুজানা অ্যান্ড এল্ডার্স, ক্লিওপেট্রা, লুক্রেশিয়া, দানায়ে, যুডিথ স্লাইং হলোফের্নেস, ম্যাডোনা এ্যান্ড চাইল্ড, প্রতিকৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলো।
অনেক ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে আঁকা তাঁর মাদার অ্যান্ড চাইল্ড চিত্রটি, তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনার কথা ব্যক্ত করে। তাঁর সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা মনে করে তিনি এমন রক্তাক্ত মাতৃশরীর এঁকেছেন। টাসির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সময়টিতে তিনি তাঁর মাতৃত্বের বিশেষ দিকটির সঙ্গে পরিচিত হন, নিজের ভাইদের দেখাশোনা করবার মাধ্যমে। তারও দু বছর পূর্বে, ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর প্রথম শিল্পকর্মে স্বাক্ষর করেন, যখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র সতেরো বছর, ‘সুজানা অ্যান্ড দি এল্ডার্স’। এই চিত্রের বিন্যাস অত্যন্ত চমৎকার, জটিল এবং পূর্ববর্তী শিল্পীদের থেকে স্পষ্টতই ভিন্ন। এখানে আর্টেমিসিয়া সুজানাকে দেখিয়েছেন বৃদ্ধ মানুষগুলোর থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে এবং সুজানার মধ্যে একটা বিরক্তিবোধ কাজ করছে, অনিহা কাজ করছে। অনেকের মতে আর্টেমিসিয়া তাঁর জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা অভিব্যক্ত করেছেন এই চিত্রের মাধ্যমে। তবে এই চিত্রের মাধ্যমে ভবিষ্যতে তাঁর শিল্পী হওয়ার স্বপ্নটির একটি স্থায়ী মাত্রা পেয়েছে।
আর্টেমিসিয়ার আঁকা ক্লিওপেট্রা, ১৯৩৩-৩৫
‘জুডিথ স্লাইং হলোফের্নেস’ (১৬১৪-২০) তাঁর আঁকা সবথেকে বিখ্যাত চিত্রকলা, স্পষ্টতই আর্টেমিসিয়া টাসির প্রতি তাঁর প্রতিশোধ স্পৃহার যে সুপ্ত বাসনা লালন করেন, সেটিকেই তিনি চিত্রায়িত করেছেন। পূর্ববর্তী শিল্পীরা একই বিষয়বস্তু নিয়ে শিল্প সৃষ্টি করলেও আর্টেমিসিয়ার দক্ষতা কোনো শিল্পসমালোচকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার কথা নয়। বিশেষ করে কারাভাজ্জিওর চিত্রটিতেও রয়েছে অনেক নাটকীয়তা, কৃত্রিমতা এবং অতিরঞ্জন অভিব্যক্তি। কিন্তু আর্টেমিসিয়ার চিত্রে আমরা দেখি সমস্ত ঘটনাটি ঘটছে দর্শকদের সামনে, বিছানাতে রক্তের প্রবাহ, বিছানার চাদর ভেজা রক্তে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কাটবার জন্য ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে, সব কিছুই যেন সত্যিকারের, যা দেখে একজন মানুষের রক্তহীম হয়ে যেতে পারে, এমনই জীবন্ত তাঁর সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্টিগুলোর মধ্যে আত্মপ্রতিকৃতি ছাড়াও অনান্য নারী চরিত্রের চিত্রগুলোতে তিনি নিজেকেই এঁকেছেন বলে চিহ্নিত করলে, অযৌক্তিক হবে না। কারণ, শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে নিজের জীবনের কথাই ব্যক্ত করেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে, আর্টেমিসিয়ার শিল্পকলায় তিনি নিজেকেই এঁকেছেন বারংবার, তাঁর চিত্রকলাগুলো ছিল আত্মজীবনীমূলক।
১৬১৫ থেকে ১৬২০-এর মধ্যে তিনি মাইকেলেঞ্জেলো বুরোনাত্তি দ্য ইয়ঙ্গার (বিখ্যাত শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর ভাইপো) আমন্ত্রণে চিত্রনির্মাণ করেন, আত্মপ্রতিকৃতি এবং জুডিথ স্লাইং হলোফার্নেস, ম্যাগডেলিন এবং আরো অনেক পৌরাণিক নারীচরিত্রের চিত্র নির্মাণ করছিলেন। কারণ সেই সময় তিনিই একমাত্র কারাভাজ্জিওর শৈলীতে পারদর্শী ছিলেন। ওরাজিও ১৯২৬ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের নিকট থেকে নিমন্ত্রণ পান। গ্রিনিচে রানির প্রাসাদের ছাদে, চিত্রাঙ্কনের কাজ পান এবং তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত প্রায় বারো বছর সেখানে কাটান। আর্টেমিসিয়া ওরাজিওর সহযোগিতার জন্য লন্ডনে আসেন, এই সময় তাদের দেখা হয়েছিল প্রায় বিশ বছর পরে। এবং ১৬৩৮ থেকে ৪১, মাত্র এই দুবছর সেখানে অতিবাহিত করেন। তাদের এই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল কারাভাজ্জিওর শৈলী বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়া।
১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে আর্টেমিসিয়ার পিতা ওরাজিও মৃত্যুবরণ করেন। আর্টেমিসিয়ার শিল্পকলাতেও পরিবর্তন আসে ধীরে ধীরে, তিনি পূর্বের সময়ের মতো অতটা ভাবাবেগপূর্ণ চিত্র নির্মাণ করতেন না, তাঁর রঙের ব্যবহারেও আসে নমনীয়তা, গাঢ় রঙের ব্যবহার শুরু করেন, পূর্বে তিনি উজ্জ্বল রং ব্যবহার করতেন। বিষয়বস্তু নির্বাচনেরও আসে পরিবর্তন। শিল্পী মাত্রেই পরিবর্তন, শিল্পী মাত্রেই প্রবহমান সত্তা। শিল্পী আর্টেমিসিয়া ছিলেন ঝর্ণার মতো, যিনি কখনো থেমে থাকেননি, ছিলেন নিয়ত প্রবহমান।
আর্টেমিসিয়া জীবনের শেষ ভাগে আঁকা বাথশেবা, ক্যানভাসে তৈলরং, ১৯৪৫-৫০
আধুনিক নারীবাদী শিল্পী ও শিল্পসমালোচকরা শিল্পী আর্টেমিসিয়াকে যেভাবে উপস্থাপন করাবার চেষ্টা করেছে, মূলত আর্টেমিসিয়া, নিজেকে তেমনভাবে দেখেননি, তার অন্যতম কারণ তাঁর জীবনে পিতার অবদান। আর্টেমিসিয়া ছিলেন একজন অসাধারণ নারী ও মা, তাঁর মধ্যে মাতৃত্ববোধ ছিল অসীম। আর্টেমিসিয়ার মমতায় ক্ষমা করেছেন, তাঁর ধর্ষক টাসিকে। জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রসিদ্ধ করে তিনি তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। পিতার প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল ও নিজের ভাইদের আপন সন্তানের মতো বড় করেছেন। জীবনের এক পর্যায়ে এসে, তাঁর সন্তানদের হারানোর বেদনা বয়ে নিয়ে বেড়ান বাকিটা জীবন। ১৬৫৩ খ্রিস্টব্দের পর থেকে আর্টেমিসিয়ার খোঁজ পাওয়া যায় না, কেউ কেউ মনে করেন শিল্পী আর্টেমিসিয়া ১৬৫৬ সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন, তবে আর্টেমিসিয়া, নেপলস থেকে ডন রাফোকে চিঠি লিখেছিলেন, ১৬৪৯ সালের মার্চ মাসের ১৩ তারিখে, তাতে তিনি বলেছিলে—‘শিল্পকর্মগুলোই একদিন বাঙ্ময় হয়ে উঠবে’। তাঁর কথাই সত্যি হয়েছে; অনেকগুলো বছর পরে, সৃষ্টির আকাশ থেকে মেঘগুলো সরে গেছে। পৃথিবীর মানুষগুলো মেঘের মতো তাঁকে ও তাঁর সৃষ্টিকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল। কিন্তু আর্টেমিসিয়া এমন একজন মানুষ তাকে কেউ পারবে না আচ্ছাদিত করে রাখতে; তিনি ও তাঁর সৃষ্টি সূর্যের মতো উজ্জ্বল, বহু দিনের জমাট বাধা মেঘেগুলোর আড়াল ভেদ করে আজ তাঁর সৃষ্টির রশ্মি ছড়াচ্ছেন সাহসিকতার সঙ্গে।