উদ্বাস্তু
বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মর্মস্পর্শী আখ্যান
‘...এই উপন্যাসে সমাজচেতনার সঙ্গে শিল্পালোকের বিরল মেলবন্ধন ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন। সস্তা জনপ্রিয়তা ও বিমূর্ত নন্দনতাত্ত্বিক বিভ্রান্তির এই সময়ে জীবনঘনিষ্ঠ প্রকৃত শিল্পের উদাহরণ উদ্বাস্তু বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের আশাবাদী করে তোলে।’
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের ‘উদ্বাস্তু’ উপন্যাসটি সম্পর্কে উপরোক্ত কথাগুলো পড়েই মূলত বইটি পড়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠি। কারণ, সস্তা জনপ্রিয়তা ও বিমূর্ত নন্দনতত্ত্ব―এ দুটি বিষয় নিয়ে আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ আছে। একজন প্রকৃত শিল্পী প্রথমে তাঁর শিল্পপ্রকরণ সম্পর্কে পুরোপুরি ক্লিয়ার হয়ে নেন, যেমন হয়েছেন নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর। শিল্পী তো তিনি, সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য যিনি তাঁর শিল্পকে ‘জন’, অর্থাৎ পাঠকের উপযোগী করে তোলেন না, আবার একই সঙ্গে বিমূর্ততার নামে শিল্পকে দুর্বোধ্য করে পাঠকের অনুপযোগী করে তোলেন না। অর্থাৎ তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করবেন, প্রকৃত শিল্পের পথ অবলম্বন করবেন। পৃথিবীর উন্নত দেশ, যেমন—ইউরোপ, আমেরিকার স্থিতিশীল রাষ্ট্রগুলোর কথাই ধরা যাক। সেসব দেশে কলাকৈবল্যবাদ খাটে, কিন্তু বাংলাদেশে খাটে না। কেননা, এ দেশের গণমানুষ এখনো শিল্পের সেই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি। শিল্পের জন্য শিল্প করতে গেলে এ দেশের গণমানুষের কোনো কাজেই আসবে না। আবার গণমানুষের উপযোগী করে তোলার জন্য সাহিত্যকে সংবাদপত্রের সস্তা প্রতিবেদন বানিয়ে ফেললে তা সাহিত্যেরও কোনো কাজে আসবে না। সে ক্ষেত্রে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর সঠিক পথটিই বেছে নিয়েছেন। শিল্প ও সমাজ―দুটোর প্রতিই তিনি দায়বদ্ধ। দুটো ক্ষেত্রেই তাঁর অবস্থান স্পষ্ট। একজন পাঠক হিসেবে এই অবস্থান আমার কাছে বিশেষ ভালো লেগেছে।
কিন্তু যে বইটি নিয়ে এই আলোচনা, তার ‘উদ্বাস্তু’ উপন্যাস, সেই বইটিতে এই ‘সঠিক পথের’ প্রতিফলন কতটা ঘটেছে? আমার মনে হয়, শতভাগ না হলেও ৭০ ভাগ তো ঘটেছেই। উপন্যাসটি রচনায় এমন একটা ভাষাকে তিনি অবলম্বন করেছেন, যা একই সঙ্গে শিল্পসম্মত ও সর্বজনবোধ্য। প্রান্তিক মানুষের আখ্যান রচনা করতে গিয়ে তিনি ভাষার মানকে নিচুতে নামিয়ে আনেননি। যে যা-ই বলুক, সাহিত্যের তো একটা নির্দিষ্ট ভাষা থাকবে। সাহিত্যের ভাষা তো আর দৈনন্দিনতার ভাষা নয়। তার একটা আলাদা গরিমা, আলাদা সৌন্দর্য থাকবেই। আবার উচ্চমার্গের শিল্প রচনা করতে গিয়ে ভাষাকে তিনি জটিলও করে তোলেননি। সাহিত্যের পাঠক হিসেবে আমি দুটি বিষয় গুরুত্ব দিই―ভাষা ও বিষয়। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর দুটি বিষয়ের প্রতিই মোটামুটি প্রতিশ্রুতিশীল, এ কথা বলা যায়।
তাঁর উপন্যাসটির বিষয়ও ব্যতিক্রম। উপন্যাসটি রচনায় তিনি এমন একটা বিষয় নির্বাচন করেছেন, যা একেবারেই অগতানুগতিক। বর্তমান বিশ্বের প্রধান সংকটগুলোর মধ্যে অন্যতম উদ্বাস্তু সংকট। মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের রোহিঙ্গারাও তেমন উদ্বাস্তু। তাদের কোনো দেশ নেই। দেশহীন, ভিটেমাটিহীন, উদ্বাস্তু, উন্মূল একটা জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। জাতিগত বিদ্বেষ আর মিয়ানমারের জান্তা সরকারের তাঁবেদার সামরিক বাহিনীর নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নে নাস্তানাবুদ একটি অসহায় জাতি তারা। আরাকানে মগ-রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য রোহিঙ্গাদের ওপর চলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। বিটিএফ, ইউএমপি, শিউ কাই, নাগাজিন, মাইয়াট মন, সেব, নাগামিন নামের অপারেশন পরিচালিত হয়েছে তাদের উৎখাত করতে। তাদের পূর্বপুরুষের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে মগ-রাখাইনদের। জবরদস্তিমূলক শ্রমদানে বাধ্য করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তাদের যাতায়াতে, বন্ধ করা হয়েছে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাতের আঁধারে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়িঘর। লুণ্ঠন, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা তো চলেছেই। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের উপাসনালয়গুলো। রোহিঙ্গাদের এই জীবন-যন্ত্রণার কথা এখন বিশ্ববাসীর অবগত। এই দমন-পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তারা দলে দলে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে বর্তমানে নানা শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হয়েছে। এই হতভাগ্য রোহিঙ্গারাই নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের উপন্যাসের বিষয়। এমন একটা জটিল বিষয় নিয়ে উপন্যাস রচনা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়। তার আগে কেউ রোহিঙ্গাদের বিষয় করে উপন্যাস লিখেছেন, এমন তথ্য আমার জানা নেই। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরই প্রথম এই হতভাগ্য জাতিটিকে বাংলা সাহিত্যে তুলে আনলেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উপন্যাসগুলো তো গতানুগতিকতায় ঠাসা। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর এর বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। এই কৃতিত্ব একান্তই তাঁর।
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র সোলেমন, যে কি না রোহিঙ্গা এবং উদ্বাস্তু। শৈশবে পরিবার-পরিজন ছেড়ে আর রোহিঙ্গাদের মতো সে চলে আসে বাংলাদেশে। এখানে এসে কাজ পায় জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর প্রতিষ্ঠানে, যে প্রতিষ্ঠান শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ে কাজ করে। নিরন্তর শেকড় খুঁজে ফেরা সোলেমনকে ঘিরেই আবর্তিত হয় উপন্যাসের মূল কাহিনী। তার সঙ্গে যুক্ত হয় আরেক নারী চরিত্র, রুবিনা, যার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয় সোলেমন। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নানা অবস্থার কথা বর্ণনার মধ্যে সোলেমন-রুবিনার প্রসঙ্গটিও মোটামুটি উপভোগ্য হয়ে উঠেছে উপন্যাসে। তবে কোনো অগ্রসর পাঠক যদি সোলেমন-রুবিনার প্রেমকে লেখকের আরোপিত বলে অভিযোগ করেন, সেই অভিযোগ একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। দুজনের সম্পর্কের দিকটা উপন্যাসের কোথাও কোথাও আরোপিত বলেই মনে হয়। উপন্যাসে প্রেম থাকতেই হবে, পাত্রের বিপরীতে পাত্র থাকতেই হবে―এই গতানুগতিক ধারা থেকে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরও বেরোতে পারেননি।
তবে যে বিষয়টি নিয়ে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর উপন্যাসটি লিখছেন, সে বিষয়ে তাঁর ধারণা খুবই স্পষ্ট। একজন ঔপন্যাসিকের জন্য এটা খুবই জরুরি। যে বিষয়ে লিখবেন, ঔপন্যাসিককে আগে সে বিষয়ে স্পষ্ট হতে হয়। সংশয় থাকলে উপন্যাসেও তার ছাপ পড়ে। উদ্বাস্তুতে তেমন কোনো ছাপ পড়েনি। উপন্যাসটি পড়ার সময়ে পাঠকের মনে হবে না, উপন্যাসের বিষয় সম্পর্কে লেখকের জানাশোনার পরিধি কম। হয়তো নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর দীর্ঘদিন রোহিঙ্গাদের সংস্পর্শে ছিলেন। থাকার ফলে রোহিঙ্গাদের নানা সংস্কার, তাদের জীবনের নানা খুঁটিনাটি, বাংলাদেশে তাদের অবস্থা এবং অবস্থান, তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গেই ধরতে পেরেছেন এবং তা শৈল্পিকভাবে উপন্যাসে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
‘উদ্বাস্তু’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। আমি যথাসাধ্য বাংলাদেশের উপন্যাসের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু অজানা কারণে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের এই উপন্যাসের কথা আমার অজানাই ছিল। আমি যখন ২০১১ সালে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ‘বেগানা’ লিখছিলাম, তখন খুব খোঁজখবর নিচ্ছিলাম এ বিষয়ে ইতোপূর্বে আর কোনো উপন্যাস লেখা হয়েছে কি না। ‘উদ্বাস্তু’র হদিস তখন পাইনি। পেলে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমারও খুব উপকার হতো।
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। ২০১০ সালে এটির সংশোধিত মুদ্রণও প্রকাশিত হয়েছে। আশা করি, এটির আরো মুদ্রণ হবে। একটি জাতিগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে জানার জন্য উপন্যাসটি খুবই তথ্যবহুল। শিল্পরুচিসম্পন্ন পাঠকও উপন্যাসটি পড়ে হতাশ হবেন না বলেই মনে করি।