বই আলোচনা
এক মানবিক আবেগের কথন ‘সব ফুল কোথায় গেছে’
‘সব ফুল কোথায় গেছে? পিতার পত্র, পুত্রকে’ বইটা পড়ার সময় আরেকটা বইয়ের নাম মাথায় উঁকি দেয়। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ সালের মাঝে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু চিঠি লিখেছিলেন তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে।
নেহরু পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আর তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬টি চিঠিপত্রের সংকলন পর প্রকাশিত হয় ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’ নামে। আধুনিক ভারতের তথা আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম দুই চরিত্রের মাঝে যে পত্র বিনিময় (বিনিময় শব্দটা ঠিক যুতসই হলো না, কারণ বইয়ের সব চিঠিই নেহরু লিখিত) তা থেকে তাদের মনোজগতের কিছু খবরাখবর আন্দাজ করা যায়।
অসামান্য প্রজ্ঞাবান পণ্ডিত নেহরু জেলে বসে কোনো রেফারেন্স ছাড়াই নিজ কন্যাকে ধারাবাহিকভাবে বলে চলেছেন খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সাল থেকে মানব সভ্যতার ইতিহাস। এই চিঠি পড়লে হবু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার প্রস্তুতি পর্বটা বুঝতে সুবিধা হয়।
‘সব ফুল কোথায় গেছে? পিতার পত্র, পুত্রকে’-এর সাথে ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’ বইয়ের মিল বলতে উত্তরসূরির কাছে পূর্বসূরির লেখা চিঠি এটুকুই। একজন প্রধানমন্ত্রীত্বের পাঠ নিচ্ছেন, আরেকজন মানবিক আবেগের পাঠ দিচ্ছেন।
৩১টি চিঠিতে আসমার ওসমান নিজের ছেলেকে বিবৃত করেছেন মানবিক আবেগ- অনুভূতিতে পূর্ণ নানা বিষয়। বেশির ভাগ চিঠি আমাদের আশপাশে ঘটে চলা নানা বিষয় নিয়ে। আমাদের যাপিত জীবন কৃত্রিম ব্যস্ততায় সচেতনে, অচেতনে, অবচেতনে যা উপেক্ষা করে চলে, লেখকের কলমে উদ্ধৃত হয় সেই সব কথা।
নিজের শৈশব-কৈশোরের সাথে সন্তানের শৈশবের তুলনা করে আপাত হতাশায় নিমজ্জিত হন লেখক। আবার আশাবাদী হন তাঁর সন্তান তথা এই প্রজন্মের ওপরই। চিঠিতে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, বই, উৎসবসহ নানা বিষয়।
এই সময়ে শপিং মলে বইয়ের দুষ্প্রাপ্যতার কথা এসেছে। লেখক আইন করে দিতে চান সব শপিংমলে বাধ্যতামূলক বইয়ের দোকান করে দিতে। লেখকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, হুমায়ূন আহমেদ বিষয়ক আলোচনা এসেছে লেখার গতিতেই।
এসেছে রাজনীতি। এসেছে কয়েক দশক আগে অনন্য সাধারণ সামাজিকতার ছবি। পাড়া সংস্কৃতি, বিজয় দিবসের নাটক, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ফুটবল টুর্নামেন্ট, এক বাড়ির বাচ্চা অন্য বাড়িতে গিয়ে ভাত ঘুম দেওয়া, শীতের সময় কারো বাড়িতে ঝাল ঝাল হাঁসের মাংস রান্না হলেই পাশের বাড়িতে তশতরি দিয়ে ঢেকে পাঠানো- এসব কিছু সাম্প্রতিক অ্যাপার্টমেন্ট কালচারে ধুয়ে-মুছে সাফ।
জড়বৎ এক সামাজিকতায় সন্তানের বড় হওয়া দেখে লেখক আরো বেশি করে ডুবে যান নিজের সময়ে। অক্ষম হতাশার উদগিরণ ঘটে কলমে।
মানবিক আবেগের পাশাপাশি গত শতাব্দীর ৭০-এর দশক থেকে শুরু করে এই শতাব্দীর শুরুতেও আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বাস্তবতা উঠে এসেছে বিভিন্ন চিঠিতে। ঘটনা যাই হোক, লেখকের চাওয়া পরিষ্কার। মানবিক এক পৃথিবীতে নিজের সন্তানকে দেখতে চান তিনি।
নেহরুর চিঠিতে যেমন পরিষ্কার, তিনি তাঁর মেয়েকে ভবিষ্যৎ ঝানু রাজনীতিবিদ হওয়ার পূর্বপ্রস্তুতির মালমসলা জোগাচ্ছেন, আসমার ওসমানের চিঠিতে পরিষ্কার তিনি তাঁর সন্তানকে পাঠ দিচ্ছেন সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হওয়ার। একজন প্রকৃত মানুষ।
১৬ থেকে ৮৬ যেকোনো বয়সের মানুষের জন্য ১১২ পৃষ্ঠার একটি সুখপাঠ্য বই। বয়স্করা ডুবে যেতে পারেন নিজেদের সময়ে বা প্রৌঢ়ত্বে, আর নবীনদের জন্য হতে পারে পূর্বসূরিদের সময় ও বর্তমানের প্রত্যাশা উপলব্ধির এক পাঠ।
মোবাইল প্রযুক্তি আসার পর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বিনিময় হয় না বললেই চলে। চিঠিপত্র নিয়ে সাহিত্য রচনা বা বই প্রকাশের নতুন উপাদান ব্যবহারিকভাবে সৃষ্টি হচ্ছে না। বিষয়বৈচিত্রে ব্যতিক্রমী এই বই আলাদা মনোযোগের দাবি রাখে।
বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখা আছে জঙ্গি হামলায় নিহত প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের নাম। দীর্ঘদিনের পরিচিত বন্ধুসম প্রকাশকের প্রয়াণ লেখককে কতটা বিদ্ধ করেছে তা সাত লাইনের উৎসর্গপত্রে স্পষ্ট।
নিজেদের প্রয়োজনে যেসব লেখক ফয়সল আরেফিন দীপন ও তাঁর ‘জাগৃতি প্রকাশনী’কে পাশে পেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ নিজের প্রয়োজনে অন্য ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। যাঁরা নেননি তাঁদের একজন লেখক আসমার ওসমান। তাঁর কলম থেকেই এমন মানবিক আবেগের কথন বেশি মানায়।
বই সংক্ষেপ
বইয়ের নাম - সব ফুল কোথায় গেছে? পিতার পত্র, পুত্রকে
লেখক - আসমার ওসমান
প্রকাশক - ফয়সল আরেফিন দীপন, জাগৃতি প্রকাশনী
প্রচ্ছদ - সুমন এবং চিন্ময় দেবর্ষি
প্রকাশকাল - অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬
মূল্য - ২১০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা - ১১২