ঢাকার কথা ৪০
বুড়িগঙ্গা নদী ও বাকল্যান্ড বাঁধ
পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাচীন সভ্যতা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। নদীর পানি ও পলি কৃষি সভ্যতা গড়ে ওঠাকে প্রাণিত করে। তবে বুড়িগঙ্গা নদী কৃষি সভ্যতা নয় ঢাকায় নগরী গড়ে ওঠায় এবং এর অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল করায় ভূমিকা রেখেছিল। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের অনেকটা সময় পর্যন্ত সড়ক পথের বিকাশ এই অঞ্চলে তেমনভাবে ঘটেনি। তাই নৌপথই ছিল সাধারণ পরিবহন ও মালামাল পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। যে কারণে প্রায় সমান্তরালভাবে বয়ে চলা শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী বর্তমান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ প্রাচীন কাল থেকেই একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে নিজের অবস্থানকে নিশ্চিত করে।
চৌদ্দ শতকের প্রথমার্ধে সোনারগাঁওকে কেন্দ্র করে স্বাধীন সুলতানি বাংলার যাত্রা শুরু এবং পরে পুরো অঞ্চলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার প্রতিষ্ঠা ভৌগোলিক কারণেই ঢাকার গৌরবকে নির্দিষ্ট করে দেয়। বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ প্রশাসনিক প্রয়োজনে বাংলাকে দুটো প্রদেশে বা ফারসি লেখকদের উচ্চারণে ‘ইকলিমে’ বিভক্ত করেন। এর একটি ইকলিম মুয়াজ্জমাবাদ আর অপরটি ইকলিম মোবারকাবাদ। পনের শতকের মাঝ পর্বে বাংলার সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের সময় ইকলিম মোবারকাবাদের রাজধানী যে আজকের ঢাকায় ছিল তা শিলালিপির সাক্ষ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই গুরুত্ব অর্জনের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদীর ভূমিকা ছিল।
সাভারের দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী থেকে উৎসারিত হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদী। তারপর ঢাকা শহরের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুন্সীগঞ্জের সাথে মিশেছে। তাই ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গার ধারা ধরে একদিকে যেমন উত্তরে ধলেশ্বরী হয়ে যমুনা ও পদ্মার সাথে মিলিত হওয়া সম্ভব, তেমনি দক্ষিণে ধলেশ্বরীর অপর ধারার সাথে মিলিত হয়ে পদ্মা ও মেঘনার সাথে সম্পর্ক তৈরি করাও সম্ভব ছিল। এই সম্ভাবনার জায়গাটি মোগল ঢাকার প্রশাসকরা ব্যবহার করতে পেরেছেন। স্থানীয় ও বহির্বাণিজ্যে বুড়িগঙ্গা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই সুবিধা ইংরেজ শাসনযুগেও অব্যাহত থাকে।
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকার নগর কমিশনার ছিলেন সি টি বাকল্যান্ড। তিনি নগর সুরক্ষা, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা সুগম করা এবং নৈসর্গিক শোভা বর্ধনের জন্য বুড়িগঙ্গার তীর ধরে কিছুটা অংশে বাঁধ দেওয়ার চিন্তা করেন। প্রাথমিকভাবে বাঁধের পরিধি ঠিক করা হয় নর্থব্রুক হল ঘাট থেকে ওয়াইজ ঘাট পর্যন্ত। কিন্তু সংকট হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনের ভাণ্ডারে অত টাকা নেই। তাই ঠিক করা হলো জনসাধারণের চাঁদায় এই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। প্রথমেই অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলেন ঢাকার জমিদার নবাব খাজা আবদুল গনি এবং ভাওয়াল জমিদার কালীনারায়ণ রায়।
এ ছাড়া ঢাকার অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেন। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তা অপ্রতুল ছিল। তাই বাকল্যান্ড সাহেব সরকারের কাছেও অর্থ সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। এক পর্যায়ে অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে বাঁধ পূর্ব ও পশ্চিমে আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়। মি. বাকল্যান্ডের উদ্যোগে নির্মিত হওয়ায় বাঁধটি পরিচিতি পায় ‘বাকল্যান্ড বাঁধ নামে’।
বাকল্যান্ড বাঁধ নির্মাণে ভেতরের দিকে পাথর ও উপরের দিকে ইট ব্যবহার করা হয়েছিল। বর্তমান সদরঘাট এলাকাটিতে ঘাস ও গাছ রোপন করে বাঁধটি সবুজ এবং নয়নাভিরাম করা হয় এবং তা একটি পার্কে রূপ পায়। বাঁধের পরিকল্পনাটি এমন ছিল যে পানির দিকের অংশের শোভা বাড়ানো ও পেছনের দিক গাছ বুনে প্রকৃতিক শোভা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে বাঁধটি যেন নগরবাসীর আনন্দ ভ্রমণে ভূমিকা রাখতে পারে। তা ছাড়াও বাঁধ নির্মিত হলে নদীর তীর ক্ষয় হওয়া ও বন্যায় তীর ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। এতেকরে মাল ও যাত্রীবাহী লঞ্চ এবং জাহাজ ভেড়ানোতে কোনো সংকট তৈরি হবে না।
প্রাথমিক ধাপের বাঁধ নির্মাণের পর ১৮৭০ সালে বাঁধের সম্প্রসারণের দায়িত্ব নেন খাজা আবদুল গনি এবং বাবু রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। আবদুল গনি পশ্চিম দিক দিয়ে সম্প্রসারণ করেন এবং রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস সম্প্রসারণ করেন পূর্ব দিকে। এভাবে বাঁধের পরিধি দাঁড়ায় দেড় কিলোমিটার।
পরবর্তী সময়ে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি এই বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল।