চিকিৎসার কথা বলে দুই মেয়ের টাকা ভাগাভাগি, সেলিমের জীবন কাটে বৃদ্ধাশ্রমে
মো. সেলিম। বয়স প্রায় ৮০ বছর। চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় তাঁর বাড়ি। তিনি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতেন। তাঁর স্ত্রী হেলথ কেয়ারে চাকরি করতেন। দুই কন্যাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন পার করছেন তিনি। মেয়েদের পড়াশুনা করিয়ে বিয়ে দেন। চট্টগ্রাম সিটি কপোরেশনে তাদের চাকরিও হয়। এরপর ২৫ বছর চাকরি শেষে ২০১২ সালে অবসরে যান সেলিম। এর দুই বছর পর ২০১৪ সালে স্ত্রী মারা যান। এরপর প্রায় নিঃস্ব হয়ে একাকিত্ব জীবন যাপন করতে থাকেন সেলিম। এরমধ্যে স্ট্রোক করে শরীরের এক অংশ প্যারালাইসড হয়ে যায়। তখনি বের হয়ে আসতে থাকে দুই মেয়ের আসল রূপ। অসহায় বাবার জমানো অর্থের প্রতি লোভ পড়ে দুই মেয়ের। অতি আদরে লালন করা সেই দুই মেয়ে ভারতে নিয়ে চিকিৎসার কথা বলে বাবার সঞ্চয় করা ২০ লাখ টাকা ভাগাভাগি করে নেন। শিক্ষকতা জীবনের জমানো সকল অর্থ নিয়ে আর বাবার খোঁজ নেয়নি দুই মেয়ে। বাসায় একা একা অনাহারে থাকতে থাকতে হামাগুড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের বায়জিদ বোস্তামির মাজারের সামনে অবস্থান হয় তাঁর। ভবঘুরে অবস্থায় মাজারে সামনে ফুটপাথে বসতেন। লোকজন রাস্তায় খাবার দিয়ে যেতো। ২০১৭ সালে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে রাজধানীর চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার সেন্টারের লোকজন তাকে নিয়ে আসে। এ স্থানটি এখন তাঁর আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে তিনি আর সন্তানদের হাতে হাত রেখে যেতে পারেন না ঈদের কেনাকাটা করতে। বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালের মাঝে মুখ লুকিয়ে নিরবে ফেলেন চোখের পানি। তবুও প্রার্থনায় রেখেছেন সন্তানদের। এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক মিল্টন সমাদ্দারই এখন তাঁর সুশিক্ষিত সন্তান।
রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকার পাইকপাড়ায় চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার সেন্টারে গিয়ে এনটিভি অনলাইনের সাথে এসব কথা বলেন মো. সেলিম।
শুধু মো. সেলিম নয়, এখানে তাঁর মতো অনেকেই রয়েছেন। গুলশানের বাসিন্দা মোস্তাক আহমেদ টিপু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে বেসরকারি একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে বিএসএসি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। একটি দুর্ঘটনায় শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যায়। এক সময় সন্তানরা খাওয়ার কথা বলে হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে লোকজনের মাধ্যমে তাঁর ঠাঁই হয় এই বৃদ্ধাশ্রমে।
এভাবে পরিবারহীন বাবা-মায়ের সংখ্যা এখানে ১৩০ জন। তাদের সবার ঈদ কাটবে পরিবারহীন। যাদের অনেককে কুড়িয়ে আনা হয়েছে রাস্তা থেকে। বৃদ্ধাশ্রমের বদ্ধ চার দেওয়ালের মাঝে প্রিয় সন্তানের জন্য মুখ লুকিয়ে নিরবে ফেলছেন চোখের অশ্রু। সেই সন্তানদের ছাড়া বৃদ্ধাশ্রমে যত্নে থাকলেও ভালো নেই তাঁরা। বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্ব জীবন কেটে যাচ্ছে তাদের। সন্তানদের জন্য বাবা-মায়ের বুক ফেটে গেলেও পাচ্ছেন না তাদের কোনো ছোঁয়া। এই বাবা-মায়ের ঈদের আনন্দটাই যেন তাদের সন্তানবিহীন বৃদ্ধাশ্রমকে ঘিরে। অসহায় এই বাবা-মায়েরা নিজের অসহায়ত্বকে মেনে নিয়ে থাকতে চান জীবনের শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে। আবার অনেকে সব অভিমান ভুলে ফিরে যেতে চান সন্তানদের কাছে। বৃদ্ধাশ্রমের কয়েকজন বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের জীবনের কষ্ট-দুঃখের কথা। তারই একজন আফরোজা বেগম (৭২)।
সালেমা আমজাদ (৭৫) এর জন্ম যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে পড়ালেখা বেড়ে ওঠা সবটাই ওই শহরে। পরে বিয়ে, চার সন্তানের জননী হওয়া; সেও ওই লন্ডনে। জীবনের দীর্ঘসময় স্বামী আর চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দময় জীবন কাটিয়েছেন সালেমা।
কিন্তু জীবন চিরকাল একই রকম থাকেনি সালেমার জন্য। সন্তানরা ক্রমে বড় হয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে একপর্যায়ে খুব ভালো ভালো কাজের সুযোগ পান। চাকরিবাকরি, সংসার, সন্তানসহ নিজেদের মতো গুছিয়ে ফেলেন যার যার জীবন। শুধু তাদের কারো পরিবারেই জায়গা হয়নি বয়স্ক মা সালেমার। ছেলেমেয়ে সবার কাছেই তিনি থেকে গেছেন উপেক্ষিত। একপর্যায়ে ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে লন্ডনের উন্নত জীবন ছেড়ে শূন্যহাতে চলে আসেন বাংলাদেশে বাবার জন্মভিটা খুলনায়। সেখানেও খুঁজে পাননি কোনো স্বজন। শেষমেশ ফরিদপুরের এক সাংবাদিকের সহায়তায় ঠাঁই হয় রাজধানীর কল্যাণপুরের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার সেন্টারে।
সন্তানদের কথা মনে পড়ে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি জানি তাঁদের কথা মনে হলেও আমার কোনো লাভ নেই। এ জন্য মনে করতে চাই না।’ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মিল্টন সমাদ্দারকেই এখন নিজের সন্তান বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমার পাঁচ সন্তান ছিল। আমি আমার চার ছেলে মেয়ের কাছে স্থান না পেয়ে বড় ছেলের কাছে চলে এসেছি। আমাকে এখান থেকে কেউ নিতে পারবে না। আর আমিও আমার বড় ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এখানেই থাকতে চাই। এখানে থেকেই আমি মরতে চাই।’
‘যত দিন বাঁচব এখানেই থাকব, এটাই আমার ঠিকানা। সন্তানদের কাছে আমি আর ফিরে যেতে চাই না। তাঁরা আমার খবর নেবে, এটা আমি আর আশাও করি না। যখন তাঁদের সামনে ছিলাম, তখনই তাঁরা আমার খোঁজখবর নেয়নি। সরকারি সহায়তা নিয়েই আমাকে লন্ডনে চলতে হয়েছে। আমি চলে আসায় তারা হয়তো বেঁচে গেছে।’
শরিফা বেগমকে (৮০) কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এক অত্মীয়ের বাসায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় আসার পর তাকে ফেলে যায় রাস্তায়। স্থানীয় লোকজন বৃদ্ধাশ্রমে খবর দিলে, তাদের লোকজন গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসে। এখন তিনি পরিবারের কথা ভুলে গেছেন। ভালো করে কোনো কথা বলতে পারেন না। আরেক অসহায় বৃদ্ধ মা মমতা বেগম বয়সের ছাপে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন, হাজারবার বাবারে বাবারে করি, সারা দেয় না। কখনও মা বলে ডাকও দেয় না আমারে। এখন এই পরিবার নিয়েই আমার যত সুখ-শান্তি। মন ভেঙে গেলেও এখানে এদের নিয়ে ঈদ করতে হবে।
রাজধানীর কল্যাণপুর দক্ষিণ পাইকপাড়ার চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার বলেন, বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মায়ের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এখন মোট ১৩০ জন বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। অসহায় প্রতিবন্ধী এতিম শিশু আছে ৩০ জন। করোনাকালে প্রতিদিনই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ফেলে যাওয়ার খবর আসে।