হিলিতে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা, নেই নিরাময় কেন্দ্র
দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী হিলি মাদকপ্রবণ এলাকা। এখানে দিনদিন মাদবসেবীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি সংঘঠিত হচ্ছে ছোট-বড় নানা অপরাধও।
সীমান্তবর্তী এ এলাকায় নেই কোনো মাদক নিরাময় কেন্দ্র। ফলে বিভিন্ন মাদকে আসক্তরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এদিকে, গত বছর আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রীসভার বৈঠকে সরকারি হাসপাতালে মাদকসেবীদের চিকিৎসা দেওয়া জন্য শয্যা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত হলেও এখানে তা আজও কার্যকর করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিলির সঙ্গে প্রায় সাত কিলোমিটার ভারত সীমান্ত রয়েছে। আর ভৌগোলিক কারণে এই দুই দেশের সীমান্তগুলি গ্রাম ঘেঁষে হওয়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের চোখ আড়াল করে এবং রাতের আঁধারে খুব সহজেই ভারত থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচার করা হচ্ছে।
হিলি সীমান্তে ছোট-ছোট গ্রুপে গড়ে উঠা মাদক চোরাকারবারীরা প্রায় প্রতিদিন সুকৌশলে দেশে ভারতীয় মাদক পাচার করে আনছে। যার মধ্যে রয়েছে, ফেনসিডিল, ইয়াবা, মদ, গাঁজা, হেরোইন ও প্যাথেডিন ইনজেকশন।
হিলির স্থানীয় বাসিন্দা ইনামুল হক, আব্দুল করিম ও সাজ্জাদ হোসেন জানান, খুব সহজলভ্য হওয়ায় হিলিতে মাদকের বিস্তার রোধ করা কঠিন। কারণ সীমান্ত এলাকা হওয়ায় মূলত স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হয় না। বর্তমানে এখানে ভালো পরিবারের ছেলে, শিক্ষার্থী, ভবঘুরেসহ অন্তত সাত-আট শতাধিক মাদকাসক্ত রয়েছে।
মধ্য বাসুদেবপুর গ্রামের হাসনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত। ভালো করার জন্য অনেকবার জেল-হাজতেও দিয়েছি। কিন্তু কেনো কাজ হয়নি। হিলিতে মাদক নিরাময় কেন্দ্র থাকলে তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে আনা যেত। নেশার টাকা না পেলে আমাকে, ছেলে-মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। খুব ভয়ে ভয়ে সংসারে থাকি।’
চণ্ডিপুরের তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘নেশাগ্রস্ত ছেলে টাকার জন্য বাড়ির জিনিসপত্র চুরি করে। বাড়িতে কখনো সুযোগ না পেলে অন্য মানুষের এটা-ওটা চুরি করে। অনেকে তাঁকে মারধরও করে। কিছুতেই সে নেশা ছাড়তে পারে না। তার কারণে আমাদের পরিবার আজ সর্বশান্ত। বেশ কয়েকবার জেলেও গেছে। কিন্তু জেল থেকে ফিরে সেই একই অবস্থা।’
দক্ষিণ বাসুদেবপুর গ্রামের ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার ছোট ভাই বাড়িতে সঙ্গীদের ডেকে এনে নেশা করে। বাধা দিতে গেলে আমাদের শারীরিক নির্যাতন করে। চাকু, দা নিয়ে আমাদের মেরে ফেলার জন্য তেড়ে আসে। তার অত্যাচারে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। বাইরে কোথাও মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করাতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। আমরা গরিব, এতো টাকা পাব কোথায়?’
হাকিমপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের মাদকের সহজলভ্যতার কারণে হাকিমপুরের হিলি মাদকপ্রবণ এলাকা হিসাবে পরিচিত। এখানে মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশের দুটি প্রজন্ম ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এসব মাদকসেবীদের প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু খুব একটা ফল পাওয়া যায়নি। এমনকি মারমুখি এসব মাদকসেবীদের নিয়ে মাঝে-মধ্যে পুলিশকে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়। কিন্তু এখানে কোনো মাদক নিরাময় কেন্দ্র নেই। এই বিষয়টি নিয়ে হাকিমপুর উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভায় প্রস্তাব নেওয়া হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখানে ৩০ শয্যার একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছে। মাদক নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও সরকারি হাসপাতালে শয্যা আলাদা রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে মাদকসেবীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাসহ সামগ্রিক আইনশৃঙ্খার উন্নতি হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দিনাজপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটির চতুর্থ বৈঠকে মাদকের অপব্যবহার রোধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো এবং সরকারি হাসপাতালে মাদকসেবীদের চিকিৎসার জন্য শয্যা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়েও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হিলি সীমান্ত ও মাদকপ্রবণ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এখানে মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌহিদ আল হাসান বলেন, ‘উপজেলা সরকারি হাসপাতালে মাদকসেবীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য শয্যা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে দেখব। কখনো কোনো মাদকসেবী চিকিৎসার জন্য এলে আমরা তাদের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এখানকার চিত্রটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো আছে।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ নূর এ আলম বলেন, ‘বেসরকারিভাবে এখানে মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনেককে বলা হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ উদ্যোগ নিলে সহযোগিতা করা হবে। প্রায় সময় অনেকে তাদের পরিবারের মাদকসেবীদের আমার কার্যালয়ে নিয়ে আসেন তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া জন্য। এখানে যাতে মাদক নির্মুল করা যায়, সেই লক্ষ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে।’