একটি রুটি হাতে রাস্তায় বসিয়ে চলে গেছে ছেলে!
সাত বছর আগের একদিন। রাজধানীর খামারবাড়ী মোড়। ছেলের সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়েছেন জোসনা বেগম। তাঁকে একটি রুটি কিনে দিয়ে রাস্তায় অপেক্ষা করতে বলে চলে যায় ছেলে। সেই যে গেল আর এলো না।
এরপর ছেলের অপেক্ষায় কাঁদতে কাঁদতে জোসনা বেগমের পাঁচ বছর কেটেছে রাস্তায়। বছর দুয়েক আগে হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে রাস্তায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে ছিলেন। লোকজনের কাছে খবর পেয়ে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় ঢাকার উত্তরখানের আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম। গত দুই বছর ধরে সেখানেই আছেন তিনি। তবে এখনো অপেক্ষা করছেন ছেলের। ছেলের বয়সী কাউকে দেখলেই বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি।
জোসনা বেগমের বয়স আনুমানিক ৮০ বছর। জীবনের বেশির ভাগ সময় স্বামী, সংসার আর সন্তান নিয়ে পার করলেও শেষ বয়সে এখন তাঁর ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম।
আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সৈয়দা সেলিনা শেলী এনটিভি অনলাইনকে জানান, জোসনা বেগমকে তাঁরা দুই বছর আগে খামারবাড়ী মোড় থেকে নিয়ে আসেন। পাঁচ বছর রাস্তায় থাকার কারণে তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে অনেক ঘা হয়েছিল, মাথার চুল ছিল বালুভর্তি। আপন নিবাসে নিয়ে আসার পর তাঁর চিকিৎসা করানো হয়। কেটে দেওয়া হয় মাথার চুলও।
জোসনা বেগম যখন প্রথম আসেন, তখন তেমন কোনো কথা বলতে পারছিলেন না জানিয়ে সেলিনা শেলী বলেন, কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে তিনি জানান, তাঁর ছেলের নাম জসিম। সে একটা ছোট রুটি দিয়ে জোসনা বেগমকে রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তখন থেকে ছেলের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন জোসনা বেগম।
ছয় মাস আগে ধানমণ্ডির ৬ নম্বর রাস্তায় বসে কাঁদছিলেন রাবেয়া বেগম (৮০)। স্থানীয় একটি সংগঠনের সদস্যরা তাঁর পরিচয় জানার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তাঁকে নিয়ে যায় আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে। সেই থেকে তিনি সেখানকার বাসিন্দা। তবে এখানেও বেশির ভাগ সময় চিৎকার করে কান্নাকাটি করেন তিনি।
বৃদ্ধাশ্রমের পরিচর্যাকারী উম্মে কুলসুম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এখানে আসার পর থেকে সব সময় নিজের পরিবার আর সন্তানদের জন্য চিৎকার করে কান্নাকাটি করেন রাবেয়া বেগম। কিন্তু তিনি নিজের নাম ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেন না।
আপন নিবাসের আরেক বাসিন্দা মরিয়ম বেগম (৭৮)। তাঁর ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে। মরিয়ম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যখন তখন যেখানে সেখানে প্রস্রাব-পায়খানা করে ফেলেন। তা ছাড়া তাঁর চিকিৎসার খরচ চালানোও কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই ছেলেমেয়েরাই তাঁকে রেখে গেছেন আপন নিবাসে।
বৃদ্ধাশ্রমে কে দিয়ে গেছে জানতে চাইলে মরিয়ম বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার বড় পোলা রাইখা গেছে।’
শুধু এরাই নন। মানসিক প্রতিবন্ধী বেশ কয়েকজন বৃদ্ধাও আছেন এখানে। এঁদের একজন শামসুন্নাহার। বয়স আনুমানিক ৭০ বছর। গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলায়। বড় মেয়ে তাঁকে এখানে রেখে গেছেন। তিনি মাঝে মধ্যে ঢাকায় এসে শামসুন্নাহারকে দেখে যান।
ঈদে বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করে না? জানতে চাইলে শামসুন্নাহার মুচকি হেসে শুধু তাকিয়ে থাকেন।
মানসিক সমস্যা আছে আরেকজনের, তাঁর নাম রাবেয়া। যাঁকে সামনে পান তাঁকেই প্রশ্ন করেন, ‘সেলিমের বাড়ি কোন দিকে? কোন রাস্তা দিয়ে যাব?’
রাবেয়া সম্পর্কে সৈয়দা সেলিনা শেলী বলেন, তাঁর মানসিক সমস্যা রয়েছে, সে কারণে বিয়ের এক মাস পরেই সংসার ভেঙে যায়। এর পর থেকে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। রাজধানীর বনানীর একটি পার্ক থেকে রাবেয়াকে আপন নিবাসে নিয়ে আসা হয় বলেও জানান শেলী।
সব মিলিয়ে ২৫ জন বৃদ্ধা রয়েছেন আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের স্বামী-সন্তান এবং ঘরছাড়া। এঁদের কাউকে রাস্তা থেকে তুলে এনে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এখানে, কাউকে নিজের ছেলেমেয়েরাই এসে রেখে গেছে, কাউকে আবার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দিয়ে গেছে।
আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম
আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রম সম্পর্কে সৈয়দা সেলিনা শেলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি এই আশ্রম পরিকল্পিতভাবে করিনি। মানবাধিকার সংগঠন কর্মজীবী নারীর সঙ্গে কাজ করতাম। আমি নারীর অধিকার, মর্যাদা নিয়ে যে সমস্যা তা নিয়ে কাজ করতাম। এই কাজের সুবাদে ২০ বা ৩০ বছর আগে যেসব অসহায় নারীকে নিয়ে কাজ করেছি, তাঁরা যখন বুড়ো হয়েছেন তখন তাঁরা বলেন, আমাদের আপনি অধিকারের কথা, ন্যায়নীতির কথা শিখিয়েছেন। কিন্তু এখন এই বয়সে পরিবারে আমাদের সন্তান থাকলেও ভাত দেয় না, আমরা পরিবারে জায়গা পাচ্ছি না, আমরা যাব কই। আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দেন।’
এরপর সাতজন বৃদ্ধাকে নিয়ে প্রথমে নিজের বাড়িতে রাখেন শেলী। নিজের চাকরির টাকায় তাঁদের ভরণ-পোষণ চালাতেন। কিন্তু কয়েক বছর পর এসব নিয়ে তাঁর পরিবারে সমস্যা শুরু হয়। আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই বিষয়টি পছন্দ করেননি। তাঁরা বলতেন, ঘরের মধ্যে এতগুলো মানুষ, তাদের জন্য রান্না করা সব মিলিয়ে নাকি শেলীর বাড়ি হোটেলের মতো মনে হতো।
এরপর সেলিনা শেলী এই বৃদ্ধাদের রাখার জন্য একটি ভাড়া বাড়ি খুঁজতে শুরু করেন। ছয় মাস খোঁজার পরেও কোনো বাড়ি পাননি। কোনো বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিতে চাইতেন না। কারণ বয়স্ক নারীরা প্রস্রাব-পায়খানা করবেন, কফ-থুতু ফেলবেন। হয়তো তাঁদের বাসা নষ্ট হয়ে যাবে।
এখন যে ভবনে আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম, সেটি আসলে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল বলে জানান সৈয়দা সেলিনা শেলী। রাস্তা ছিল না, বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। এমনকি পানির ব্যবস্থাও ছিল না। তারপরেও অল্প কিছু টাকা ভাড়া দিয়ে ওই সাতজন মানুষকে নিয়ে ২০১০ সালে এই বাড়িতে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘সে সময় তাদের তিন বেলা ঠিকমতো খাবার দিতে পারি নাই। এ সময় উত্তরা এলাকার রুবি বেগম নামের একজন নারী আমাকে ব্যাপক সাহায্য করেছেন এবং এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছেন। আমি আমার গহনা বিক্রি করেছি, শাড়ি বিক্রি করেছি শুধু তাদের খাবার জোগাড় করতে।’
২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এখানে কর্মচারীর সংখ্যা পাঁচজন। বাকিরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সামান্য কিছু অনুদানের টাকা দিয়েই চলছে বৃদ্ধাশ্রমটির কার্যক্রম।
আপন নিবাসে সকালে বাসিন্দাদের নাশতা দেওয়া হয়। এরপর সকাল ১০টার সময় ভাত, দুপুরে ভাত এবং রাতে ভাত দেওয়া হয়। এ ছাড়া কোনো কোনো দিন তাঁদের জন্য বিকেলে হালকা নাশতার ব্যবস্থাও করা থাকে।
সৈয়দা সেলিনা শেলী আরো জানান, কিছু দিন আগে ফেসবুকে আপন নিবাস নিয়ে একটি পোস্ট দেওয়ার ফলে তরুণ ছেলেমেয়েরাও আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনেকে এখানে খাবার নিয়ে এসে নিজের হাতে বৃদ্ধাদের খাইয়ে যান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সেলিনা শেলী জানান, তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই তাঁদের। আপাতত মাথা গোঁজার জন্য স্থায়ী একটি জমি পেলেই খুশি তাঁরা। যেন সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেন বৃদ্ধ মায়েরা। সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও যেন নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন তাঁরা। আর এ জন্য সমাজের সচ্ছল ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। আর কিছু না হলেও একবেলা খাবার দিয়ে সাহায্য করতে আহ্বান জানান তিনি।
সবশেষে শেলী বলেন, ‘বাংলাদেশের কোথাও যদি এমন কোনো মা থাকেন যার নিরাপদ আশ্রয় নেই, সেই খবরটা আমাদের ফোন করে জানালে আমরা গিয়ে তাঁদের নিয়ে আসব।’