ভারতের নাগরিকত্ব চান লালমনিরহাটের ৮৯ জন
১৩৬ নম্বর উত্তর গোতামারী ছিটমহল। কাগজে-কলমে এর অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার শিতলকুচি থানা এলাকায়। তবে নিজ দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে ছিটকে পড়ে বাস্তবে এটির অবস্থান লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার মধ্যে। এই উপজেলায় পাশাপাশি থাকা দুটি ভারতীয় ছিটমহলের এটি একটি। এর আয়তন ২০ দশমিক ০৩ একর।
২০১১ সালের যৌথ জনগণনা অনুযায়ী ছিটমহলটির লোকসংখ্যা ছিল ৩৪ জন এবং পরিবার ছিল মাত্র নয়টি। এই ছিটমহলের সাতটি পরিবারের ২১ জন আজ বুধবার দুপুরে যৌথ জরিপকারীদের কাছে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণের ইচ্ছার কথা জানান। ফলে তাঁদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট ফরমে নেওয়া হয় সই। ভারত থেকে আসা জরিপকারীরা তুলে নেন তাঁদের ছবি। আর এটিই ছিল দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ‘অবরুদ্ধ’ থাকা এসব মানুষের ভারতের মূল ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
এদিকে পাটগ্রাম উপজেলার অভ্যন্তরে থাকা ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা ছিটমহলে থাকা আরো ১৫টি পরিবারের ৬৮ জন ভারতীয় নাগরিকত্ব চেয়ে নিবন্ধন করেছেন। ফলে আজ বুধবার বিকেল পর্যন্ত ওই দুটি ছিটমহলের ২২ পরিবারের ৮৯ জন বিভিন্ন বয়সী মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণের ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। যাঁদের সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
আজ বুধবার দুপুরে হাতীবান্ধার ১৩৬ নম্বর গোতামারী ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায়,পুলিশ-বিজিবির নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে কাজ করছেন জরিপকারীরা। আর জরিপকারীদের ঘিরে রয়েছে একদল নারী-পুরুষ যারা সবাই ওই ছিটের বাসিন্দা। এদের একেক জনের কাছে জরিপকারীরা ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বিভিন্ন তথ্য যাচাই করার পাশাপাশি প্রত্যেককে একটি করে প্রশ্ন করছেন-‘আপনি বাংলাদেশে থেকে যাবেন নাকি ভারতে চলে যাবেন।’
এই প্রশ্নের উত্তরে যারা ভারত বলছে তাদের আলাদা ফরমে সই নিয়ে তোলা হচ্ছে ছবি। এই ছবি তোলার মাধ্যমে যেসব মানুষ নিজেদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির সিদ্ধান্ত ঠিক করেছেন সেসব মানুষের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছলতা আর আনন্দ থাকলেও তাঁদের অনেকের মনেই কষ্ট ছিল বাংলাদেশে থাকা মেয়ে-জামাই বা নিকট আত্মীয়দের জন্য।
যেমনটি বলছিলেন সেখানকার বাসিন্দা কানন বালা (৪৫)। তিনি বলেন,‘বাংলাদেশে দুই মেয়ে-জামাই ও নাতি-নাতনি রেখে আমরা চলে যাব। এজন্য খুবই কষ্ট লাগছে। কিন্তু এরপরও আমরা আমাদের মূল ভূখণ্ডে যেতে চাই।’
ওই ছিটমহলের বাসিন্দা বিনোদ চন্দ্র বর্মণ (৫৬) স্ত্রী-সন্তানসহ মোট নয়জনের নাম নিবন্ধন করেছেন ভারতের মূল ভূখণ্ডে ফিরে যাবেন বলে। যুগ যুগ বাংলাদেশে থেকে এখন কেন ফিরে যাচ্ছেন ভারতে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘আমাদের আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই রয়েছে ভারতে। এ ছাড়া শুনেছি সেখানে গেলে রেশন কার্ড,থাকার জায়গাসহ সবকিছু পাব। তাই চলে যাচ্ছি।’
আরেক বাসিন্দা বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৬৫) তিনিসহ তাঁর পরিবারের পাঁচজনের নাম নিবন্ধন করেছেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে এই বৃদ্ধ বলেন,‘আমরা যেহেতু ভারতের নাগরিক তাই আমরা ওই পারেই চলে যাব।’
দুই সন্তানের জননী সন্ধ্যা রানীর বাবার বাড়ি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে হলেও তাঁর বিয়ে হয়েছিল ছিটমহলের বাসিন্দা হৃদয়ের সাথে। তিনিও জরিপ ক্যাম্পে গিয়ে ছবি তুলেছেন। ভারতে যাওয়ার সম্মতি দিয়েছেন। আর ২০১১ সালের পর জন্ম হওয়ায় তাঁর তিন মাস বয়সী মেয়ে সৌরভীর নামও নিবন্ধন করিয়েছেন জরিপকারীদের কাছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘আমার স্বামী যেহেতু ভারতে যাবে তাই আমিও চলে যাব। তবে বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের জন্য মন খারাপ হচ্ছে।’
১৩৬ নম্বর উত্তর গোতামারী ছিটমহলের জরিপদলের সদস্য রোকনুজ্জামান সোহেল জানান,ওই ছিটমহলের সাতটি পরিবারের ২১ জন ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে নিবন্ধন করেছেন।
অন্যদিকে পাটগ্রামের ভেতরে থাকা ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা ছিটমহলের জরিপকারী আতাউর রহমান জানান,আজ এই ছিটমহলের ১৫টি পরিবারের ৬৮ জন ভারতে চলে যাবেন বলে নিবন্ধন করেছেন।