দিনাজপুরে ১৩ শিশুর মৃত্যু নিষিদ্ধ কীটনাশকে, যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা
২০১২ সালে দিনাজপুরে লিচু খেয়ে ১৩ শিশুর মৃত্যু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ওই লিচুতে মিশে ছিল বিষাক্ত কীটনাশক। আর এরই বিষক্রিয়ায় প্রাণ গেছে শিশুদের।
দি আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন-এ গতকাল সোমবার প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে এ তথ্য দেওয়া হয়।
গবেষণায় বলা হয়, এসব লিচু কীটমুক্ত রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক কীটনাশক। এর মধ্যে একটির নাম এনডোসালফান। স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে ওই রাসায়নিক নিষিদ্ধ।
গবেষণায় বলা হয়, মারা যাওয়া শিশুরা ‘অ্যাকিউট এনসেফালাইটিস সিনড্রোমে’ (এইএস) আক্রান্ত হয়। ১০ জন গবেষক বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন। গবেষকরা হলেন, মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, আহমেদ রায়হান শরীফ, হোসেইন এম. এম সাজ্জাদ, এ কে এম দাওলাত খান, মুরশিদ হাসান, শিরিনা আক্তার, মাহমুদুর রহমান, স্টিফেন পি লুবি, জেমস ডি হেফেলফিনগার এবং এমিলি এ গার্লে।
লিচুতে মাখানো ছিল বিষাক্ত রাসায়নিক
দি আমেরিকান সোসাইটি অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়, শিশুদের মৃত্যুর কারণ লিচু ফল তা বলা যাবে না। লিচুতে মেশানো হয় বিষাক্ত রাসায়নিক। যার কারণে লিচুটি বিষাক্ত হয়ে যায়। ওই ঘটনায় ১৪ শিশু এইএসে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ১৩ জনই মারা যায়।
দিনাজপুরে লিচুবাগান থেকেই মারা যাওয়া শিশুরা লিচু সংগ্রহ করে খায়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ফল লিচুগাছের নিচে পড়া ছিল, বা লিচুগাছ থেকেই সরাসরি সংগ্রহ করেছে শিশুরা। এরপর লিচু ফল না ধুয়ে খেয়ে ফেলে শিশুরা। দাঁত ব্যবহার করে লিচুর খোসা ছাড়ায়। এ কারণে বিষাক্ত পদার্থের প্রভাব সরাসরি পড়ে শিশুদের ওপর।
এইএস রোগে আক্রান্ত ওই ১৩ শিশুর মধ্যে যেসব উপসর্গ দেখা যায় তা হলো অচেতন হয়ে পড়া, খিঁচুনি, অতিরিক্ত ঘামতে থাকা, নিস্তেজ হয়ে পড়া। লিচু খেয়েই অসুস্থ হয়ে পড়ে এসব শিশু। আর খাওয়ার আড়াই ঘণ্টার মধ্যে এসব শিশু অচেতন হয়ে পড়ে। অসুস্থ হওয়ার ২০ ঘণ্টার মধ্যে আক্রান্ত শিশুরা মারা যায়।
দাগ সরাতে শ্যাম্পু, পদে পদে রাসায়নিক
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, লিচু ফল যখনই পাকতে শুরু করে, তখনই ব্যবহার করা হয় ছত্রাক নষ্ট করার ওষুধ। এ ছাড়া গাছ বড় হওয়ার সময় ব্যবহার করা হয় পোকা বা কীট মারার ওষুধ। বাগানের লোকজন জানান, লিচু ফলে যেন কোনো দাগ না পড়ে সে জন্য ব্যবহার করা হয় চুলে ব্যবহার করা শ্যাম্পু। এমনকি লিচু যেন উজ্জ্বল রং ধরে রাখে, সে জন্য ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক পদার্থ।
২০১২ সালের ঘটনা জানতে চাইলে বাগানের লোকজন গবেষকদের জানান, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে সারা দেশে পাঁচদিনের ধর্মঘট ছিল। ওই সময়টা লিচু আহরণের সময়। কিন্তু তা তখন করা যায়নি কারণ লিচু বিভিন্ন বাজারে পাঠানোর মতো অবস্থা ছিল না। এ সময়টা যেন লিচু পচে না যায় এ কারণে প্রতিদিন কারবেনডাজিম নামে একটি রাসায়নিক ব্যবহার করেছেন তাঁরা।
আক্রান্ত শিশুদের একজনের মা জানান, তাঁরা লিচুবাগানের পাশেই থাকেন। যখন কীটনাশক বাগানে ছড়ানো হয়, তখন ঘরে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ে।
শিশুরা কেন ঝুঁকিতে
আক্রান্ত শিশু ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শিশুরা লিচুবাগানে যায়। সেখানে কুড়িয়ে পাওয়া লিচু খায়। এ সময় কখনোই তারা লিচুটি পানিতে ধুয়ে নেয় না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এটাই স্বাভাবিক বিষয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, লিচু আহরণের সময় বাগানের লোকজন এবং লিচু ব্যবসায়ীরা শিশুদের ব্যবহার করে। আক্রান্তদের মধ্যে একজন শিশু ওই কাজ করত। একজন বাসিন্দা জানান, আহরণের সময় লিচু ব্যবসায়ীরা শিশুদের ব্যবহার করে। কারণ লিচু গাছগুলো ছোট আর শিশুরা খুব সহজেই গাছে চড়তে পারে। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে শিশুদের দেওয়া হয় নামমাত্র পারিশ্রমিক।