স্বজনের টানে কেউ এপারে, কেউ ওপারে
এক লালমনিরহাট জেলার ভেতরে এতদিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ‘৫৯টি কোচবিহার’। যেগুলোর অবস্থান ছিল প্রতিবেশী দেশটির কাঁটাতারের বেড়ার এপারে, সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। টুকরো টুকরো সেসব ভূখণ্ড নিজেদের মূল ভূখণ্ড থেকে ছিটকে পড়েছিল বাংলাদেশি ভূখণ্ডের ভেতরে। আইনি জটিলতায় এসব জমি যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে মিশে যেতে পারেনি, তেমনি বাস্তবে হতে পারেনি ভারতের।
৬৮ বছর ধরে এসব এলাকার ‘ভারতীয়রা’ কাঁটাতারের বাধায় নিজেদের দেশে যেতে পারেনি। তবে পাকিস্তান আমলে খুব সহজে না পারলেও মুক্তিযুদ্ধের পর অবাধেই যাতায়াত করেছে পুরো বাংলাদেশে। ফলে এ দেশের চাল-ডাল আর আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছে কয়েকটি প্রজন্ম, মিশে গিয়েছিল আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে। এ দেশের স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছে, চিকিৎসা নিয়েছে এ দেশের হাসপাতাল থেকেই। বাংলাদেশে বিস্তৃত হয়েছে স্বজনদের পরিধি। কেবল তাই নয়, কৌশলে বাংলাদেশি পরিচয়ে বেশির ভাগই এ দেশের ভোটার হয়েছিল, দিয়েছিল ভোট।
গত কয়েক বছরে ছিটমহল বিনিময়ের আন্দোলনের অংশ হিসেবে এখানকার বাসিন্দারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, জাতীয় সংগীত গেয়ে পালন করেছে মহান বিজয়-স্বাধীনতা দিবস। ফলে নিজেদের দেশের সঙ্গে যতই কমেছে আত্মার টান, বিপরীতে ততই বেড়েছে এ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক।
আর এ কারণে জেলার ভেতরে থাকা জনমানবশূন্য ১৭টি বাদে বাকি ৪২টি ছিটমহলের প্রায় সবাই বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। গত ৬ থেকে ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত যৌথ জরিপে এ রকম তথ্যই উঠে এসেছে। তবে তাঁদের মধ্যে ১৯৫ জন ব্যক্তি ভারত যেতে চেয়ে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দেশের প্রতি তৈরি হওয়া সম্পর্ক আর আত্মীয়স্বজনের বিস্তৃত আর রুটি-রুজির কারণেই তাঁরা চেয়েছেন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব। অপরদিকে যাঁরা ভারতেই ফিরে যাবেন, তাঁরা মনে করছেন সেখানে গেলে তাঁরা বেশি সরকারি সুযোগ পাবেন, কেউ বলছেন সেখানেই তাঁদের স্বজন বেশি। তবে এসব মানুষের বেশির ভাগই বলছেন তাঁরা ‘এতদিন ভারতীয় ছিলেন তাই ভারতেই চলে যাবেন’।
জেলা প্রশাসনের সূত্রমতে, গত মাসে অনুষ্ঠিত যৌথ জরিপে জেলার তিন উপজেলার জনবসতিপূর্ণ ৪২টি ছিটমহলের মোট লোকসংখ্যা ১০ হাজার ৫৭১ জন। এর মধ্যে মাত্র ১৯৫ জন ভারতীয় নাগরিকত্ব চেয়েছেন। ওই ১৯৫ জনের মধ্যে পাটগ্রামে ১৩৩ জন এবং হাতীবান্ধায় ৬২ জন ব্যক্তি ‘নিজেদের দেশে’ ফিরতে চেয়েছেন। তবে লালমনিরহাটের সদর উপজেলার দুটি ছিটমহলের এক হাজার ৩৬২ জনের মধ্যে কেউই চাননি ভারতীয় নাগরিকত্ব।
ছিটমহল বিনিময়ের ১২ ঘণ্টা আগে গত শুক্রবার দুপুরে হাতীবান্ধার ‘১৩৫ নম্বর উত্তর গোতামারী ছিটমহলের সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ ছকবর আলীর কাছে অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘আশা করেছিলাম যেন মৃত্যুর আগে আমাদের মুক্তি দেখে যেতে পারি। তাই এর চেয়ে আর আনন্দের কিছু হতে পারে না।’
একই এলাকার মহুবর ও রশিদুল নামের দুই যুবক ভারতীয় হতে নাম নিবন্ধন করেছেন। তাঁদের পরিবারের লোকজন জানিয়েছে, দুই যুবক অনেক আগে থেকেই অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে দিল্লিতে কাজ করে। ফলে বাড়ি থেকে গিয়ে এক-দেড় বছর পর ফিরে এসে কিছুদিনের বিরতিতে আবারও ফিরে যায়। যৌথ জরিপের খবর পেয়ে তারা ফিরে এসে যৌথ জরিপকারীদের সামনে হাজির হয়। তবে এর কয়েকদিন পর পরিবারের চাপে বাংলাদেশেই থাকতে পুনরায় নিজেদের আগ্রহের কথা জানায় প্রশাসনকে। তবে শেষ পর্যন্ত ওই দুজনের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে জানা যায়নি। জানতে চাইলে মহুবর বলেন, ‘ভারতে যেতে পারলেই আমার সুবিধা হতো।’ আবার আছির উদ্দিন বলেন, ‘ভারতীয় হিসেবে পরিচিত হলেও আমরা এতদিন বাংলাদেশের চাল-ডাল খেয়ে বেঁচে ছিলাম। তাই এই দেশের নাগরিক হওয়ার জন্য এতটা দিন অপেক্ষা করেছি এবং সেই আশা এখন পূরণ হয়েছে।’
কানন বালা (৪৫) বলেন, ‘বাংলাদেশে দুই মেয়েজামাই ও নাতি-নাতনি রেখে আমরা চলে যাব এ জন্য খুবই কষ্ট লাগছে। কিন্তু এরপরও আমরা আমাদের মূল ভূখণ্ডে যেতে চাই।’
স্ত্রী-সন্তানসহ মোট নয়জনের নাম নিবন্ধন করে ভারত যেতে অপেক্ষায় আছেন বিনোদ চন্দ্র বর্মণ (৫৬)। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বজনদের অনেকেই আছে ভারতে। এ ছাড়া শুনেছি সেখানে গেলে রেশন কার্ড, থাকার জায়গাসহ সবকিছু পাব, তাই চলে যাচ্ছি।’ বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৬৫) তাঁর পরিবারের পাঁচজনের নাম নিবন্ধন করেছেন। বিনয় বলেন, ‘আমরা যেহেতু ভারতের নাগরিক, তাই আমরা ওই পারেই চলে যাব।’ দুই সন্তানের জননী সন্ধ্যা রানীর বাবার বাড়ি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে হলেও তাঁর বিয়ে হয়েছিল ছিটমহলের বাসিন্দা হৃদয়ের সঙ্গে। তাই তিনিও জরিপ ক্যাম্পে গিয়ে ছবি তুলিয়েছেন আর নিজের সম্মতি দিয়েছেন, তিনিও ভারতে যাবেন। তাঁর তিন বছর বয়সী মেয়ে সৌরভীর নামও নিবন্ধন করিয়েছেন জরিপকারীদের কাছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী যেহেতু ভারতে যাবে তাই আমিও চলে যাব। তবে বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের জন্য মন খারাপ হচ্ছে।’ প্রফুল্ল কুমার বলেন, ‘আমরা এবার মুক্তি পেয়েছি, তাই আমাদের নিজের দেশ ভারতেই ফিরে যাব।’
আবদুস সাত্তার (৬০) বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশি হওয়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করে এখন কাগজে-কলমে বাংলাদেশি নাগরিক।’ গৃহবধূ দুলালী খাতুন বলেন, ‘এতদিন আমরা যে দেশের কাছে থেকেছি, বিপদে-আপদে যে দেশকে কাছে পেয়েছি সেই বাংলাদেশের নাগরিকত্বই গ্রহণ করে এখানেই থেকে যাওয়ার জন্যই নিজের ইচ্ছা পোষণ করেছি।’
ভারত ও বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির লালমনিরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এতদিন অনেকটা জোর করেই লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে নিজেদের মুক্তির আন্দোলন করেছি। এর মানে অনেক আগেই আমরা নিজেদের বাংলাদেশি হিসেবে দাবি করেছি। তাই বিনিময়ের পর আর ভারতে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।’