৮০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ-হিন্দু মন্দির!
দিনাজপুরের বিরলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে খুঁজে পাওয়া গেছে তিনটি বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দিরের একটি অনন্য কমপ্লেক্স। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি গবেষকদল এটি আবিষ্কার করেন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বিরল এই বৌদ্ধ-হিন্দু মন্দির কমপ্লেক্সটি নির্মিত হয়েছে ৯০০ থেকে ১৩০০ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে।
গবেষকদলের পরিচালক অধ্যাপক স্বাধীন সেন বলেছেন, এই বৌদ্ধ মন্দির দুটোর ‘স্থাপত্য পরিকল্পনার সদৃশ কোনো স্থাপনা এখনো বাংলা অঞ্চলসহ পূর্ব ভারতে পাওয়া যায়নি। সেখানে পাওয়া অলংকারসহ হাঁস এবং তীরন্দাজের চিত্রফলকও বাংলাদেশে প্রথম পাওয়া।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে রানীপুকুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামে বিষ্ণুপুর বুড়ির থান ঢিবিতে এই মন্দির তিনটি খনন করে পাওয়া গেছে।
বিরলের এই বৌদ্ধ মন্দির দুটির গঠন, শৈলী ও ব্যাখ্যার জন্য এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মন্দির স্থাপত্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থায়নে এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ছয় মাস ধরে এই খননকাজ পরিচালিত হয়েছে। মন্দিরগুলোর সময়কাল ৯০০ থেকে ১৩০০ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ের বলে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন। খননে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৫ জন শিক্ষার্থী, মহাস্থান থেকে আসা ১৫ জন দক্ষ শ্রমিক ও স্থানীয় ৩০ জন শ্রমিক কাজ করেছেন।
গবেষকদলের পরিচালক অধ্যাপক স্বাধীন সেন জানান, ‘আবিষ্কৃত প্রথম মন্দিরটি সপ্তরথ অভিক্ষেপবিশিষ্ট, বেষ্টনী প্রাচীরবিশিষ্ট। এটির পরিমাপ ৩৫ মিটার (পূর্ব-পশ্চিমে) এবং ২৬ মিটার (উত্তর-দক্ষিণে)। এই মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথের সিঁড়ি পূর্বদিকে। এই সিঁড়ির ঠিক সামনেই রয়েছে একটি নিবেদন/শারীরিক স্তূপের ভিত্তি। এই মন্দিরটির বেষ্টনী প্রাচীরের উত্তর ও দক্ষিণ দিকের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে তিনটি করে মোট ছয়টি ইটের তৈরি নিরেট বেদি/প্ল্যাটফর্ম। এই বেদিগুলোর মধ্যে মাঝখানের বেদিগুলোতে কমপক্ষে দুটি নির্মাণপর্ব রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বেদি দুটোর ওপরে সিঁড়ি রয়েছে। প্রথম নির্মিত মন্দিরটিতে সম্ভবত উত্তর ও দক্ষিণ বাহুর মাঝখানের বেদি দুটি ছিল ছোট আকারের। পরবর্তী নির্মাণপর্বে অন্য বেদিগুলো সংযুক্ত হয়েছে। কেন্দ্রে একটি স্থাপনা ছিল বলে অনুমান করা যায়। এই স্থাপনাটির প্রকৃতি ও আকার বোঝা সম্ভব নয় কারণ এটির উপরিকাঠামো ধ্বংস করে পরবর্তী কালপর্বে এখানে আরেকটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে।’
স্বাধীন সেন আরো জানান, প্রথম দিকের আদি মন্দিরটির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বেষ্টনী প্রাচীরের বাইরে আরেকটি ইটের তৈরি নিরেট কাঠামো রয়েছে। অভিক্ষেপবিশিষ্ট এই কাঠামোটির মাপ আট মিটার (উত্তর-দক্ষিণে) আর ছয় মিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এটি আরেকটি মন্দির যেটা প্রথম মন্দিরের সমসাময়িক। তবে এই মন্দিরটি সম্ভবত কোনো উপরিকাঠামো বিহীন খোলা মন্দির ছিল। খননদলের পরিচালক অধ্যাপক স্বাধীন সেন জানান, প্রথম এই মন্দির দুটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। স্থাপত্য শৈলীগতভাবে এই মন্দির দুটি ১০০০ থেকে ১১০০ শতকের বা তারও আগের হতে পারে।
নিরেট বেদিগুলো কোন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো, সেটা বুঝতে আরো সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় মন্দির বা স্তূপটির অস্তিত্ব বর্তমানে না থাকলেও, সেটি প্রধান উপাসনালয় ছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সহযোগী খনন পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহছান।
তৎকালীন বরেন্দ্র অঞ্চলে জনপ্রিয় বজ্রযান/তান্ত্রিক বৌদ্ধ ঐতিহ্যে ও আচারে বিভিন্ন নকশার মণ্ডল ব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে। সোমপুর মহাবিহার ও বিক্রমশীলা মহাবিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরসহ ভূমি পরিকল্পনাকে এমনই একটি মণ্ডল বজ্রধাতু মণ্ডলের সঙ্গে তুলনা করেছেন কয়েকজন পণ্ডিত। ক্রুশাকৃতি মন্দির একটি পরিবর্ধিত ও রূপান্তরিত রূপ হিসেবেও এই মন্দিরের স্থাপত্য পরিকল্পনাকে চিহ্নিত করা যায় বলে মনে করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক ও অধ্যাপক সীমা হক।
তাঁরা আরো মনে করেন, এই মন্দিরের বেদিগুলো সমবেত হওয়ার স্থান হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে খাওয়াদাওয়াসহ অন্যান্য কাজ সংঘটিত হতো। দৈনন্দিন ব্যবহার্য মৃৎপাত্রগুলো, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ভোজন ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে ধারণা করছেন তারা। মন্দিরসংলগ্ন তৎকালীন ঘরবাড়ি থেকেও এই মৃৎপাত্রগুলো সংগৃহীত হতে পারে।
মূল বৌদ্ধ মন্দিরটির জায়গায় পরবর্তীতে নির্মিত হিন্দু সপ্তরথ মন্দিরটি কলিঙ্গ রীতির অনুকরণে নির্মিত হয়েছে। তবে এটি আগের মন্দিরের তুলনায় ক্ষুদ্রাকৃতির। এই মন্দিরটির সময়কাল ১২০০ থেকে ১৩০০ শতক হতে পারে। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে ছয় মিটার উত্তর-দক্ষিণে আর আট মিটার পূর্ব পশ্চিমে একটি পাথরের বেদি পাওয়া গেছে। বেদিটিতে প্রতিমা রাখা হতো। সামনের মণ্ডবের [চার মিটার (পূর্ব-পশ্চিমে) আর চার মিটার (উত্তর-দক্ষিণে)] মেঝে নির্মাণের জন্য পূর্ববর্তী মন্দির ধ্বংস করে সংগৃহীত মাটি, ইটের টুকরো ও প্রচুর মৃৎপাত্র দিয়ে ভরাট করে শক্ত করা হয়েছে। এই মৃৎপাত্রগুলোর বেশির ভাগই দৈনন্দিন ব্যবহার্য মৃৎপাত্র। ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত মৃৎপাত্র সংখ্যায় অনেক কম। আগের মন্দিরের বেষ্টনী এই সময়ও বেষ্টনী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
খননের সহকারী পরিচালক ও পিএইচডি গবেষক আবির বিন কায়সার জানান, প্রত্নস্থানটি শেষপর্যায়ে সাধারণ মানুষের বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এই সময়ের প্রচুর মৃৎপাত্র, মেঝে, গর্তসহ বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই কালপর্বটি সম্ভবত ১৪০০ শতক-পরবর্তী সময়ের। এই সময়ে মন্দিরগুলো পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়েছিল। খননে মৃৎপাত্রের পাশাপাশি বেশ কিছু পোড়ামাটির চিত্রফলক, ধাতব, অলংকৃত ইট, পাথরের ভাস্কর্যের ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম রওশন কবির জানান, ‘পুরাকীর্তিটি সংরক্ষণে এরই মধ্যে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে পরামর্শ করে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে যোগাযোগের কার্যক্রম চলছে।’
স্থানীয় সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্নত্ত্ত্ব ও পুরাকীর্তিগুলো ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে। এসব স্থান শনাক্ত করে সংরক্ষণ করতে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে করে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এই স্থাপনাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন। পর্যটক ও পুণ্যার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’