রপ্তানিমূল্য প্রত্যাহার হলেও সুফল মেলেনি পেঁয়াজের দামে
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানির ক্ষেত্রে এলসি মূল্য প্রত্যাহার করার পর পাইকারিতে ১০ টাকা কমলেও কাঙ্ক্ষিত দাম কমেনি খুচরা বাজারে। ফলে এখনো আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।
গত ১০ দিন আগে বেঁধে দেওয়া পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয় ভারত সরকার। কিন্তু সেই তুলনায় দাম না কমায় ভোক্তাদের আক্ষেপের শেষ নেই।
এদিকে ভারত সরকারের কোনো ধরনের শর্ত না থাকায় রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকেরা নিজেদের মধ্যে মূল্য সমন্বয় বা আলোচনা করে পেঁয়াজ রপ্তানি ও আমদানি করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন। বর্তমানে দেশে ১৫০ থেকে ৩০০ মার্কিন ডলারে প্রতি মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে।
এপার হিলি স্থলবন্দরের কয়েকজন প্রসিদ্ধ পেঁয়াজ আমদানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশে পেঁয়াজ আমদানি করার ক্ষেত্রে কিছু তথ্য তুলে ধরে বলেন, ২০ জানুয়ারির আগে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে যেসব পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে তার ক্রয়মূল্য ছিল ৮৫০ মার্কিন ডলার। সে হিসাবে দেশে প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানি করতে খরচ পড়ে ৭২ টাকা। তখন বিক্রি করতে হয়েছে ৬০ টাকার মধ্যে। এতে প্রতি কেজিতে লোকসান হয়েছে ১২ টাকা। আর ২০ জানুয়ারির পর থেকে ৭০০ ডলারে আমদানি করা প্রতি কেজির দাম পড়ে ৫৯ টাকা। সে সময়ও পাইকারি বিক্রি করতে হয়েছে ৪৩-৪৬ টাকায়। সেখানেও কেজিতে ১৪ থেকে ১৫ টাকা লোকসান হয়েছে। তাহলে এত টাকা লোকসান দিয়ে কি ব্যবসা করা সম্ভব? আপনারাই বলুন।
ব্যবসায়ীরা আরো বলেন, সেই সময় আমদানিতে অতিরিক্ত ডলার ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে চলে যাওয়ায় এখন সমন্বয় করে এবং সতর্কতার সঙ্গে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। যাতে চলে যাওয়া ডলারের অতিরিক্ত ডলার সমন্বয় করে দেশে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। কারণ এখন তো আর আমদানিতে কোনো শর্ত নেই। তাই ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পারছেন (১৫০ থেকে ৩০০ ডলার) দেশে পেঁয়াজ আমদানি করছেন।
সোমবার বন্দরের বাংলাহিলি বাজারের গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ মানভেদে ৩২ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, বন্দরের মোকাম থেকে দুই-তিন ধরনের পেঁয়াজ কেনা হয়। পরে আরো ভালোভাবে বাছাই করে বিক্রি করেন। এতে অনেক নষ্ট পেঁয়াজ বের হয়। পেঁয়াজ নষ্ট এবং আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের কারণে খুচরা বাজারে দাম কমছে না। তা না হলে কি আর ভরা মৌসুমে পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা থাকে।
জানতে চাইলে স্থানীয় ক্রেতা আনোয়ার হোসেন বুলু জানান, তিনি বেলা ১১টার দিকে বাজারে গিয়ে এক কেজি পেঁয়াজ ৪০ টাকায় কিনেছেন।
আরেক ক্রেতা নজির শেখ জানান, ৩০ টাকা দিয়ে যে মানের এক কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন, তাতে বাছাই করলে ৭০০ গ্রাম হবে কিনা সন্দেহ। দাম তো কমছে না বলে আক্ষেপ করেন এই ক্রেতা।
হিলি স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী মো. সেলিম উদ্দীন জানান, এখন থেকে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই মূল্য নির্ধারণ করে পেঁয়াজ আমদানি করছেন। ফলে ভারত থেকে ২০০ ডলারে হোক বা ৩০০ ডলারে হোক, বাজারে দাম কমা-বাড়ার ব্যবস্থা কিন্তু ব্যবসায়ীদের হাতেই থাকছে।
সেলিম উদ্দীন উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আগে তো আমরা ৮৫০ ডলারে আমদানি করে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করেছি। তখন কেজিতে ১১ থেকে ১২ টাকা লোকসান হয়েছে। এরপর আবার ৭০০ ডলারে আমদানি করে বিক্রি করতে হয়েছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়। তখনও কেজিতে লোকসান ছিল ১৫ টাকা। সম্প্রতি ভারত সরকার এলসিমূল্য তুলে নিয়েছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে বাজারে দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তখন হয়ত ভোক্তারা ২০ টাকার নিচে প্রতিকেজি পেঁয়াজ কিনতে পারবেন।’
পেঁয়াজ আমদানিকারকের প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম ও মোফাজ্জল হোসেন মোফা জানান, ৩ ফেব্রুয়ারির পর থেকে বন্দরে মোকামগুলোতে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ১০ টাকা কমেছে। যখন ৭০০ ডলারে শর্ত মেনে ভারত থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকায় কিনে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য তাই বেশি লোকসানের ভয়ে দ্রুত ছেড়ে দিতে হয়েছে। আর আগের মতো বাধা বা শর্ত নেই। তাই তাঁরা ১৫০ থেকে ৩০০ ডলারে প্রতি মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করছেন। ভারতে নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ বৃদ্ধি পেলেও ২০ রুপির নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। সব খরচ মিলে দেশে আমদানি করতে হচ্ছে মানভেদে ৩০ থেকে ৩৬ টাকায়। তাতে খুচরা বাজারে কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা কমেছে বলে দাবি করেন তাঁরা।
এদিকে হিলি স্থলবন্দরের কাস্টমস কার্যালয় সূত্র জানায়, ১ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ভারত এলসি মূল্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর চাহিদা বেড়েছে। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১০০ মেট্রিকটন বেশি পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে।
ভারতের হিলির পেঁয়াজ রপ্তানিকারক মেসার্স মৌমিতা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হারু পোদ্দার বলেন, ‘বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানিতে সরকারের কোনো শর্ত নেই। আমরা দুই দেশের ব্যবসায়ীরা স্থানীয় বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দরদাম ঠিক করে পেঁয়াজ বেচা-কেনা করছি। আগে পেঁয়াজ আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ডলার এসেছে ঠিকই। কিন্তু এটাকে ডলার পাচার বলা যাবে না। কারণ এখন আমরা তো সেই অতিরিক্ত ডলার সমন্বয় করে তাঁদের কমদামে পেঁয়াজ দিচ্ছি। হয়ত ডলারটা কিছুদিন এখানে আটকে ছিল। এর বাইরে কিছু নয়।’