একটি দুর্ঘটনা, একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ!
রাকিবুল আলম (২৩)। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার হবে। ছেলেরও সেই ইচ্ছেই ছিল। সেই স্বপ্নকে ধারণ করেই ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু হঠাৎ করে সেই স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিল একটি সড়ক দুর্ঘটনা।
রাকিবুল দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার উত্তর বাসুদেবপুর গ্রামের ফরিদ খানের ছেলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বছর ধরে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ক্ষত পঙ্গুত্বের যন্ত্রণা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন এই মেধাবী ছাত্র ও তাঁর পরিবার। ছেলের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে পরিবারটি আজ নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
অভিযোগ রয়েছে, দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ হিসেবে আজ পর্যন্ত এক টাকাও পাননি রাকিবুল ও তাঁর পরিবার।
রাকিবুলের বাবা ফরিদ খান বলেন, ‘রাকিবুল এসআর ট্রাভেলসের একটি বাসে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় হিলি থেকে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছিলেন। রাত দেড়টার দিকে নেশাগ্রস্ত চালক বগুড়ার শেরপুরের ধুনট মোড়ে দাঁড়ানো একটি পাথরবোঝাই ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এ সময় যাত্রীবাহী কোচের সুপারভাইজার জাহিদুল ইসলাম নিহত হন। ওই বাসের যাত্রী আমার ছেলে মারাত্মকভাবে আহত হন। দুর্ঘটনায় তাঁর বাঁ পায়ের পাঁচটি হাড় ভেঙে যায়। আমি খবর পেয়ে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলেকে দেখতে যাই। সেখানে ছেলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করি।’
রাকিবুলের বাবা আরো জানান, পঙ্গু হাসপাতালে ১০ মাস ধরে এ পর্যন্ত তার পায়ে চারটি অপারেশন করা হয়েছে। আরো দুই-একটি অপারেশন করা হতে পারে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। এরই মধ্যে ছেলের চিকিৎসা বাবদ ১০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। চিকিৎসা করাতে আরো কয়েক লাখ টাকা লাগবে। এ ঘটনায় আমি ক্ষতিপূরণের জন্য এসআর ট্রাভেলসের দায়িত্বে থাকা বগুড়ার প্যারিস নামে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু তিনি আমাকে আজ নয় কাল করে সময়ক্ষেপণ করছেন, যাতে আমি ক্ষতিপূরণের জন্য আইনগত কোনো দিকে না যাই। পরে এসআর ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম রহমান শহীদের মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে ওই এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো আশ্বাস পাইনি।
প্যারিস নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বলেন, ‘তিন থেকে চার মাস আগে আহত ব্যক্তির বাবা একটি মাধ্যমে আমার কাছে আসেন। আমি তখন এসআর ট্রাভেলসের এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। এর পর আর কিছু জানি না।’ প্যারিস দাবি করেন, তিনি এসআর ট্রাভেলসের কেউ নন।
রাকিবুলের মা আনজু আরা খান বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে আমাদের পরিবারে অনেক স্বপ্ন ছিল। একটি দুর্ঘটনা আমাদের সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। নেশাগ্রস্ত চালকের কারণেই আমার লেখাপড়া করা ছেলেটি আজ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। ছেলের দিকে তাকাতেই কান্না আসে। ছেলের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। তবে ছেলেকে পেয়েছি, এটাই আল্লাহর কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া।’
এদিকে বুধবার হাকিমপুরের উত্তর বাসুদেবপুর গ্রামের বাড়িতে দেখতে গেলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে কাছে আসেন রাকিবুল। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘লেখাপড়া আর আমার ভাগ্যে নাই। সারা জীবন পঙ্গুত্বকে বরণ করেই চলতে হবে। যে আশা, যে উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলাম এখন দেখছি সেটা শুধুই স্বপ্ন।’
এদিকে এ ঘটনায় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর বগুড়ার শেরপুর পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) আবু তাহের বাদী হয়ে শেরপুর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ১ সেপ্টেম্বর রাত দেড়টার দিকে এসআর ট্র্যাভেলস নামে কোচটি বগুড়ার ধুনট মোড়ে দাঁড়ানো পাথরবোঝাই ট্রাককে ধাক্কা দিলে কোচের সুপারভাইজার জাহিদুল ইসলাম নিহত ও হেলপারসহ চার থেকে পাঁচজন জখম হন। পরে এসআর ট্র্যাভেলের চালক ও পাথরবোঝাই ট্রাকের চালকের (অজ্ঞাত) নামে মামলা করা হয়। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরপুর টাউন পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জিল্লুর রহমান গত ৭ ফেব্রুয়ারি বগুড়া আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এ বিষয়ে ২২ আগস্ট এসআর ট্রাভেলসের এমডি গোলাম রহমান শহীদ মুঠোফোনে বলেন, ‘এক বছর আগের ঘটনা। খবর পেয়ে আমাদের লোকজন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল। আমরা কিছু আর্থিক সহায়তা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাঁরা নিতে চাননি। এখন যদি তাঁরা চিকিৎসার ব্যাপারে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চায় তাহলে তো আর দেওয়া সম্ভব না।’ তবে আহত রাকিবুলের পরিবারের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করবেন বলে জানান তিনি।