অপূর্ণতা নিয়েই ১১ বছরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
তিন দিকে পাহাড়ঘেরা বন। সবুজ আর মায়াবী ছায়ায় ঢেকে আছে প্রকৃতি। ছোট ছোট পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা বয়ে গেছে বহু দূরে। আর সামনেই কুমিল্লার বিখ্যাত লালমাই পাহাড়ের শোভা। ২০০৬ সালের ২৮ মে কুমিল্লা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়’।
আজ ২৮ মে শনিবার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ১০ পেরিয়ে ১১ বছরে আজ পা দিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠার পর এতগুলো দিন পার হয়ে গেলেও আজো পূর্ণতা পায়নি এ বিশ্ববিদ্যালয়। বরং নানা সমস্যা আর অপূর্ণতা যেন আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে আছে এ বিদ্যাপীঠকে ।
১০ বছর পরও এ অপূর্ণতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম পদে পদে ব্যহত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ‘নবীন বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থ সংকট বলে এ অপূর্ণতা’- প্রশাসনের এমন মন্তব্য নাকচ করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অযোগ্যতাকেই দায়ী করলেন এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশিষ্টজনরা।
পর্যাপ্ত জমি না থাকা, আবাসিক ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা, চিকিৎসাসেবার দুর্বলতা,অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন, গ্রন্থাগার এবং শ্রেণিকক্ষের বেহাল দশা, বিভিন্ন সময় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। কর্মকতা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা ও অসদাচারণের অভিযোগসহ নানাবিধ কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত করে চলেছে।
নতুন ভূমি অধিগ্রহণে প্রশাসন ব্যর্থ
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রকল্পে ১০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়। সে সময়ে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য মাত্র ৬৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এতে ৫০ একরের বেশি ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি। পাহাড়ি উঁচু-নিঁচু ৫০ একর ভূমির মধ্যে বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য ভূমি প্রায় ২০ একর। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৭০ একর ভূমি নতুন করে অধিগ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়।
কিন্তু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে পরিকল্পনা কমিশনে গিয়ে বাতিল হয়ে যায়। পরে ১০ একর ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হলে এর জন্য ৪০ কোটি টাকা সংস্থান রাখা হয়। কিন্তু এই বরাদ্দও বিভিন্ন কারণে বাতিল যায়। এখন পুনরায় ভূমি অধিগ্রহণের জন্য আবেদন করা হবে বলে এ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
অপ্রতুল আবাসিক ব্যবস্থা
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছয় হাজার শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক হল রয়েছে চারটি। এর মধ্যে একটি ছাত্রী হল বাকি তিনটি ছাত্র হল। হল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চারটি হলের স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ শিক্ষার্থীর। কিন্তু এই আবাসন সুবিধার মধ্যে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার শিক্ষার্থী বসবাস করছে।
অভিযোগ অনুযায়ী হলগুলোতে পড়ার কক্ষ, গ্রন্থাগার এবং ক্যন্টিনের ব্যবস্থা নেই। মাত্র তিন-চারটি পত্রিকা হলগুলোতে রাখা হলেও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকা পড়ার সুযোগ পায় না বলে জানা যায়।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা অনেক কম। উপাচার্যের জন্য রয়েছে একটি বাংলো, শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে দুটি পাঁচতলা ডরমেটরি।
এ ডরমেটরিতে ৪০ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা থাকতে পারেন বলে জানা যায়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী কার্যালয় জানায়, ছাত্রছাত্রীদের জন্য আরো দুটি আবাসিক হল র্নিমানেণের পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া আছে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য আরো দুটি ডরমেটরি করার পরিকল্পনাও। তবে এ পরিকল্পনা কবে নাগাদ বাস্তবায়িত হতে পারে এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি।
অপর্যাপ্ত এবং ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য বাস অপর্যাপ্ত এবং সেই সাথে ত্রুটিপূর্ণও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য নেই পরিবহন পুল। আর বিআরটিসির অদক্ষ চালকের কারণে বার বার ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনাও।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় দুটি পাজারো, একটি কার, তিনটি মাইক্রোবাস এবং পাঁচটি বাস রয়েছে। এ ছাড়া বিআরটিসি থেকে ভাড়ায় চালানো হয় আরো নয়টি বাস। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য এ পরিবহন ব্যবস্থা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বললে তারা অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। জানায়, ভাড়া করা এ বাসগুলোর সবই ত্রুটিপূর্ণ। যাত্রা পথে প্রায়ই বাসগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেলে বিপাকে পড়ে শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিআরটিসির বাসগুলোর বেহাল অবস্থা। কোনোটার দরজা-জানালার গ্লাস ভাঙ্গা। ধুলায় ভিন্ন রং ধারণ করেছে বাসগুলো। বিআরটিসির চালকরা বাসগুলো যত্রতত্র চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রায়ই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত বাসগুলো শহরসহ বিভিন্ন জায়গায় গণপরিহনের কাজে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
শ্রেণিকক্ষ সংকট
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে আছে মাত্র ৪২টি শ্রেণিকক্ষ। ১৯টি বিভাগের জন্য যা কোনোক্রমেই পর্যাপ্ত নয়। কোনো কোনো বিভাগে মাত্র একটি শ্রেণিকক্ষও আছে।
শ্রেণিকক্ষের সংকট কাটাতে প্রশাসনিক ভবনের তিনটি কক্ষে শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম চালানো হয়। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ও আইন বিভাগের জন্য নেই নিজস্ব অফিস এবং শ্রেণিকক্ষ। শ্রেণিকক্ষের এ সংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে যথা সময়ে নেওয়া যাচ্ছে না ক্লাস। এতে সেশনজটের আশঙ্কায় আছে শিক্ষার্থীরা।
গ্রন্থাগারে নেই পড়ার কক্ষ
প্রশাসনিক ভবনের পাঁচ তলায় দুটি কক্ষে মাত্র ৬০ আসন নিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য এ কয়টি আসন যেন এক পরিহাস ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ ছাড়া গ্রন্থাগারে সব বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বই পাওয়া যায় না বলে জানান একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
গ্রন্থাগারসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো পড়ার কক্ষ। একমাত্র ছাত্রী হলে পড়ার কক্ষ থাকলেও অন্য কোনো হলে নেই। বিভাগ বা অনুষদ ভবনে নেই পড়ার কক্ষ ও কমন রুম। এতে শিক্ষার্থীরা ক্লাস প্রস্তুতিসহ ক্লাসের অবসরে পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা আলাদা গ্রন্থাগার ভবনের দাবি করলেও প্রশাসন এ বিষয়ে কর্ণপাত করছে না বলেও জানায় শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গ্রন্থাগার খোলা রাখার দাবিও জানায় তারা।
আবাসিক চিকিৎসক নেই
প্রশাসনিক ভবনে নিচ তলার একটি কক্ষে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার। নামে মেডিকেল সেন্টার হলেও এটি এক কক্ষ বিশিষ্ট। এই মেডিকেল সেন্টারে আছেন চারজন চিকিৎসক, একজন স্বাস্থ্য সহকারী, একজন নার্স এবং একজন অফিস সহকারী।
এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় ডিসপেন্সরির হাতুড়ে ডাক্তারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে সুস্থ হওয়ার চেয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা।
মেডিকেল সেন্টার প্রায়ই ওষুধ থাকে না। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে মেডিকেল সেন্টারের সার্বিক বরাদ্দ মাত্র ৮০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া মেডিকেল সেন্টারের অধীনে একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকার কথা থাকলেও তা রয়েছে রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের অধীনে। এতে জরুরি সময়ে অ্যাম্বুলেন্স পেতে সমস্যা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের প্রধান ডা. মাহমুদুল হাসান খান জানান, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা পর্যাপ্ত সেবা পাচ্ছেন না। তবে আমরা আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। চিকিৎসাসেবা উন্নত করতে হলে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়াতে হবে, আবাসিক চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে, ভালো ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে ওষুধের জন্য বরাদ্দ অর্থও।
এখনো অসম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পশ্চিমে ১২০ বর্গমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৪৫ বর্গমিটার প্রস্থের একটি খেলার মাঠ নির্মাণের কাজ চলছে। এর জন্য তিন দফায় টাকা খরচ করা হয়েছে। তবে মাঠটির কাজ এখনো অসম্পূর্ণ রয়েছে।
২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অসম্পূর্ণ এ মাঠ উদ্বোধন করেন উপাচার্য ড. মো. আলী আশরাফ। তবে সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন করে দেখা যায়, মাঠে শুধুই বালুর ছড়াছড়ি।
মাঠের এ অবস্থার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। জানা যায়, এ মাঠের কাজ করা হয়েছে তিন ধাপে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে। টেন্ডার আহ্বান না করে কোটেশন পদ্ধতিতে ২০১৪ সালের ২২ জুন মাঠের নির্মাণকাজ শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শুরুতেই চার লাখ ৪৯ হাজার টাকা, দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দুই লাখ ৬৩ হাজার টাকা এবং ১৮ নভেম্বর দুই লাখ ৫৭ হাজার টাকা নিয়ে মাঠ নির্মাণকাজ করে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাগজে-কলমে গত বছরের ২৯ জুন মাঠ নির্মাণকাজ শেষ হয়। কিন্তু কয়েক দফায় কাজ হলেও এখনো মাঠকে মুরুভূমির ধু-ধু বালুচর বলেই মনে হয়।
পরিকল্পনাহীন প্রশাসনিক ভবনে অফিসের জটলা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে এখন সকল অফিসের অবস্থান। এখানে আছে প্রকৌশল কার্যালয়, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, মেডিকেল সেন্টার, বিএনসিসির অফিস, শিক্ষক লাউঞ্জ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, প্রক্টর অফিস,পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস, স্টোর অফিস, অর্থ শাখা, ল্যাবরেটরি, কম্পিউটার ল্যাব এমনকি শ্রেণিকক্ষও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ছায়াও নেই। এখানের প্রতিটি স্থাপনায় যেন পরিকল্পনাহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে প্রশাসনের সূত্র জানায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি। জরুরি কয়েকটি ভবন নির্মাণও। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, স্বতন্ত্র পরীক্ষা হল, অডিটরিয়াম, জিমনেসিয়াম, শিক্ষক লাউঞ্জ, আবাসিক হল, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবনসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ এখন জরুরি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।