মা বলতেন, পড়া না হলে খাবার দেবো না তোকে
‘একটা মানুষের মাথার ওপরে আটটা বই। কখনো কি বাবা-মা এগুলো ভাবে? না, আমার বাবা-মা তা ভাবে না। যদি ভাবত, তাহলে স্কুল থেকে আসার পর বলত না যে তুমি কি আজকে স্কুলে সব পড়ালেখা পারছ? এইচডব্লিউ করে নিয়ে গেছিলা? বকা দিছে নাকি?’
এভাবেই দেশের একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী এক শিশু নিজের কষ্টের কথা বলছিল। পড়ালেখা নিয়ে বাবা-মায়ের দেওয়া অব্যাহত চাপের মুখে ভীষণ কষ্ট পেয়ে সে বলে, ‘কখনো বলে না, তুমি কি খুব ক্লান্ত আছো নাকি? একটু খাও, একটু রেস্ট নাও। বলে যে এখনই তাড়াতাড়ি করে হাত-মুখ ধুয়ে আবার পড়তে বসো। ঠিক আছে, পড়ি।’
প্রতিদিন কেমন কাটে এই শিশুটির? জানতে চাইলে ক্যামেরার সামনে সে বলে, ‘আমি স্কুল থেকে আসতে আসতে সাড়ে ৩টা বাজে। ফ্রেশ হতে না হতেই হুজুর আসে। তার কাছে পড়ি। সে যেতে যেতে আমার বিকেলের টিচার আসে। তার পড়া সব সময় তার কাছেই রেডি করি, কখনো রাখি না আলাদা করে। সে যেতে যেতেই ৭টা-সাড়ে ৭টা এ রকম। তার কিছুক্ষণ পরেই মা আসে। মা এসে বলে আজকে পড়েছ সবার কাছে? হ্যাঁ। তার পরে তার কাছে পড়তে বসি। পড়তে পড়তে ৯টা। তার পরে মা যায় ঘরের কিছু কাজ করে। তখন আমি আবার পড়তে বসি। পড়তে পড়তে যখন ১০টা-১১টা বাজে, তখন খুব ক্লান্ত হয়ে যাই। ক্লান্ত হয়ে একটু খেয়ে ঘুমাই। সকালবেলা আবার একই রুটিন।’
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় একবার শিশুটির ফল কিছুটা খারাপ হয়েছিল। সে সময় তার বাবার করা আচরণের কথা মনে করে কেঁদে ফেলে সে। বলে, ‘আমার মনে আছে, যখন আমি থ্রিতে পড়তাম, তখন আমার রোল একবার ৫ হয়েছিল। তো, হওয়ার কারণে বাবা যখনই শুনছে যে আমার রোল ৫ হয়েছে, বাবা সেদিন এসে আমাকে বাইরে পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়া করায়ে রাখছিল। আমার খুব খারাপ লাগছিল তখন। যে হতেই তো পারে, মানুষ তো ভুল করে, তারাও তো করছে না? সব সময় কি রোল এক হতে হবে?’
শিশুটি জানায়, তার লেখাপড়ার অগ্রগতি নিয়ে বাবা সব সময় মাকে বকাবকি করেন। তার ধারণা, শিশুটির মা তার মেয়ের যথাযথ খেয়াল রাখতে পারছেন না। আর এ কারণে স্বামীর ওপর রাগটা তিনি দেখাতেন মেয়ের ওপরে।
এ বিষয়ে শিশুটি বলে, ‘মা রেগে গিয়ে সব বকাঝকা আমার ওপরে দিত। বলত, এই পড়াটা যদি না হইসে তোকে আজকে আমি খাবার দেবো না, তোকে আজকে মারব, তোকে আজকে কিচ্ছু করতে দেবো না।’
‘আমি পড়তাম, কষ্ট হলেও পড়তাম। কারণ কী? বলে তো ভালোর জন্যই বলে। খারাপের জন্য তো বলে না। কষ্ট হলেও পড়তে হবে, ভবিষ্যতের জন্য করতে হবে, করি।’
স্কুলের সামনে বড় একটা মাঠ আছে, সেখানে ছুটির পর অন্য সব বন্ধু খেললেও সে খেলার অনুমতি পায় না বলেন জানায় শিশুটি। সে বলে, ‘তাদের মায়েরা বলে যে যাও একটু খেলে আসো। এই কথাগুলো যখন বলে, আমার খুব খারাপ লাগে। কেন আমার বাবা-মা এ রকম করে বলে না? একটা মানুষ কি সারা দিন একভাবে পড়বে? তার মানসিক বিকাশের জন্য তার কি খেলাধুলা বা অন্য কোনো বিনোদনের দরকার নেই? আছে তো। কিন্তু তারা কখনোই এ রকম বলে না। সারাক্ষণ বলে, পড়ো পড়ো পড়ো পড়ো পড়ো। তারা কখনো বলে না যে আজকে একটু রেস্ট করো বা আজকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাই চলো। বা আজকে আমার সাথে খেল। আমার খুব ইচ্ছা করে শীত এলে বাবার সাথে র্যাকেট খেলতে, মার সাথে খেলতে, তারা খুব ভালো পারে। কিন্তু তারা কখনো বলে না। আর তাদের আমি বললে বলে, কিসের খেলা? সারাক্ষণ তুমি পড়বা। তুমি যদি খেল, তাহলে রেজাল্ট কীভাবে ভালো হবে? রোল কীভাবে আগাবে? তাদের কথা শুনি।’
এসব কথা বলতে বলতে ক্যামেরার সামনে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশুটি।
এ সময় গৃহশিক্ষিকার কাছে পড়ার অভিজ্ঞতা জানায় এই শিশু। সে বলে, কোনো কিছু না বুঝলে একবারের বেশি শিক্ষিকাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে না। তার কাছে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করলে তিনি বিরক্ত হন। মাথার মধ্যে কী আছে, জানতে চান। এমনকি বাবার কাছে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেও তিনি একই ধরনের উত্তর দেন।
শিশুটি প্রশ্ন রাখে, ‘ভুল তো হতেই পারে না? বুঝতে তো না-ই পারি। সবার মাথা কি এক? সবার ব্রেন কি একরকম?’
সব সময় এভাবে চাপ দেওয়ায় খুব কষ্ট পায় জানিয়ে শিশুটি বলে, ‘আমি মা-বাবাকে অনেক ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি। আই লাভ মাই মাদার অ্যান্ড ফাদার। এখন আমি চাই না যে তাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করি। মাঝে মাঝে খুবই খারাপ লাগে। কিন্তু তাও তাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করি না। কারণ তারা আমার মা-বাবা। তারা আমার ভালোর জন্যই চায়। তাই আমি পড়ি। তাই তাদের কথা শুনি।’