কল্পবিজ্ঞানের রাজপুত্র এসি ক্লার্ক
এক বিমান দুর্ঘটনা থেকে কোনো রকমে বেঁচে যান কয়েক জন যাত্রী। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের একজন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় আমি আর্থার সি ক্লার্কের একটি বই খুব মন দিয়ে পড়ছিলাম। তাই টেরই পাইনি কী হয়েছে। তাই আমার মরার ভয়ই জাগেনি।’
এই সাক্ষাৎকার পড়ে আর্থার সি ক্লার্ক বন্ধু ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আইজাক আসিমভকে চিঠি লিখলেন, ‘দেখলে তো, ওই সময় সেই যাত্রী কার বই পড়ছিল? তোমার বই নয়; আমার বই।’
চিঠির উত্তরে আসিমভ লিখলেন, ‘তাই তো লোকটি মৃত্যুকে ভয় পায়নি। তার মনে হয়েছিল, ওই বই পড়ার চেয়ে মরাও শ্রেয়।’
এই গল্প আমরা শুনতে পাই আসিমভের স্মৃতিকথায়। এবার শুনবো কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্কের জীবনের কথা। ১৯১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইংল্যন্ডের সামারসেটের মাইনহেডের এক কৃষক পরিবারে ক্লার্কের জন্ম। পুরো নাম আর্থার চার্লস ক্লার্ক। হাইশ গ্রামার স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। এরপর অর্থের অভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি বলে কাজে যোগ দেন শিক্ষাবোর্ডে পেনশন অডিটর হিসেবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ক্লার্ক ‘রয়াল এয়ার ফোর্সে’ রাডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করেন। শৈশবে বিভিন্ন ম্যাগাজিনের কল্পবিজ্ঞানমূলক রচনা পড়তে ভালোবাসতেন। যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা থেকেই লিখে ফেলেন অবৈজ্ঞানিক কল্প-উপন্যাস ‘গ্লাইড পাথ’। তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে ‘গ্রাউন্ড কন্ট্রোল অ্যাপ্রোচ (জিসিএ)’-এ, যার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে। যুদ্ধে জিসিএর বাস্তবিক প্রয়োগ না থাকলেও, ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সালের বার্লিন এয়ারলিফটিংয়ের উন্নয়নে এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আর্থার করপোরাল হিসেবে আর্থার সি ক্লার্ক কর্মজীবনের সূচনা করলেও ১৯৪৩ সালের ২৭ মে কারিগরি বিভাগের পাইলট অফিসার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন তিনি। ছয় মাস পর ২৭ নভেম্বর তিনি ফ্লাইং অফিসার হিসেবে আরেক দফায় পদোন্নতি লাভ করেন। এ সময় ক্লার্ক ‘রয়াল এয়ার ফোর্স’-এর প্রধান ট্রেনিং নির্দেশক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ শেষে লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’ থেকে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পর ১৯৪৬-১৯৪৭ ও ১৯৫১-১৯৫৩ সময়ে ‘ব্রিটিশ ইন্টারপ্লেনেটারি সোসাইটি’-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ক্লার্ক। যদিও তিনি ‘জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট’ ধারণার প্রবর্তক ছিলেন না, তবুও আদর্শ টেলিযোগাযোগ সম্প্রচার পরিকল্পনাতে তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৫ সালে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বিআইসির শীর্ষস্থানীয় কারিগরি সদস্যদের কাছে তিনি এ পরিকল্পনার কাগজ জমা দেন। যা একই বছরে ‘ওয়্যারলেস ওয়্যার্ল্ড’ অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আর্থার সি ক্লার্ক অবশ্য অসংখ্য অবৈজ্ঞানিক উপন্যাসে মহাশূন্যযান ও মহাশূন্য অভিযান সম্পর্কিত কারিগরি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কথা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে ‘দ্য এক্সপ্লোরেসন অব স্পেস’ ও ‘দ্য প্রমিজ অব স্পেস’ উল্লেখযোগ্য। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিয়ন’ বিষুবরেখার প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার (২২ হ্জার মাইল) উপরে স্থাপিত জিওস্টেশন্যারি অরবিটকে ‘ক্লার্ক অরবিট’ নামে নামকরণ করেছে।
১৯৫৩ সালে ফ্লোরিডা ভ্রমণে গেলে আর্থার ২২ বছর বয়সী এক বিধবা ও এক পুত্র সন্তানের জননী ম্যারিলিন মেফিল্ডের সাথে পরিচিত হন এবং তাঁকে বিয়ে করেন। ১৯৬৪ সালে তাদের মধ্যে স্থায়ী বিচ্ছেদ ঘটে।
সত্তরের দশকে আর্থার তিনটি বই প্রকাশের চুক্তি করেন এক কোম্পানির সঙ্গে। যা তখন পর্যন্ত কোনো কল্পবিজ্ঞান লেখকের সর্বোচ্চ রেকর্ড। চুক্তিকৃত তিনটি বইয়ের প্রথম ‘রঁদেভ্যু উইথ রামা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৮০ সালের দিকে ‘আর্থার সি ক্লার্কস মিস্টেরিয়াস ওয়্যার্ল্ড’, ‘আর্থার সি ক্লার্কস ওয়্যার্ল্ড অব স্ট্র্যাঞ্জ পাওয়ার’ ও ‘আর্থার সি. ক্লার্কস মিস্টেরিয়াস ইউনিভার্স’ টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলোপৃথিবীজুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৮৯ সালে রানি এলিজাবেথের জন্মদিনে আর্থারকে ‘কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (সিবিই)’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ২০০০ সালের ২৬ মে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হয় ‘নাইট ব্যাচেলর’ সম্মাননা।
আর্থার সি ক্লার্ক ছিলেন বিখ্যাত অডিসি সিরিজের স্রষ্টা। তিনি একাধিকবার হুগো ও নেবুলা পুরস্কার লাভ করেছেন। ‘২০০১ : আ স্পেস অডিসি’ চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্য রচনার জন্য স্ট্যানলি কুবরিকের সাথে যৌথভাবে মনোনয়ন পেয়েছেন একাডেমি পুরস্কার। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই ক্লার্ক কাটিয়েছেন শ্রীলঙ্কায়। দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টের সমস্যা ও হৃদযন্ত্রজনিত সমস্যায় ভোগার পর ২০০৮ সালের ১৯ মার্চ শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে মারা যান আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের এই অগ্রগণ্য লেখক।