৯৬ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের প্রত্যয়
আজ ১ জুলাই। ১৯২১ সালের এই দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাঙালির ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাঙালি জাতির সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে এ বিদ্যাপীঠ। এই দেশ যখনই সংকটে পড়েছে, তখনই সংকট নিরসনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র-শিক্ষকরা।
’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিদ্যাপীঠটির ছাত্র-শিক্ষকরা। নানা আন্দোলন-সংগ্রামে চড়াই-উতরাই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেই ৯৬ বছরে পদার্পণ করেছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়।
‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও মানবিক চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষা’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এ বছর দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে।
দিবসটি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে শোভা পাচ্ছে রং-বেরঙের আলোকসজ্জা। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন, প্রশাসনিক ভবন, কলাভবন, টিএসসি, কার্জন হলের আলোকসজ্জা সবার নজর কাড়ে। অনেক শিক্ষার্থী রাতের ওই আলোতে ছবি তোলার জন্য ভিড় জমায় কার্জন হলসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনের সামনে।
এদিকে, দিবসটি কেন্দ্র করে ক্যাম্পাস চত্বর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযানে প্রতিষ্ঠানটির রোভার স্কাউট গ্রুপের অন্তত ২৫০ সদস্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির পরিচ্ছন্নকর্মীরাও এ অভিযানে অংশ নিয়েছেন।
আজ সকাল সোয়া ১০টায় প্রশাসনিক ভবনসংলগ্ন মলে জাতীয় পতাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোর পতাকা উত্তোলন, পায়রা ওড়ানো এবং উদ্বোধনী সংগীতের মধ্য দিয়ে দিবসটির কর্মসূচি শুরু করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দিনব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এর আগে সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন হল থেকে শোভাযাত্রাসহ প্রশাসনিক ভবনসংলগ্ন মলে জমায়েত হন। সেখান থেকে শোভাযাত্রাসহকারে টিএসসিতে যান।
বেলা ১১টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় ‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও মানবিক চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সদস্য রামেন্দু মজুমদার। উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় সম্মানিত অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও (প্রশাসন) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, প্রাক্তন উপ-উপাচার্য, প্রফেসর ইমেরিটাসবৃন্দ, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির প্রতিনিধিবৃন্দ।
অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার আয়োজিত দুর্লভ পাণ্ডুলিপি প্রদর্শন এবং সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টায় পর্যন্ত কার্জন হলে বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের উদ্ভাবিত চিকিৎসা প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বেলা ১১টায় চারুকলা অনুষদের আয়োজনে চিত্রকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদ, বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও হল দিনব্যাপী নিজস্ব কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে হল, বিভাগ ও অন্যান্য অফিস দুপুর ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সে সময়ে কলা অনুষদ ছিল বৃহত্তম। এর আওতায় আটটি বিভাগ ছিল। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি অনুষদ, ৮০টি বিভাগ, ১১টি ইনস্টিটিউট, ৪৮টি গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র, ২০টি আবাসিক হল, তিনটি হোস্টেল, একটি নির্মাণাধীন হোস্টেল, এক হাজার ৯২৬ শিক্ষক, ৩৭ হাজার ৬৪ জন শিক্ষার্থী, এক হাজার ৬৪ জন কর্মচারী, এক হাজার ৫৮ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, দুই হাজার ২৩০ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রয়েছেন। এ ছাড়া এক হাজার ৩০০ পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত, এক হাজার ২৫০ জন এমফিল ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং ২৯১টি ট্রাস্ট ফান্ড রয়েছে।
১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর পঞ্চম জর্জের সময় দিল্লি দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর প্রধানত মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গের মানুষের অন্যতম দাবি ছিল, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। তখন পূর্ব বাংলার দরিদ্র মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবাই ছিল কলকাতা বা তার আশপাশের এলাকায়। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় এলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার জন্য এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। লর্ড হার্ডিঞ্জ এ দাবির যৌক্তিকতা বিচার করে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন।
১৯১২ সালের ২৭ মে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানকে সভাপতি করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু তৎকালীন স্বার্থান্বেষী মহল এ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে।
পরে ১৯১৩ সালে বঙ্গীয় আইনসভায় বাজেট বক্তৃতায় নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ফলে বড়লাট লর্ড চেম্সফোর্ড কর্তৃক ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম ই স্যাডেলারের সভাপতিত্বে এক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন হিসেবে পরিচিত। এই কমিশন দুটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ করে। এক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তকরণ ক্ষমতা থাকবে না। দুই. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
এই কমিশনের পর ১৯২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় আইনসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৮ মার্চ সর্বসম্মতিক্রমে অ্যাক্ট-এ পরিণত হয়। এ আইনের বলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। সেটির প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি করা। যারা পরে পূর্ববঙ্গের সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবে।